ফাহিম সালেহ হত্যায় শোকাহত বাংলাদেশি-আমেরিকান তরুণেরা

নিহত ফাহিম সালেহ। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া
নিহত ফাহিম সালেহ। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে নেওয়া

বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাহিম সালেহ হত্যার ঘটনায় শোকাহত বাংলাদেশি-আমেরিকান তরুণেরা। শুধু ‘পাঠাও’ নয়, একই ভাবনায় প্রতিষ্ঠিত নাইজেরিয়ায় রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ‘গোকাডা’র প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ছিলেন ফাহিম সালেহ। ১৪ জুলাই বিকেলে নিউইয়র্ক নগরের ম্যানহাটনে নিজ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ফাহিম সালেহর মরদেহের খণ্ড খণ্ড টুকরো উদ্ধার করে পুলিশ।

নিউইয়র্কে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নৃশংসভাবে খুন হওয়া ফাহিম সালেহ নিজের সম্পর্কে ওয়েবসাইটে লিখেছিলেন উদ্যোক্তা, ইনভেস্টর, ড্রিমার ও স্বপ্নবাজ। অথচ মাত্র ৩৩ বছরেই তাঁর সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। তাঁকে যারা অনুসরণ করত, তাদের স্বপ্নও ভেঙে গেছে। ১৫ বছরেই তিনি উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছেন। অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর হাতে গড়ে উঠেছে একাধিক সফল প্রতিষ্ঠান।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) বলছে, ফাহিম সালেহর মৃত্যুতে দেশের আইটি ইন্ডাস্ট্রি কেবল একজন সফল উদ্যোক্তাকে হারায়নি, বরং দেশের তরুণ স্টার্টআপ উদ্যোক্তারা হারালেন একজন অন্যতম অনুপ্রেরণাদাতা ও পথপ্রদর্শককে।

২৪ বছরের ইয়ামিন আহমেদ একজন অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বলেন, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে বাংলাদেশ ও নাইজেরিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ফাহিম সালেহর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুই কাম্য নয়। ফাহিমের মতো একজনের অকস্মাৎ প্রস্থানের কারণে শুধু পরিবার আর সমাজ নয়, পুরো জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো। ফাহিম হত্যাকাণ্ড সমাজব্যবস্থার চূড়ান্ত অবক্ষয়ের আরও একটি চিহ্ন হয়ে থাকল।’

ইশরা চৌধুরী তথ্যপ্রযুক্তি মেজর নিয়ে পড়াশোনা করছেন রাটগার্টস বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর মতে, ‘ফাহিম সালেহর মর্মান্তিক মৃত্যু বাংলাদেশি তরুণদের হৃদয়ে করুণ ছাপ ফেলেছে। একজন সফল তরুণকে খুব তাড়াতাড়ি চলে যেতে হলো! মিলিয়নিয়ার হিসেবে তিনি এই প্রজন্মের বাংলাদেশি তরুণদের রোল মডেলে হয়ে ছিলেন এবং বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে চিহ্নিত করতে শুরু করেছিলেন। ২১ বছর বয়সী তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিল তাঁকে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ। তাঁর মৃত্যু আমাদের হৃদয়ে ভয় জাগিয়ে তোলে, যদি আমাদের কাছের কেউ এমন কিছু করে। উদ্দেশ্য যা–ই হোক না কেন, বেশির ভাগ কলেজশিক্ষার্থীরা বিশ্বাস করেন, কোনো বাঙালিকে উন্নয়নশীল বিশ্ব একজন এলন মাস্কের মতো এতটা উন্নতির শিখরে কেউ যেন দেখতে চায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফাহিম সালেহ আমাদের অনেকের জন্য আয়নার মতো একটা সফল পথ প্রশস্ত করেছিলেন। তিনি তাঁর চারপাশের লোকদের যে সাফল্য এবং সহায়তা দিয়েছিলেন, তা সত্যই অনুপ্রেরণার। আজ তাঁর মৃত্যুতে আমাদের কমিউনিটি শোকে মুহ্যমান। আমাদের উচিত তাঁর উত্তরাধিকারকে সম্মান করা এবং বিশ্বকে আরও ভালো স্থানে নিতে আমাদের মনকে সচল রাখা।’

