ফাহিম সালেহকে হত্যার পর পার্টি করার পরিকল্পনা ছিল হ্যাসপিলের

ফাহিম সালেহ। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
ফাহিম সালেহ। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

শোক আর ভালোবাসায় নিউইয়র্কের লোকজন স্মরণ করছেন মাত্র ৩৩ বছরে সাফল্যে চূড়ায় পৌঁছানো বাংলাদেশি তরুণ ফাহিম সালেহকে। বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ (৩৩) হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল ম্যানহাটানের ইস্ট ২৬৫ হাউস্টন স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে ফুল আর শোকের বার্তা দিয়ে লোকজন স্মরণ করছেন তাঁকে। ক্ষণজন্মা ফাহিম সালেহ যে ভবনে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে বিলাপ করছেন কেউ কেউ। পশ্চিমা লোকজন শোকের অভিব্যক্তি নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে চোখ ভেজাচ্ছে। এদিকে ফাহিম সালেহকে হত্যার দুদিন পরই গ্রেপ্তার হ্যাসপিলের পার্টি করার পরিকল্পনা ছিল বলে জানা গেছে।

ফাহিম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার সন্দেহভাজন টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিলকে জামিন না দিয়ে ১৭ জুলাই মধ্যরাতের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ১৮ জুলাই হ্যাসপিলের আইনজীবী স্যাম রবার্টস এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা সত্য ঘটনার খুবই প্রারম্ভিক অবস্থায়। এ মামলা দীর্ঘ এবং জটিল হবে।’ টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিলের আইনজীবী জনসাধারণকে এ নিয়ে মন খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। এ মামলা একজনের গ্রেপ্তার ও অভিযোগের চেয়ে আরও বিস্তৃত বলে টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিলের আইনজীবী অ্যাটর্নি রবার্টস তাঁর বিবৃতিতে উল্লেখ করেন।

ফাহিম সালেহর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ না করার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ১৮ জুলাই একটি বিবৃতি প্রদান করা হয়েছে। এ বিবৃতিতে পরিবারের পক্ষ থেকে ফাহিম সালেহর প্রতি যে ভালোবাসা এবং এ সময়ে তাঁদের পাশে থাকার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। সবার ভালোবাসা পরিবারের কাছে পৌঁছেছে এবং কঠিন এ সময়ে এমন প্রতিক্রিয়া পরিবারকে সাহস জুগিয়েছে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

ফাহিম সালেহর পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা জানি সবাই আমাদের পক্ষ থেকে কিছু জানতে চাচ্ছে। পরিবার এ কঠিন সময়ে এবং দুঃখজনক সাম্প্রতিক ঘটনায় ফাহিম সালেহর পরিবারের সদস্যদের নিজেদের মধ্যে থাকার ইচ্ছাকে সবাই সম্মান দেখাবেন।’ পরিবারের পক্ষ থেকে এনওয়াইপিডির সদস্যদের ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।

ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর জন্য প্রার্থনা করছেন এই আমেরিকান। ছবি: হৃদয় অনির্বাণ খন্দকার
ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর জন্য প্রার্থনা করছেন এই আমেরিকান। ছবি: হৃদয় অনির্বাণ খন্দকার

ফাহিম সালেহর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর মরদেহ সমাহিত করার ব্যাপারেও বিস্তারিত কোনো কিছু জানানো হয়নি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ সপ্তাহান্তেই সীমিত পারিবারিক আয়োজনে ফাহিম সালেহর মরদেহ সমাহিত করা হবে। জানাজা ও সমাহিত করার সময় আমন্ত্রিত লোকজনই যোগ দিতে পারবেন। সংবাদমাধ্যমসহ সবাইকে পরিবারের ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সম্মান করা এবং শোকের এ সময় কাটিয়ে ওঠার সুযোগ দেওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানানো হয়েছে।

১৮ জুলাই ইস্ট হাউস্টন স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, লোকজন আসছে। বাংলাদেশি কাউকে দেখা না গেলেও বেশ কিছু বিদেশিকে দেখা গেছে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে। একে একে লোকজন আসছেন। কেউ হাত জোড় করে মুহূর্তের নীরবতা পালন করছেন। ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়ে যাওয়ার পথে কথা বলার চেষ্টা করা হয় একজন বিদেশির সঙ্গে। করোনাভাইরাস সতর্কতার জন্য মাস্ক পরা লোকটি শুধু উচ্চারণ করলেন, ‘ইট ইজ স্যাড! ইট ইজ স্যাড!’

ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে ফুল আর শোকের বার্তা দিয়ে আমেরিকার মানুষ স্মরণ করছেন তাঁকে। ছবি: হৃদয় অনির্বাণ খন্দকার
ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে ফুল আর শোকের বার্তা দিয়ে আমেরিকার মানুষ স্মরণ করছেন তাঁকে। ছবি: হৃদয় অনির্বাণ খন্দকার

