ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা জরুরি

ফাহিম সালেহ
ফাহিম সালেহ

মঙ্গলবার গভীর রাতে ঘুমানোর আগে ফেসবুকে প্রথম আলোর আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহীম চৌধুরীর স্ট্যাটাস দেখে আঁতকে উঠলাম। রাত বেশি হওয়ায় আর্টিকেলটি পড়িনি। লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড নিয়ে সকালে বাঙালি কমিউনিটির বিভিন্নজনের একের পর এক স্ট্যাটাস দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে, কী ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে গত রাতে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান টেক সিও ও মিলিয়নিয়ার ফাহিম সালেহ হত্যার বীভৎসতা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই। ছেলেটির মা-বাবার মনের কথা ভাবতে গিয়ে নিজেই মানসিকভাবে মুষড়ে পড়ি।

মাত্র এক সপ্তাহ আগে ‘করোনাকালে দুশ্চিন্তা’ নামে স্থানীয় একটি পত্রিকায় লিখতে গিয়ে আমার ছেলেদের প্রসঙ্গ চলে এসেছিল। ওয়েস্ট কোস্টের দুটি বড় শহরে তারা আলাদা ফ্ল্যাট নিয়ে একা থাকে। চারদিকে আইন-শৃঙ্খলার ভয়াবহ অবনতি ও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। একটা আতঙ্কে থাকতে হতো। অনেক বলার পরও তাদের চিন্তাভাবনার কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমেরিকান লাইফস্টাইল। যতটুকু পারি সতর্ক করি। বাবা হিসেবে ছেলেদের নিরাপত্তার ভাবনাটিই মাথায় থাকে সব সময়।

ফাহিম সালেহ আমার বড় ছেলের চেয়ে মাত্র তিন বছর এবং ছোট ছেলের চেয়ে সাত বছরের বড়। কী-বা বয়স এমন। আকাশছোঁয়া সাফল্য পেয়েছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও নিভৃতচারী বাঙালি এই যুবকের কথা আমরা কেউ জানতাম না। একমাত্র নিজের প্রতিভাগুণে এত বিপুল সম্পদের মালিক বনে যাওয়া কল্পনাকেও হার মানায়।

আমার ধারণা নেহাত কিছু সাধারণ নিয়মের অবহেলায় অপরাধের এই ভয়াবহ পরিবেশটা সৃষ্টি হয়েছে। শুধু প্রতিহিংসায় স্মার্ট ও তীক্ষ্ণ মেধাবী যুবকটির জীবনপ্রদীপ নিভে গেল অবেলায়। সেদিন তাঁর ওপর ভয়ানক প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে। জোরপূর্বক চিরতরে ফাহিমের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুনিয়া থেকেই অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হলো, যাতে কখনো সামনে এসে প্রতিবন্ধকতা হয়ে না দাঁড়ায়। কিন্তু কেন?

সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত শত্রুতারও জন্ম হয়। বন্ধুবান্ধব ও পার্টনার নির্বাচনে সতর্ক না হলে বিপদ অনিবার্য। সেগুলোর রূপ বিভিন্ন মুভিতে দেখি। তারই অনুকরণে বাস্তব প্রয়োগ দেখা যায় ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড গুলোয়। জন্মগতভাবে মানুষ স্বার্থপর। কিন্তু কর্মচারী দ্বারা এমন ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড কীভাবে সম্ভব হলো! হয়তো আরও অনেক কারণ লুকানো আছে, যা এখনো আমাদের অগোচরে।

ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম তাদের ধারণায়— ফাহিম সালেহের নির্মম ট্র্যাজেডিটি একটা সেট-আপ ছিল। এভরি থিং ইজ টু অ্যাকিউরেট। মাত্র একুশ বছরের ছেলেটি পেশাদার খুনির মতো এমন পৈশাচিক হত্যা করতে পারে না। মাফিয়াদের ট্র্যাপে নিজের অজান্তেই সে জড়িয়ে গেছে। সম্ভবত লং আইল্যান্ডের ভ্যালি স্ট্রিমের কোনো এক ফ্রস্টার কেয়ারে বড় হওয়া টাইরেস হ্যাসপেলের অতীত কোনো রেকর্ড নেই এমন অপরাধের। তাঁর বাবা মারা গেছেন বেশ আগে। মা মানসিক ভারসাম্যহীন। এমন পেশাদারি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আবার নিজেই নিখুঁত প্রমাণ রেখে গেল কীভাবে। ভাগ্যের জোরে ফাহিমের বোন বেঁচে গেলেন। খুনির জন্য অনায়াসে আরেকটি পৈশাচিক কোনো ব্যাপারই ছিল না। খুনের ধরন দেখে নিশ্চিত বলা যায় এটা কোনো সাধারণ হত্যাকাণ্ড ছিল না। আমেরিকান অথবা নাইজেরিয়ার কোনো কিলিং স্কোয়াড নির্ভুলভাবে টাইরেস হ্যাসপেলের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সফল করেছে। হত্যাকাণ্ডের আলামত অগোছালো ছিল না, যেমনটি সাধারণ খুনিরা করে থাকে। সবই পরিকল্পনামাফিক। আততায়ীকে ধরার জন্য প্রমাণগুলো বেশি মাত্রায় নির্ভুল। চালাক খুনি এত সহজ বোকামি করতে পারে না। ছেলেদের যুক্তির সঙ্গে একমত না হয়ে পারলাম না।

আমেরিকান ছেলেমেয়েরা খুব স্বাধীনচেতা। আমাদের বুঝতে চায় না। অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু বললেও বলবে, ‘তুমি রেসিস্ট’। ফাহিম তার সহকারী কালো ছেলেটিকে নিয়োগ দিয়েছে। ভালো কথা। হয়তো ওর পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড দেখার প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি। তার অ্যাসোসিয়েশন চেক করেনি। এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞ মানুষ এবং নিজের বাবা-মায়ের পরামর্শকে গুরুত্ব দিতে হয়। এত ধনসম্পদের মালিক অথচ ব্যক্তিগত নিরাপত্তার আধুনিক কৌশলগুলো অনুপস্থিত। চিন্তা ভাবনায় এই ভয়ানক শূন্যতা বোধগম্য হলো না। আত্মরক্ষার জন্য হয়তো তাঁর নিজস্ব কোনো পিস্তলও ছিল না। আমেরিকান ব্যবসায়ীদের সব সময় নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব বন্দুক রাখতে দেখেছি।

ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য আমাদের খুব আপনজন ও কাছের মানুষ দিনার চৌধুরীর কথা মনে আসছে। সেই নব্বই সাল থেকে পিস্তল রাখতে দেখেছি। তখন মাত্র একটা ডানকিন ডোনাটের মালিক ছিলেন তিনি। তারপর যখন ব্যবসার প্রসার হলো। নিজের নিরাপত্তা আরও জোরদার করলেন। ২০১৮ সালে আমরা দিনার ভাইয়ের গুলশানের বাসায় বেড়াতে গেলে নিরাপত্তার জন্য আমেরিকা থেকে নিয়ে আসা অটোমেটিক গান দেখে অবাক হয়ে যাই। আমাদের জানা ছিল না দিনার ভাই সেদিন ঢাকায়। খিলগাঁওয়ে আমার শ্বশুরবাড়ি 'সৈয়দ ক্যাসেল' ও দিনার ভাইয়ের বাবার বাসা 'রনকেলি হাউস' পাশাপাশি। সেই সুবাদে তাঁদের সঙ্গে আমাদের আন্তরিকতা অন্য এক উচ্চতায়। তাঁর ছোট বোন আমার গিন্নির ক্লাসমেট ও বান্ধবী। ভাবলাম যমুনা শপিং মলে শপিং শেষে গুলশানে তাঁদের দেখে খিলগাঁওয়ে ফিরব। এত দিন পর দেশে এসেছি। ফোন করতেই তাঁরা ডিরেকশন বলে দিলেন। পৌঁছে দেখি দিনার ভাই সেখানে। আমাদের খুব ভালো লাগল। অনেক আগেই গুলশানের একটা ফ্ল্যাট বোন কিনে নিয়েছেন দিনার ভাইয়ের কাছ থেকে। বাকিগুলো সম্ভবত বিক্রি করতেই আবার ঢাকায় এসেছেন। আমার মেয়ে তার দিনার মামাকে পেয়ে ভীষণ খুশি। এমনিতেই সে বোর হয়ে গিয়েছিল। তাদের পেয়ে সে গল্প জমিয়ে ফেলেছে। যেন সবাই আমেরিকায় তাদের লং আইল্যান্ডের বাসায় বসে গল্প করছি। হঠাৎ চোখে পড়ল ভেতরে অটোমেটিক গানের মতো একটা অস্ত্র নিয়ে সবাই ছবি তুলছে। দিনার ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে কি কোনো আর্মি থাকে?’

