যেমন আছেন নারীরা

নিউইয়র্কে প্রায় ৩০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই নগরের মানুষ করোনাকাল অতিক্রম করছেন। তাণ্ডব কমে গেছে এই নগরে। যদিও আমেরিকাজুড়ে এই ভাইরাস এখনো তাড়া করছে। বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসলেও নিউইয়র্ক এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। করোনার মধ্যে কেমন আছেন নিউইয়র্ক নগরের নারীরা—এ নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কথা হয় বেশ কয়েকজন নারীর সঙ্গে।
জাতিসংঘে কাজ করেন মুক্তি জহির। তিনি জানালেন এই করোনাকালীন সময়ের কথা। বললেন, শীতের কম্বল ঝেড়ে নিউইয়র্ক যখন বসন্তের উষ্ণতাকে আলিঙ্গনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, ঠিক সেই সময় করোনার ভয়াবহতায় আমরা স্তম্ভিত। আমাদের জীবনধারা বদলে যেতে লাগল। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে জাতিসংঘের মহাসচিবের নির্দেশ এল বাসা থেকে কাজ করার, সেই থেকে আজ অবধি বাসা থেকেই কাজ করছি।
মুক্তি বলেন, ডব্লিওএইচওর ঘোষণা এল গ্লোবাল মহামারি, দ্রুত বদলাতে থাকল দৃশ্যপট। এরপর লকডাউন, মৃত্যুর মিছিল, অসহায় নিউইয়র্কের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, নিউইয়র্ক পরিণত হলো কোভিড-১৯–এর কেন্দ্রস্থেলে। খুব যন্ত্রণাকাতর সেই শ্বাসরুদ্ধকর সময় পাড়ি দেওয়া সহজ ছিল না আমাদের জন্য। পরিবারের সবাই একসঙ্গে বাসায় আছি, কাউকেই বাইরে যেতে হচ্ছে না। ছেলে অগ্নি সেল্ফ–এপ্লয়েড, নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাজগুলো বাসা থেকেই করছিল শুরু থেকেই। বউমা ব্রিজিতও গ্র্যাজুয়েশনের শেষ ক্লাসগুলো অনলাইনে করছে, সেও ক্যাম্পাস ছেড়ে যোগ দিয়েছে আমাদের সঙ্গে। পরিবারের সবাই একসঙ্গে, এক ছাদের নিচে ২৪ ঘণ্টা থাকার অনুভূতি অথবা অভিজ্ঞতা যাই বলি না কেন, এই ক্রান্তিকালেই সম্ভব হয়েছিল। এটি একটি বিশাল পাওয়া, বিশেষ করে যারা পরিবারকেন্দ্রিক মানুষ তাদের জন্য।
জাতিসংঘে কর্মরত এই নারী বলেন, ছয় সদস্যের পরিবারের সবাই যখন বাসায়, তখন বাসার কাজগুলো বেড়ে দ্বিগুণ হল। মেয়েদের বেবি সিটারও আর আসছেন না। দিনে অফিসের কাজ, মিটিং নিয়ে আমরা দুজনই ব্যস্ত থাকি, মেয়েদের অনলাইন ক্লাসে সাহায্য করি। সবাই বসে মিটিং করি আর কাজ ভাগ করে নিই, বিশেষ করে রান্নার লিডটা একেকজন একেকদিন নেওয়ার জন্য একটি লিখিত শিডিউলও বানিয়ে ফেলি। ফলে কাজগুলো অনেকটা খেলার মতো আনন্দময় হয়ে ওঠে। সিদ্ধান্ত নিই, কোনো বাসী খাবার খাব না, রোজ রান্না, রোজ খাওয়া। বাইরের কোনো খাবারও খাব না। ছেলে আর বউমা নিরামিষভোজী, ওদের জন্য আমরাও নিরামিষভোজী হয়ে গেলাম। কারণ এক পদের রান্না হবে আর সবাই একসঙ্গে বসে রাতের খাবার খাব। এভাবে আমরা আমাদের একসঙ্গে কাটানো বন্দীজীবনে আরও অনেক কিছু সংযোজনের চেষ্টা করি। বৈচিত্র্যময় করে তোলার জন্য সবাই মিলে একসঙ্গে হাঁটতে যাওয়া, মুভি দেখা, মনোপলি, কেরাম খেলা ইত্যাদির আয়োজন করি।
পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিরাপদে একসঙ্গে আনন্দময় সময় কাটানো আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। শুধু এই একটি কারণে কোভিড–১৯ মহামারি একটি ভিন্ন অর্থ হয়ে থাকবে আমার জীবনে।
