জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও দমে যাননি ইমরান

ইমরান হোসেন
ইমরান হোসেন

উঁচু নিচু টিলা, চা বাগান আর আগর আতরের দেশ মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার তারাদরম গ্রামে জন্ম। সবুজবেষ্টিত একটা ছোট্ট গ্রামের একান্নবর্তী পরিবার থেকে বড় হওয়া। ক্রিকেট ব্যাট-বলকে নিত্যসঙ্গী করে প্রতিদিন ভরদুপুরে বাড়ির বিশাল পুকুরে সাঁতার কাটা আর দুরন্তপনার মধ্য দিয়েই শৈশব কেটেছে। দাদা হারিছ আলীর দান করা ভূমিতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত গ্রামের প্রথম প্রাইমারি স্কুল, সেখান থেকেই শিক্ষাজীবন শুরু। নিজের বাড়িটিই ছিল স্কুলের একটা অফিস কক্ষ, বাঁশের ভেড়া আর বাঁশ কাঠের তৈরি বেঞ্চ, বৃষ্টি আসলেই আবার নিজেদের বাড়িতেই গিয়ে ক্লাস করতে হত। সরকারিভাবে স্কুল নির্মাণের জন্য পঞ্চম শ্রেণিতে থাকাকালে খোলা আকাশের নিচে পড়েই মাধ্যমিক স্কুলে যেতে হয়েছিল। এভাবেই শৈশব কেটেছিল ইমরান হোসেনের।

বাবা ইসলাম উদ্দিন এবং মা সাহিদা বেগমের দুই ছেলে এবং এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় ইমরান হোসেন। তারাদরম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে পড়াশোনা করেন মুড়াউল উচ্চ বিদ্যালয়ে। বড়লেখা সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তারপর ভর্তি হন সিলেট মুরারি চাদ কলেজে গণিত বিভাগে। একই প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাস করে বের হন। এখন পড়াশোনা করছেন টেক্সাসে অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়-কমার্সে। একইসঙ্গে গণিত বিভাগে গ্র্যাজুয়েট টিচিং সহকারীর কাজও করছেন।

এ পর্যন্ত ইমরানের শিক্ষাজীবন সম্পর্কে পড়ে আরও আট/দশজনের মতে স্বাভাবিক মনে হতে পারে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজে পড়াশোনা করে আমেরিকায় শিক্ষার্থী ভিসা নিয়ে আসা ইমরানের পথটা এত সহজ ছিল না।

স্নাতক তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনার সময় থেকে যখন বন্ধুরা সবাই বিসিএস এবং অন্যান্য চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করছিল, তখনো তিনি ছিলেন অনেকটা অনিশ্চয়তায়। আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার জন্য যে জিআরই প্রয়োজন, তখন তিনি এটাই তিনি জানতেন না। হঠাৎ একদিন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে গিয়ে ক্যারিয়ার ক্লাবের মাধ্যমে জিআরই সম্পর্কে জানতে পারেন। তারপর বিভিন্ন সেমিনার ও ফেসবুক গ্রুপ থেকে এ সম্পর্কে আরও ধারণা নিতে থাকেন। বন্ধুরা সবাই যখন চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে, তখন তিনি কেন হঠাৎ উচ্চশিক্ষার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন এর কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্টের বিখ্যাত উক্তি অনুসারে, Two roads diverged in a wood, and I took the one less traveled by, and that has made all the difference। অনার্সে পড়া অবস্থায় যখন আমার সব বন্ধুরা বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু করছিল, আমি তখন ইংরেজি সাহিত্যিক রবার্ট ফ্রস্টের মত অনুসারে চ্যালেঞ্জিং এবং কঠিন ভয়ানক একাকি পথটাই বেছে নিয়েছিলাম। আমার কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছি।

তবে এ স্বপ্নের পথে হাঁটতে গিয়ে ইমরানকে কখনো ব্যর্থতায় আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়েছে কিংবা কখনো ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার হতে হয়েছে কিংবা বন্ধুদের হাসিঠাট্টার পাত্রে পরিণত হতে হয়েছে কিংবা এর মধ্যে প্রিয়জন হারানোর বেদনাও বয়ে বেড়াতে হয়েছে। উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই অনেক হাসিঠাট্টা করেছেন। কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় আসার স্বপ্ন অনেকেই দেখেন না, নতুবা মনে করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষার্থী ভিসায় আমেরিকা আসা সম্ভব নয়। কিন্তু ইমরানের মনে জেঁকে বসল, যেভাবেই হোক আমেরিকায় আসতে হবে। তাই নিজেই প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করলেন। প্রস্তুতি শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনা, পরামর্শের অভাববোধের কথাও জানালেন।

