অপরাধীকে বাাঁচাতে ক্ষমতার অপব্যবহার ট্রাম্পের

রজার স্টোন
রজার স্টোন

মার্কিন সংবিধানে প্রেসিডেন্টকে দেওয়া অসীম ক্ষমতার সবটুকুই নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। বিখ্যাত মামলায় আদালতে অপরাধী সাব্যস্ত রক্ষণশীল রাজনৈতিক কুশীলব রোজার স্টোনকে দণ্ড ভোগ করা থেকে মুক্তি দিয়েছেন।

১০ জুলাই হোয়াইট হাউস থেকে এমন ঘোষণার পর আমেরিকাজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। রোজার স্টোনের তিন বছরের বেশি কারাদণ্ড শুরু হওয়ার কথা ছিল এ সপ্তাহ থেকেই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুকে রক্ষার জন্য সংবিধানের সর্বোচ্চ ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন।

প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আমল থেকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকানদের পক্ষে ভূমিকা রেখেছেন রোজার স্টোন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাচনে নানা কারসাজিতে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। গত বছর কংগ্রেসের শুনানিতে মিথ্যা বলা, নথিপত্রের সাক্ষ্য নষ্ট করা এবং বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার দায়ে মামলায় তাঁকে ৪০ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আসছে মঙ্গলবার জর্জিয়ার কারাফটকে দণ্ড ভোগের জন্য তাঁর রিপোর্ট করার কথা ছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগের কারণে তাঁকে আর কারা ফটকে রিপোর্ট করতে হচ্ছে না।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের বন্ধু রোজার স্টোনকে আমেরিকার রাজনীতিতে ধূর্ত এক কুশীলব মনে করা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করছেন, রোজার স্টোন প্রসিকিউটরদের ঈর্ষার শিকার হয়েছেন। ২০১৬ সালে তাঁর নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে তদন্ত করা প্রসিকিউটর ঈর্ষাকাতর হয়ে স্টোনকে এমন দণ্ডের মুখে ফেলেছেন।

ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক উত্তাপে রোজার স্টোন ইস্যু নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ থকে অভিযোগ করা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের স্বজনদের রক্ষা করার জন্য বিচার বিভাগের ওপর খবরদারি করতে শুরু করেছেন। সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা সিনেটর চার্লস শুমার বলেন, ন্যায়বিচারের জন্য আমেরিকার আদর্শবাদ আবারও একজন আইনের তোয়াক্কা না করা একজন প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে ভূলুণ্ঠিত হলো। তিনি অভিযোগ করেন, প্রেসিডেন্ট তার ব্যক্তিগত স্বার্থে বিচার বিভাগকে অবদমিত করলেন।

একজন ব্যক্তি জুরি বোর্ডের রায়ে দণ্ডিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপে মুক্ত হওয়ার ঘটনাকে নজিরবিহীন দুর্নীতি বলে উল্লেখ করেছেন রিপাবলিকান দলের সিনেটর মিট রমনি। নিজ দলের একজন আইন প্রণেতার এমন প্রকাশ্য সমালোচনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত হচ্ছে।

শুধু রোজার স্টোনই নন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর বেশ কিছু দণ্ডপ্রাপ্তকে মুক্তি দিয়েছেন। সংবিধানে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেওয়া অপরিসীম ক্ষমতার নগ্ন ব্যবহার করে বিতর্কিত এসব ব্যক্তিকে ক্ষমা ঘোষণা সব সময়েই সমালোচিত হয়েছে। আমেরিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে কোন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতার এমন নগ্ন ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

২০১৭ সালে বর্ণ বৈষম্যের মামলায় আদালতে দণ্ডিত জো এপ্রাওকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বলে ক্ষমা ঘোষণা করেন ট্রাম্প। ২০১৮ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ প্রশাসনের কর্মকর্তা স্কুটার লিবিও বিচারিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার জন্য দণ্ডিত হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্টের ক্ষমায় তিনিও দণ্ড থেকে মুক্তি পান। নির্বাচনী তহবিলে অবৈধ লেনদেনে দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত ডিনেশ ডিসুজারও দণ্ড মওকুফ করে দেন ট্রাম্প।

আমেরিকার গত নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে তদন্তকারী স্পেশাল কাউন্সিল রবার্ট মুলার ওয়াশিংটন পোস্ট–এ লেখা এক কলামে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দণ্ড থেকে রেহাই দিলেও রোজার স্টোন যথার্থই আদালতে একজন দণ্ডিত ব্যক্তি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই হস্তক্ষেপে রোজার স্টোন যে নিরপরাধ নন, সে কথাই বলেছেন রবার্ট মুলার।

স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্প অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর শামিল কাজ করেছেন। কংগ্রেস এ নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেবে, যাতে কোন প্রেসিডেন্ট অপরাধীকে ঢালাওভাবে ক্ষমা করে দেওয়া বা দণ্ড মওকুফ করতে না পারেন।

আমেরিকার সংবিধানে প্রেসিডেন্টকে কোন অপরাধীর দণ্ড সম্পূর্ণ মওকুফ করে দেওয়া বা কমিয়ে দেওয়ার একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া আছে। আমেরিকার অন্যান্য প্রেসিডেন্ট বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এ ক্ষমতার ব্যবহার করেছেন। যৌক্তিক কারণ সৃষ্টি হওয়ায় কখনই বিষয়টি নিয়ে আমেরিকার সাম্প্রতিক রাজনীতিতে তীব্র কোন বিতর্ক হয়নি। ট্রাম্প নগ্নভাবে একের পর ক্ষমতার ব্যবহার করায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কংগ্রেসে ইন্টেলিজেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডাম সচিফ বলেছেন, ট্রাম্পের বার্তা হচ্ছে, তুমি যদি মিথ্যে বলো, যদি প্রেসিডেন্টকে সামাল দাও, তুমি তাঁর কাছ থেকে সব পেয়ে যাবে। ট্রাম্পের কাছে দুই নীতি। সবার জন্য এক এবং ট্রাম্পের দুর্নীতিবাজদের জন্য আরেক।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন ক্ষমতার আর যাতে অপব্যবহার না করতে পারেন, সে জন্য ২০১৯ সালে কংগ্রেসে অ্যাডাম সচিফ ‘অ্যাবিউজ অফ দা পার্ডন প্রিভেনশন অ্যাক্ট’ উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি কংগ্রেস সদস্যদের এ আইন প্রস্তাব নিয়ে দ্রুত সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এই প্রস্তাবে আদালতে দণ্ডপ্রাপ্তির পর প্রেসিডেন্টের ঢালাও ক্ষমা প্রদর্শন বা দণ্ড লঘু করার ওপর কিছু শর্ত আরোপের কথা বলা আছে।