করোনায় সাংবাদিকতা কঠিন হয়ে উঠেছিল

অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে লেখক–সাংবাদিকেরা। ছবি: প্রথম আলো
অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে লেখক–সাংবাদিকেরা। ছবি: প্রথম আলো

করোনা শুধু পরিবেশ–পরিস্থিতিই বদলে দেয়নি, বদলে দিয়েছে সমাজ, ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানকে। এই বদলে যাওয়া এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। করোনাবিপর্যয়ের গ্রাউন্ড জিরো নিউইয়র্ক থেকে করোনা সংকটকালে সাংবাদিকতা কঠিন হয়ে উঠেছিল। বৈরী বাস্তবতায় প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার লেখক, সাংবাদিক, কন্ট্রিবিউটাররা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। বিপন্ন সময়ে তথ্য সহযোগিতা দিয়ে শুধু প্রবাসীদেরই নয়, সারা বিশ্বের বাংলাভাষী পাঠকদের সমৃদ্ধ করেছেন।

১০ জুলাই প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার লেখক, সাংবাদিক ও কন্ট্রিবিউটরদের (প্রদায়ক) নিয়ে এক আলোচনায় আলোচকেরা এসব কথা বলেন। চলমান বাস্তবতায় নিউজার্সির নর্থ ব্রান্সউইকে সীমিত কলেবরে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সামনে বিক্ষোভে যোগ দেওয়া দুই নারীর একজন রাজিয়া উদ্দিন এবং তাঁর মেয়ে মনমাউথ ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক ড. ন্যান্সি উদ্দিন, নাগরিক সংগঠক সৈয়দ উতবা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন শাহ আহমদ। শুরুতেই ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানানো হয়।

আলোচনায় প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরী বলেন, চার মাসে করোনাসংক্রান্ত সাত শতাধিক সংবাদ করা হয়েছে। নিউইয়র্কে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে চরম বিপর্যয়ের দিনেও প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সংবাদকর্মীরা থেমে যাননি। নিজেদের, পরিবারের কঠিন সময়েও সবাই একসঙ্গে কাজ করায় ছাপা পত্রিকা চালু রাখা সম্ভব হয়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে অনলাইনে প্রতিদিনের রিপোর্ট পাঠক কর্তৃক সমাদৃত হয়েছে। অসংখ্য পাঠক এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কঠিন সময় অবদানের জন্য তিনি লেখক সাংবাদিকদের এমন প্রয়াসের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।

প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান উত্তর আমেরিকা সংস্করণের লেখক সাংবাদিকদের ব্যক্তিগতভাবে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন। বিদুষী নারী রাজিয়া উদ্দিন ও ড. ন্যান্সি উদ্দিন শুভেচ্ছা বার্তাটি প্রাপকদের হাতে তুলে দেন।

অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে লেখক–সাংবাদিকেরা। ছবি: প্রথম আলো
অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে লেখক–সাংবাদিকেরা। ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদক বলেন, নিউইয়র্কে প্রথম আলোর সাংবাদিকতার স্বীকৃতি জানিয়েছেন এখনকার অনেক বোদ্ধা। নাম–পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক লোকজনও এগিয়ে এসেছেন এসব সাংবাদিকদের পুরস্কৃত করতে। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসেই এমন অর্জন সম্ভব হয়েছে। অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন লেখক কান্তা কাবীর।

অনুষ্ঠানে লেখক–সাংবাদিকেরা তাদের করোনাকালীন অভিজ্ঞতার কথা জানান। শাহ আহমদ বলেন, প্রতিদিনের মৃত্যুর হিসাব রাখাসহ করোনায় মৃত প্রবাসীদের নাম পরিচয় সংগ্রহ করা কঠিন কাজ ছিল। নিজের পরিবারে করোনায় মৃত্যুর শোক নিয়েও তিনি সাংবাদিকতার দায়িত্ব প্রতিদিন পালন করেছেন।

লেখক গীতিকার ইশতিয়াক রূপু বলেন, করোনাকালে নিউইয়র্কে প্রকাশিত প্রথম আলো সংগ্রহে রাখতে হবে। আজ থেকে শত বছর পরের বাংলাভাষী লোকজন এ সময়ের সংবাদ পাঠ করে জানতে পারবে করোনার কঠিন সময়ের অনেক ইতিহাস। সাংবাদিক রহমান মাহবুব বলেন, করোনাকালে তাঁরা চেষ্টা করেছেন বিপদগ্রস্ত মানুষের উপকারে আসে এমন সংবাদ পরিবেশন করতে।