বাংলাদেশে সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক বা সিনিয়ররা উচ্চশিক্ষায় পড়তে আসার জন্য যেভাবে সহযোগিতা করে থাকেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য এদিক থেকে অনেকটাই পিছিয়ে ছিলেন। কীভাবে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত, কোন বিশ্ববিদ্যালয় ভালো হবে—এসব নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তা করতে হত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায় থিসিস, রিসার্চ, পাবলিকেশনের সুযোগ কম থাকায় আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়া অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং ছিল। তা ছাড়া শিক্ষকেরা রিকমেন্ডেশন লেটার দিতে অনেকটাই অনাগ্রহ প্রকাশ করতেন। প্রথমবার জিআরই পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না আসায় অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েন। তার মধ্যে বাবা মারা যাওয়ায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। পরিবারের সব দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে। সিলেট শহরে ৪–৫টি টিউশনি করে ছোট ভাই-বোনদের পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি পরিবারের ব্যয়ভারও বহন করতে হত তাকে। এ অবস্থায় আমেরিকায় পড়তে আসা স্বপ্ন শুধুই মরীচিকা মনে হত। দ্বিতীয়বার জিআরই পরীক্ষা দিয়ে আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা শুরু করেন।

এ ধাপে এসে ভেবেছিলেন, এবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতেই চলল। কিন্তু সিনেমার মত ইমরানের এই স্বপ্নযাত্রায় বাঁধা যেন শেষ হওয়ার নয়। তিনি জানালেন, ভিসা পেতেও তাকে অনেক ভোগান্তির ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। জিআরই, টোফেল, এসওপি, এলওআর প্রফেসর মেইলিং, ফান্ডিং পাওয়ার পরে ভিসা ইন্টারভিউ জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের ভিসা পাওয়ার পরিসংখ্যানের দিক দিয়ে ফুল ফান্ডিং ছাড়া ভিসা পাওয়ার হার খুব কম। তাই ভিসা ইন্টারভিউ আগে ফুল ফান্ডিং এবং স্কলারশিপ অর্জন করতে হয়েছে। ফান্ডিং পাওয়া সত্ত্বেও কিছুটা ডেফিসিট থাকায় প্রথমবার ভিসা ইন্টারভিউতে ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়। এমনকি দ্বিতীয়বার ভিসা ইন্টারভিউতে অ্যাডমিনিসট্রেটিভ প্রসেসিংয়ে রেখে আবার ভিসা প্রত্যাখ্যান করা হয়। অনেক হতাশার মধ্যে মনে হয়েছিল, আমেরিকায় উচ্চশিক্ষার জন্য আর আসা হবে না। কিন্তু আবার মনোবল না হারিয়ে, জিরো ডেফিসিট, ফুল ফান্ডিং স্কলারশিপ অর্জন করে তৃতীয়বার ভিসা ইন্টারভিউতে ভিসা পেয়ে পাড়ি জমান আমেরিকায়।

বর্তমানে কী করছেন জানতে চাইলে ইমরান জানান, আমেরিকায় আসার পর থেকে টেকনোলজি নিয়ে পড়া এবং গবেষণা করার আগ্রহ বাড়তে থাকে। তাই পিউর ম্যাথম্যাটিকস কোর্সগুলোর সঙ্গে ইমেজ প্রসেসিং, ইমেজ অ্যানালাইসিস, মেশিন লার্নিং, নিউরাল নেটওয়ার্ক কোর্স নিয়েছি এবং স্কিন ক্যানসার ডিটেকশন নিয়ে রিসার্চ এবং থিসিস করছি। মাস্টার্স শেষ করে ডেটা সায়েন্স নিয়ে পিএইচডি অ্যাডমিশন নেব এবং ভবিষ্যতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, কনভেনশনাল নিউরাল নেটওয়ার্ক, ডেটা সায়েন্স নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা।

বাংলাদেশ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা একেবারেই কম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কীভাবে উচ্চশিক্ষার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে—এ বিষয়ে তিনি তার অভিমত ব্যক্ত করেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ না হয়ে বা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে আমাদের মত যাদের শেষ আশ্রয়স্থল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, তারা অনেকেই প্রথম থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বলে হীনমন্যতায় ভুগি। উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা খুবই কম, যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় হতে ভালো রেজাল্ট, এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাকটিভিটিস, গবেষণা করতে পারলে বিশ্বের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নেওয়া যায়। নিজের মেধা, মনন এবং কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে সর্বপ্রথম আমাদের লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বারবার হারলেও স্বপ্নের পথে অটুট থেকে এগিয়ে যাওয়ার মনোবল থাকতে হবে। প্রচলিত চাকরি প্রথা থেকে বের হয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নিয়ে টেকনোলজির দিকে এগিয়ে যেতে হবে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও গবেষণার প্রতি আগ্রহ থাকলে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে থিসিস, গবেষণা করলে অনেক লাভবান হওয়া যাবে। সব সময় ভালো সিজিপিএ ধরে রাখার চেষ্টা করতে হবে। জিআরই সম্পর্কে ভালো ধারণা নিয়ে, সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য আসা সম্ভব না—এ রকম চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে নিজের স্বপ্নের পেছনে ছুটলে অবশ্যই উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে পড়তে আসা সম্ভব।