জন জে কলেজের শিক্ষার্থী ফারজানা তাহমিমা নিজেকে বাঙালি বলতে খুব গর্ববোধ করেন। তিনি বলেন, ‘জীবনে একটি আশা নিয়ে এই দেশে আগমন ঘটে আমার। বলতে পারেন কিছু মানুষকে অনুসরণ করেই এত দূর আসতে পারা। এই দেশের মাটিতে একজন বাঙালি কত–কী করতে পারে, তার সম্পর্কে কারও ধারণা নেই। কিন্তু একজন আমাদের এই প্রজন্মের মানুষদের আশার আলো দেখিয়েছেন। তিনি আর কেউ নন, আমাদের ফাহিম সালেহ। উনি আমাদের পথ দেখিয়েছেন উন্নতির নগরে। কিন্তু এভাবে ওনাকে হারিয়ে ফেলব, তা কখনো বুঝতে পারিনি। তাঁর এই হারিয়ে যাওয়ার গল্প সবার মনে যেন ভীতির সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ হারিয়েছে একটি মূল্যবান সম্পদ। তিনি ভেবেছিলেন বাঙালিদের নিয়ে, তিনি ভেবেছিলেন আমাদের নিয়ে। তাঁর কোটি সমর্থকের মধ্যে আমি একজন ছিলাম। তাঁর চলে যাওয়া মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে।’

২২ বছরের সামিহা সাজেদ আইটি প্রোগ্রামার। তিনি ব্লুমবার্গে কাজ করেন। ফাহিম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইয়াং স্টার বিজনেসম্যান ফাহিম সালেহকে আমি ইনস্টাগ্রামে সব সময় ফলো করতাম। তিনি আমাদের জেনারেশনের স্বপ্নের নায়ক ছিলেন। তাঁর চিন্তাভাবনায় সব সময় তরুণ প্রজন্মের হয়ে তরুণদের সম্পৃক্ত করে কাজ করার তাড়না ছিল। তাঁর সব কাজেই তরুণ প্রজন্ম রয়েছেন। বাংলাদেশে পাঠাও অ্যাপের মাধ্যমে হাজারো তরুণ বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছে। তিনি বিল গেটস হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তাঁকে এভাবে হত্যা করা হলো, যা খুবই নিন্দনীয়। তাঁর হত্যাকারী সন্দেহ যাকে গ্রেপ্তার করা হলো, তিনিও তরুণ। সেটা আরও হতাশাজনক। আমি এ ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। কাজে মন দিতে পারছি না।’

ফোর্ডহেম ইউনিভার্সিটিতে ডিজিটাল টেকনোলজি অ্যান্ড ইমার্জিং মিডিয়াতে পড়ছেন পূর্ণতা অন্যতমা হাসান। তিনি মনে করেন, এটি কোনো হেট ক্রাইম নয়। এনওয়াইপিডি ডিটেকটিভরা ইতিমধ্যে টাইরেস ডেঁভো হ্যাসপিলকে গ্রেপ্তার করেছে। আড়ালে থাকা সব বিষয় বের হয়ে আসবে। তবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সম্ভাবনাময় এই তরুণ উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ যে সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করতে যাচ্ছিলেন, তাঁর সে স্বপ্ন ও সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ করা হলো, এর জন্য তিনি তীব্র ঘৃণা জানান।

২৯ বছর বয়সী আইনজীবী অমিত ফারহান নূর বলেন, ‘ফাহিম সালেহকে আমি চিনি না। তাঁর মৃত্যুর খবর শোনার আগপর্যন্ত তাঁর সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। তাঁর জীবন সম্পর্কে এখন যতই পড়ছি এবং জানছি, ততই এই মেধাবী তরুণের অসাধারণ কাজ ও অর্জন আমাকে বিস্মিত করেছে। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন যে তাঁর ক্ষণজন্মা জীবনকালে অবিশ্বাস্য রকমের সাফল্য অর্জন করেছিলেন। আমাদের বাংলাদেশের জন্য ও নিউইয়র্কের অভিবাসী বাঙালিদের জন্য এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। এমন একজন মেধাবী, সম্ভাবনাময় মানুষকে হারানোর শোক ও ক্ষতি আমরা বহুদিন বয়ে বেড়াব। ফাহিমের মতো জিনিয়াস মানুষেরা সহসা জন্মায় না। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হোক, প্রকৃত অপরাধীর সাজা হোক, এটাই কাম্য। নিউইয়র্কের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে আশা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফাহিম সালেহের মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত। আসামিকে গ্রেপ্তার করে সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারে চার্জ করা হয়েছে। আশা করছি, শিগগির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁর শাস্তি কার্যকর করা হবে। আমরা ফাহিম সালেহর পরিবারের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি।’