নিউইয়র্কের এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী প্রিয়াঙ্কা ভৌমিক করোনায় সময় কাটানো প্রসঙ্গে বলেন, আমার কাছে করোনার সময় আর অন্য সময়ের মধ্যে তেমন বেশি পার্থক্য মনে হয়নি। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে তেমন কিছুই পরিবর্তন হয়নি, যদিও কখনো কখনো তার স্বামীকে এ সময়ে অনেক বেশি সময় কাজ করতে হয়েছিল। পুলিশদের ১২, ১৬ কিংবা ১৮ ঘণ্টা কাজ নতুন কিছু নয়, এটা কম বেশি সবাই জানে। কিন্তু সবাই হয়তো এটা জানে না, এই দীর্ঘ সময় নিজের খুব কাছের ভালোবাসার মানুষটিকে চোখের সামনে না দেখতে পারার কষ্ট পরিবারের প্রতিটি সদস্য কীভাবে অনুশীলন করে নেয়।
প্রিয়াঙ্কা বলেন, হ্যাঁ, করোনার ভয়তো একটু ছিলই, অবশ্য থাকাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে করোনার থেকে বড় শত্রুর মুখোমুখি হতে হয় প্রতিনিয়ত। করোনা আক্রান্ত হলে একজন পুলিশ কর্মকর্তা হয়তো বেঁচে যাবে। কিন্তু যদি তাঁর মাথায় কিংবা বুকে গুলি লাগে, সে হয়তো বাঁচবে না। আর যদি বাঁচেও, তাকে হয়তো পঙ্গু হয়ে থাকতে হয়। তাই উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়েই আমাদের জীবন, সেটা করোনাকালীন হোক বা অন্য যেকোনো সময় হোক।
চিত্রশিল্পী ফারহানা ইয়াসমীন কীভাবে পার করছেন এই করোনাকালীন সময়, জানতে চাইলে বলেন, আমি ছোট্ট খুকি, প্রিয়ার প্রিয়া, সন্তানের মা, আমি নারী, নারী হয়ে জন্মানোর সুখ অনুভব করি। আমিও আর সব নারীর মতন।
ফারহানা বলেন, করোনার সময় লকডাউনে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি আমার ছবি আঁকায়। তবে বাইরের দুনিয়ার যে অবস্থা, তা অবশ্যই আমাকে প্রভাবিত করে। মানুষের মরণকে এত কাছ থেকে দেখা ও বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা, মৃত্যু ভয়ে লুকিয়ে থাকা আমাকে ভাবায়। আর চারপাশের এই অবস্থা ও অনুভূতি আমি আমার ছবিতে আঁকি। ছবির সঙ্গে এই বোঝাপড়া, টানাপোড়েন আমি সবার সঙ্গে শেয়ার করি। আমি চিত্রশিল্পী, তাই আমার প্রকাশ আলাদা সহজ সাবলীল।
এই চিত্রশিল্পী বলেন, টিভির খবরে শুধু মৃত্যুর কফিন লাশ আর লাশ। একজন মা জানে, মা হওয়া কত কষ্টের, কত আনন্দের। এই করোনাকালে অনেকেই মা হয়েছে ভীষণ মানসিক চাপ ও অনিশ্চয়তা নিয়ে। সদ্য জন্মানো সন্তান থেকে মাকে থাকতে হয়েছে আলাদা, মা ছুতে পারেনি তার সদ্য আনন্দকে। এসব আমার চিন্তা ভাবনাকে দিয়েছে নতুন গতি, আমি পেয়েছি নতুন পথের দিশা। আর আমি ছবি আঁকায় পেয়েছি নতুন নতুন প্রেরণা।
ফারহানা বলেন, আমার সকাল হতো পাখির গানে আলোর ছোঁয়ায়। আমি বাচ্চাদের স্কুলে রেখে এসে শুরু করতাম ছবি আঁকা। কিন্তু করোনার সময় আমরা থেকেছি সব সময় একসঙ্গে। আমরা আমাদের যেন আরও বেশি চেনা ও বোঝার সুযোগ পেয়েছি। স্কুলের মিস কেমন করে পড়ায়, কত যত্ন নেয়, তা দেখেছি। আমি যেন ফিরে গিয়েছি আমার শৈশবে।
এই নিউইয়র্কপ্রবাসী চিত্রশিল্পী বলেন, আমাদের সংসারে আমরা দুজনেই শিল্পী। এই প্রথম আমরা এত সময় একসঙ্গে থেকেছি, ছবি এঁকেছি। কখনো প্রেমালাপ করেছি। কখনো ভেবেছি ভবিষ্যতের ভাবনা। ভালোবাসায় জড়িয়েছি ছবির মাধ্যমে। অনেক অনেক ছবি এঁকেছি দুজনে মিলে। অনেক স্মৃতিচারণ করেছি। অনেক পুরোনো বন্ধুদের খোঁজ নিয়েছি। বাবা-মায়ের প্রতি আরও দায়িত্ববান হয়েছি। আমি রাঁধতে পছন্দ করি। আর তাই মাঝে মাঝে মাছ ভাজির মধ্যেও দেখি দারুণ দারুণ সব ছবি।