এদিকে ফাহিম সালেহর হত্যায় জড়িত ২১ বছরের তরুণ হ্যাসপিল সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। ফাহিম সালেহকে হত্যার দুদিন পরই পার্টি করার জন্য বেলুন কিনেছেন হ্যাসপিল। নিউইয়র্ক পুলিশের কাছে আসা ভিডিও চিত্রে দেখা যাচ্ছে, ইস্ট হাউস্টন স্ট্রিটের প্রায় এক মাইলের কম দূরত্বের ক্রসবি স্ট্রিটের একটি অ্যাপার্টমেন্টের সামনে তিনি বেলুন ধরে আছেন। তাঁর সঙ্গে একজন নারীকেও দেখা গেছে। বড় আকারের পার্টি বেলুনটি কিনতে ফাহিম সালেহর ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। ব্রুকলিনে বসবাস করা হ্যাসপিল এয়ারবিএনবি থেকে ক্রসবি স্ট্রিটের অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট কয়েক দিনের জন্য ভাড়া করেন। হ্যাসপিল যখন পার্টি বেলুন কেনাকাটা করছেন, অদূরেই নিউইয়র্ক পুলিশ ফাহিম সালেহর খুনিকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল।

নিউইয়র্ক পোস্টকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা হ্যাসপিলকে ‘নিউ আমেরিকান সাইকো (মনোবিকারী)’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ফাহিম সালেহকে হত্যার পরও তাঁর ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছিলেন হ্যাসপিল। ক্রেডিট কার্ড দিয়ে উবার পরিবহনের ভাড়া মিটিয়েছেন হোম ডিপোট নামের দোকানে ইলেকট্রিক করাত কেনার জন্য যাওয়া–আসার সময়। ক্রেডিট কার্ডের সূত্র ধরেই পুলিশ তাঁকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয় এবং ১৭ জুলাই সকালে ক্রসবি স্ট্রিটের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

ফুলে ফুলে ভরে গেছে ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে। ছবি: হৃদয় অনির্বাণ খন্দকার
ফুলে ফুলে ভরে গেছে ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে। ছবি: হৃদয় অনির্বাণ খন্দকার

১৪ জুলাই বিকেলে নিউইয়র্ক নগরের ম্যানহাটানে নিজ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ফাহিম সালেহর খণ্ড খণ্ড মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। শুরুতে এই হত্যাকাণ্ডকে চরম পেশাদার কোনো খুনির কাজ বলে ধারণা করা হয়। ঘটনার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ঘাতককে গ্রেপ্তার করে নিউইয়র্ক পুলিশ। ফাহিম সালেহর সাবেক ব্যক্তিগত নির্বাহী মাত্র ২১ বছরের টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিলকে পুলিশ ১৭ জুলাই সকালে গ্রেপ্তার করে।

১৭ জুলাই মধ্য রাতের কিছু পরে পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তার সন্দেহভাজন খুনি টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিলকে ম্যানহাটানের ফেডারেল আদালতে হাজির করানো হয়। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে নিউইয়র্কের আদালতে ভার্চ্যুয়াল শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ম্যানহাটানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি লিন্ডা ফোর্ড সন্দেহভাজন খুনি টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিলকে আদালতে উপস্থাপন করে বলেন, হোমডিপো নামের দোকান থেকে হ্যাসপিলের কেনা ইলেকট্রিক করাত ও ধোয়ামোছার সরঞ্জামাদি ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া গেছে।

অ্যাটর্নি লিন্ডা ফোর্ড ভিডিও কনফারেন্সে আদালতকে বলেন, সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিওতে দেখা যাওয়া সন্দেহভাজন খুনির পোশাক টাইরেস হ্যাসপিলের ব্রুকলিনের বাড়িতে পাওয়া গেছে। টাইরেস হ্যাসপিল তরুণ প্রযুক্তিবিদ ফাহিম সালেহর অন্তত ৯০ হাজার ডলার চুরি করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ বা আইনি আশ্রয়ে না গিয়ে সালেহ কিস্তিতে অর্থ ফেরত দেওয়ার সুবিধা করে দিয়েছিলেন।

ফাহিম সালেহ হত্যায় গ্রেপ্তার হওয়া টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিল। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া
ফাহিম সালেহ হত্যায় গ্রেপ্তার হওয়া টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিল। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

প্রসিকিউশন এখনো এই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত নন। ধারণা করা হচ্ছে, অর্থের লেনদেন এবং ব্যক্তিগত বিষয়ই এই হত্যাকাণ্ডের কারণ। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হ্যাসপিল কোনো অর্থ ফেরত দিয়েছেন কি না, সেটি তাঁরা খতিয়ে দেখছেন। এ দেনাই খুন করার জন্য তাঁকে প্ররোচিত করেছে কি না, অর্থ ফেরত প্রদানে অনিচ্ছুক হলে পুলিশে রিপোর্ট হওয়ার ভয়ে এমন করেছে কি না, তা–ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

বিচারক জোনাথন সভেটকি জামিনের সুবিধা ছাড়াই হ্যাসপিলকে আটক রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মাত্রার খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে। নিউইয়র্কের আইনে প্রথম মাত্রা বা দ্বিতীয় মাত্রার হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ দণ্ড সমান। আদালতে অপরাধ প্রমাণিত হলে, সর্বনিম্ন ১৫ বছর থেকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ডে প্যারোল বা প্যারোলবিহীন দণ্ড আরোপ করা হতে পারে।

ফাহিম সালেহর হত্যাকাণ্ডে টাইরেস হ্যাসপিলকে গ্রেপ্তার করা হলেও হ্যাসপিল মুখ খুলছেন না বলে জানা গেছে। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, পুরো মামলার তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। এর মধ্যে হ্যাসপিলের আইনজীবীর ইঙ্গিতপূর্ণ বিবৃতি অনেককেই জিজ্ঞাসু করে তুলেছে। আগামী ১৭ আগস্ট হ্যাসপিলকে আবার আদালতে হাজির করা হবে।