‘কেন? ও আচ্ছা, আমার অটোমেটিক গানটার জন্য? আমেরিকা থেকে নিরাপত্তার জন্য সাথে নিয়ে এসেছি।’ বোকার মতো বললাম, ‘আপনার এই ভারী অস্ত্র দেখে শাহজালাল বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন আটকায়নি?’ ‘কাগজপত্র থাকলে আটকাবে কেন?’ দিনার ভাইয়ের আত্মবিশ্বাসী স্ট্রেট ফরওয়ার্ড উত্তর, ‘আমি যখন ঢাকা শহরে বের হই। এই অটোমেটিক গানটি আমার সঙ্গে সব সময় থাকে। কারও সাহস হবে না আমাকে ঘাঁটায়।’
আমি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। দিনার ভাইকে জানি একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে। নিউইয়র্কের আপ স্টেটে বিশাল সম্পদের মালিক। নিজের ভূমি থেকে তেল উত্তোলন করে বিক্রি করেন আমেরিকানদের মতো। অনেকবার তাঁর এস্টেটে যেতে বলেছেন। দূর বলে যাওয়া হয়নি। পরিকল্পনা করেছি একবার দেখে আসব।

আমাদের সঙ্গে বড় ভাইয়ের ছেলেমেয়ে ও মুর্শেদ ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা ছিল। মুর্শেদ ভাই আমার প্রিয় বন্ধু। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সদস্য, বড় আমলা। লক্ষ্য করলাম, আমার মেয়ে দিনার ভাইয়ের অটোমেটিক গান নিয়ে র্যাম্বো স্টাইলে একের পর এক ছবি তুলছে। পরে সবাই একই ভঙ্গিমায় ছবি তুলল। সেদিন ভেবেছিলাম, দিনার ভাই নিজের জন্য একটু বেশি নিরাপত্তা নিয়ে ফেলেছেন।

আজ মনে হচ্ছে তিনি হাজারগুণ সঠিক ও দূরদর্শী ছিলেন। আমাদের মতো বোকামি কখনো করেন না। একজন স্মার্ট আমেরিকান বিজনেসম্যান।

ফাহিমের মৃত্যু অন্যান্য বাঙালিদের মতো আমাকেও ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছিল ছেলেটিকে ওর আত্মীয়স্বজন কেন আগেভাগেই সতর্ক করে দেননি। ইশ, যদি একটু সাবধান করে দিতেন। আমাদের গর্ব এই নক্ষত্রটি এখনো বেঁচে থাকত। তাঁকে দেখে অন্য যুবকেরা আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন মেতে উঠত। ফাহিম সালেহ তাদের ড্রাইভিং ফোর্স হতে পারত। সামান্য ভুলের জন্য অন্য একটি অপরিণামদর্শী দুষ্ট গ্রহ আমাদের উজ্জ্বল নক্ষত্রটিকে সূচনাতেই নিভিয়ে দিল। পরক্ষণেই মনে হলো নিয়তিকে কি কখনো খণ্ডানো যায়? ফাহিমের বাবা-মা কেমন করে মেনে নেবেন ছেলে হারানোর কষ্ট, যেখানে আমরা দূরের মানুষেরাই পারছি না।