হ্যাসপিল এক স্বপ্নের হন্তারক

ফাহিম সালেহ ও টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিল
ফাহিম সালেহ ও টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিল

বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা তরুণ উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ (৩৩) হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সন্দেহভাজন খুনিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছেন পুলিশ প্রশাসন। সন্দেহভাজন ব্যক্তি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোন সিরিয়াল কিলার নন, তারই ব্যক্তিগত সহকারী টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিল। ব্যাক্তিগত আর্থিক দেনা-পাওনার কারণে ফাহিমকে হত্যা করে দেহকে টুকরো টুকরো করে। কী ভয়ংকর নির্মমতার প্রকাশ! আমেরিকার ইতিহাসে এমন ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড এটাই প্রথম বললে ভুল হবে। তবে, ফাহিম হত্যা নিয়ে এবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে, তা বেশ লক্ষণীয়। 

প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন কিছু শুরু করা ছিল ফাহিম সালেহর স্বপ্ন। পনেরো-ষোলো বছর বয়স থেকেই তিনি আমেরিকায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজ শুরু করেন। ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে আমেরিকার বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফাহিম পেশায় ওয়েবসাইট ডেভেলপার হলেও গণমাধ্যমে তিনি 'টেক মিলিয়নিয়ার' হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা। তরুণদের জন্য তিনি সালেহআইকনডুড ডটকম এবং এআইএমডুড নামক ওয়েবসাইট তৈরি করেছিলেন। অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল গ্লোবালেরও একজন উদ্যোক্তা ছিলেন ফাহিম। পাঠাও ছাড়াও নাইজেরিয়াতে 'গোকাডা' নামে আরেকটি রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম চালু করেছিলেন ফাহিম সালেহ। কলম্বিয়াতেও নানা ধরনের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন তিনি।
কৃষ্ণাঙ্গ হ্যাসপিলের ফাহিম সালেহর মতো একজন তরুণ মেধাবীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বিরূপ মনোভাব উঠে আসছে। কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি কারও কারও বিরূপ মন্তব্য খুবই ন্যক্কারজনক। এখানে একটু ইতিহাস টানা দরকার। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর মিশিগান মার্ক ডেভিড লাতুনস্কি নামে ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি তার নিজ বাড়িতে ২৫ বছর বয়সী কেভিন বেকনকে খুন করে তার বিকৃত নগ্ন দেহটি ঘরের ছাদে ঝুলিয়ে রেখেছিল। এবং সেই দেহটি থেকে ছুরি দিয়ে মাংস কেটেও খেয়েছেন বলে স্বীকার করেছিলেন। বর্ণ, ধর্ম ভেদে সর্বত্র এমন রহস্যজনক মর্মান্তিক খুন হচ্ছে। এখানে কেবল একটি ঘটনায় পুরো গোত্রকে নির্ধারণ করে বিচার-বিবেচনার কোন প্রয়োজন দেখছি না।
খুব অল্প সময়ে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া ফাহিমের নিষ্ঠুর হত্যাকারী টাইরেস ডেভোঁ হ্যাসপিলের (২১) বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মাত্রার (সেকেন্ড ডিগ্রি) হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়েছে। এখানে কিছু বিতর্ক রয়েছে। ফার্স্ট ডিগ্রি বা প্রথম মাত্রার হত্যা হলো পূর্বপরিকল্পিত উদ্দেশ্যমূলক হত্যা, যাতে কোন ব্যক্তির মৃত্যুকে নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা আগে থেকেই পরিকল্পনা করা হয়। একে 'শীতল রক্ত হত্যা' হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। আর দ্বিতীয় ডিগ্রি হত্যার জন্য কেবল অভিপ্রায় প্রয়োজন; অর্থাৎ আকস্মিক বিরক্তি ক্ষোভ উত্তেজনার ফলে আমন্ত্রণত্মক আঘাতে কাউকে হত্যা করা। ফাহিমের মৃত্যু নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জামাদি জোগান দিয়েই যেহেতু হত্যা করা হয়েছে, তাই এটা পূর্বপরিকল্পিত হত্যা এবং এতে আসামি হ্যাসপিলকে ফার্স্ট ডিগ্রি হত্যার আওতায় নেওয়া হয়নি কেন, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে।
উল্লেখ্য, আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের ফার্স্ট ডিগ্রি ও সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের বিষয়গুলো নির্ভর করে কীভাবে এই ডিগ্রিগুলো এখতিয়ারের নির্দিষ্ট আইন দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা হয়, তার ওপর। নিউইয়র্ক স্টেটে প্রথম মাত্রার খুনের ও দ্বিতীয় মাত্রার সাজা সমান। দুটি অভিযোগই এ-১ ফেলোনি। প্রথম মাত্রার হত্যার অভিযোগ শুধু পুলিশ, দমকল কর্মী ও শান্তিরক্ষী কর্মকর্তা হত্যা করলে আনা হয়। বেসামরিক ব্যক্তি খুন হলে সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দ্বিতীয় মাত্রার অভিযোগ আনা হয়।

তবে কারণ যাই থাকুক, কোন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ এবং এই অপরাধের ন্যায় বিচারে আমরা আসামির শাস্তি কামনা করব। বিচার না পেলে বিক্ষোভ করব, এটাই স্বাভাবিক। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের দৃষ্টিকোণ এখানেই সীমাবদ্ধ নাও হতে পারে। তবে, একজন মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েও লাফঝাপ করা কতটা সমীচীন, তা বিবেচনার বিষয়। খুনির বিচার আশা করব, কারণ সে অপরাধী, কৃষ্ণাঙ্গ বলে নয়। এখানে বর্ণবৈষম্য যোগ করার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।