সাংবাদিক মনিজা রহমান বলেন, নিউইয়র্কে করোনার সংক্রমণের প্রথম ধাক্কাটা ভয়ংকর ছিল। সরকার, প্রশাসন কারও কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। এমন অবস্থায় প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা একটি টিম হিসেবে সংবাদপত্রের সঠিক ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করেছে। নিউইয়র্কে নিজের পেশা সামাল দিয়ে, করোনার কঠিন সময়ে পরিবার সামলে সাংবাদিকতা করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি। লেখক শেলী জামান খান বলেন, নিজে করোনায় অসুস্থতার সময়েও লিখেছেন। তথ্যের সংযোগের এ কাজে যুক্ত থেকে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছেন।

লেখক, সাংবাদিক রওশন হক বলেন, নিউইয়র্কের জরুরিকর্মী হিসেবে করোনার কঠিন সময়েও তাঁকে কাজে যেতে হয়েছে। লকডাউনের ভুতুড়ে নগরে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে একাধিকবার বিপাকে পড়েছেন। সাংবাদিক রোকেয়া দীপা বলেন, নগরের ম্যানহাটনের পাশ ঘিরে স্ট্যাটেন আইল্যান্ডে অবস্থান করে এ দ্বীপের সব সংবাদ রাখার চেষ্টা করেছেন লকডাউনের কঠিন সময়ে। নিজে কতটা সংবাদকর্মী হতে পেরেছেন, এ নিয়ে তাঁর বলার কিছু না থাকলেও প্রথম আলোর প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা জানান।

অনুষ্ঠানে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন এক অতিথি। ছবি: প্রথম আলো
অনুষ্ঠানে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন এক অতিথি। ছবি: প্রথম আলো

সাংবাদিক তোফাজ্জল লিটন বলেন, করোনায় বাংলাদেশির মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকলে তিনি এ নিয়ে আর রিপোর্ট করতে পারছিলেন না। মানবিক এ বিপর্যয়ের সংবাদে বিচলিত হয়ে তিনি নিউইয়র্কের নাগরিক সহযোগিতা, সরকারি প্রণোদনা—এসব নিয়ে সংবাদ করেন।

নাগরিক সংগঠক সৈয়দ উতবা জানালেন, তিনি করোনা আক্রান্ত মানুষের বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দিয়েছেন। প্রতিদিন প্রথম আলোর সংবাদের জন্য অপেক্ষা করেছেন। মূলধারার সংবাদও বাংলাভাষী পাঠকের উপযোগী করে উপস্থাপন করেছে প্রথম আলো। করনাকালেপ্রথম আলো যে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে, তার একটা গ্রন্থিত রূপ দিতে তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান।

বিদুষী নারী রাজিয়া উদ্দিন প্রথম আলোর লেখক ও সাংবাদিকদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে মিশিগান থেকে ওয়াশিংটন সফরের স্মৃতি নিয়ে কথা বলেন। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে স্বদেশিদের প্রতিবাদ সমাবেশে বাংলাদেশের পতাকা হাতে বিক্ষোভের স্মৃতিকে জীবনের সেরা স্মৃতি হিসেবে উল্লেখ করেন।

ড. ন্যান্সি উদ্দিন বলেন, আমেরিকায় বাংলাদেশিদের অভিবাসনের ইতিহাসের সঙ্গে নিজের পরিবারের ইতিহাস মিশে আছে। ১৯৩০–এর দশকে তাঁর বাবা জাহাজ থেকে নেমে আমেরিকার জনপদে নিজের জীবনের নোঙর করেছিলেন। তাঁর বাবা দেশে গিয়ে বিয়ে করে স্ত্রীকে আমেরিকায় আনতে অপেক্ষা করতে হয়েছে কয়েক যুগ। আমেরিকার বর্ণবাদ, বৈষম্য আর আজকের ‘ব্ল্যাক লাইভস মেটার’ আন্দোলন—সবই এক সূত্রে বাঁধা।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মনজুরুল হক, সানজিদা উর্মি, মুক্তিযোদ্ধা আখলাসুর রহমান, আবু চৌধুরী প্রমুখ।