প্রজাপতি প্রেম ও উইনস্টন চার্চিল

‘প্রজাপতি প্রজাপতি/ কোথায় পেলে ভাই/ এমন রঙিন পাখা’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গানের এ বাণী সবার মনে প্রায়ই ঘুরপাক খায়। সত্যিই তো রঙের এমন বিন্যাস তো কোথাও দেখা যায় না। প্রজাপতির রঙিন পাখার জাদু মোহিত করে সবাইকে। স্বনামধন্য শিল্পী মুর্তজা বশীর প্রজাপতির ডানার রঙে আকৃষ্ট হয়ে ‘উইংস’ নামে এক সিরিজ ছবি এঁকেছেন দীর্ঘদিন।
বড় মানুষের স্বপ্ন নাকি কখনো ছোট হয় না। ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ছিলেন একজন প্রজাপতি প্রেমিক। বাড়ির চারদিকে রঙিন ফুলে ফুলে নেচে বেড়াবে প্রজাপতি, তার পিছু পিছু ফুটফুটে ছেলেমেয়েরা ছুটে বেড়াবে, সবাই মুগ্ধ হবে—এটাই তাঁর কাম্য ছিল। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ ও বিশ্বখ্যাত সমরনায়ক উইনস্টন চার্চিল যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, তখন তাঁর প্রজাপতি প্রেমের কী হয়।
১৯২২ সালে চার্চিল মেয়ে মেরির জন্মের পর কেন্টে একটা বাড়ি কেনেন গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য। এই বাড়ি ঘিরেই তাঁর স্বপ্ন ছিল প্রজাপতি চাষের। পরে যুদ্ধের ডামাডোলে সে স্বপ্নও ভেস্তে গেছে। কিন্তু এবার চার্চিলের স্বপ্নের বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছে ন্যাশনাল ট্রাস্ট কনজারভেশনাল সেন্টার। তাঁর বাড়িটিকে তারা প্রজাপতি হাউস বানানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
মন মাতানো বাহারি রঙের প্রজাপতি স্রষ্টার এক অনন্য সৃষ্টি। প্রকৃতিবিদেরা মনে করেন এই প্রজাপতি বিপন্ন হতে চলেছে। একে বাঁচানোর সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে প্রজাপতির প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গেও মানুষকে সচেতন করে তোলা জরুরি। প্রজাপতির প্রধান কাজ হলো পরাগায়ণে সহায়তা করা। এর মাধ্যমে বহু উদ্ভিদ বংশবিস্তারে করে। রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব। তাই প্রজাপতির সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসা উচিত।
বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ নগরী আরব আমিরাতের দুবাইয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিরল প্রজাতির প্রজাপতির বাগান। এ বাগানে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দুর্লভ প্রজাতির অসংখ্য প্রজাপতি। বাগানটিকে সাজানো হয়েছে অপরূপ সাজে। এমনকি পর্যটক আকর্ষণে আমিরাতের শাসক থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের ছবি সাজানো হয়েছে প্রজাপতি দিয়ে। বাগানে প্রবেশ করতেই চোখ জুড়িয়ে যাবে যেকোনো মানুষের। চোখ জুড়ানো এমন অপূর্ব দৃশ্য আর অনাবিল শান্তির আবেশ পেতে প্রতিদিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে প্রজাপতির সে বাগানে। সপ্তাহের ছুটির দিন শুক্রবারে দর্শনার্থীর ভিড় দ্বিগুণ হয়ে যায়। মরুর বুকে এমন চমৎকার আয়োজনে মুগ্ধ দর্শনার্থীরা।
বুর্জ খলিফা টাওয়ার দেখে আমরা যখন প্রজাপতি বাগানে পৌঁছলাম তখন বিকেল ৫টা। জানলাম ৬টায় বন্ধ হয়ে যাবে বাগান। তড়িঘড়ি করে ভেতরে প্রবেশ করি। এখানে না আসলে বোঝা যেত না বাগানের অপরূপ সৌন্দর্য সম্পর্কে। দেখা হলো কয়েকজন বাংলাদেশির সঙ্গে। জানালেন, এটি প্রজাপতির বাগান নয় যেন স্বর্গরাজ্য। এখানে কাজ করতে পেরে নিজেদের ধন্য মনে করছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, বাংলাদেশে অসংখ্য প্রজাপতি দেখা গেলেও এর রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। তা ছাড়া বনাঞ্চল উজাড় করে এ সব প্রাণের বাসস্থান বিলুপ্ত করা হচ্ছে।
আমেরিকার অঙ্গরাজ্য ফ্লোরিডার দক্ষিণে অবস্থিত ছোট্ট এক দ্বীপ, যা ফিদেল কাস্ত্রোর দেশ কিউবার প্রায় ৯০ মাইল উত্তরে অবস্থিত। আমেরিকার শেষ সীমান্তে কিউয়েস্ট দ্বীপ নামে পরিচিত সে এলাকায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাস রয়েছে। সেখানেও গড়ে তোলা হয়েছে আকর্ষণীয় প্রজাপতি বাগান। প্রচণ্ড গরমে হাঁটতে হাঁটতে যখন ভীষণ ক্লান্ত, তখনই আমরা এর সন্ধান পেলাম। একটা বিলবোর্ডে লেখা দেখলাম ‘পৃ্রজাপতি বাগান’। লোভ সামলাতে না পেরে প্রবেশ করি প্রজাপতি বাগানে। অবাক হওয়ার মতো দৃশ্য। ফুল ও প্রজাপতিতে একাকার পুরো বাগানটা। গ্লাস আবৃত বিশাল আকৃতির ঘরে গাছ আর ঝোপঝাড় সমৃদ্ধ বাগানের মধ্যে চাষ করা হয়েছে বিরল প্রজাতির নজরকাড়া প্রজাপতি। এক জায়গায় লেখা রয়েছে বন্য প্রজাপতিদের জীবনী। বন্য প্রজাপতিরা দল বেঁধে বাস করতে ভালোবাসে। শীত প্রধান দেশে বাস করলেও শরৎ ঋতুর দেশ তাদের প্রিয় বাস স্থান। তাই শীতকাল শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তারা স্থান ত্যাগ করে। না হলে ঠান্ডাজনিত কারণে তাদের গড় আয়ু থাকে মাত্র পনেরো দিন। অথচ শরতের আবহাওয়ায় তারা ছয় মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
‘উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি’—স্লোগানকে সামনে রেখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে উঠেছে প্রজাপতি বাগান। বোটানিক্যাল গার্ডেনে জাল দিয়ে ঘেরা এ বাগান এরই মধ্যে ‘প্রজাপতি ঘর’ খ্যাতি পেয়েছে। প্রতি বছর মেলার আয়োজন করে পরিবেশের জন্য প্রজাপতির উপকারিতা তুলে ধরে জনগণকে সচেতন করাই ছিল এ মেলার লক্ষ্য।
প্রায় ৩০০ একর জমির ওপর তৈরি করা হয়েছে প্রজাপতির এই অভয়ারণ্য। জানা যায়, প্রজাপতি আর মৌমাছি এ দুই পতঙ্গ পৃথিবীর সব বনাঞ্চলকে টিকিয়ে রেখেছে। আর এই প্রজাপতি যদি বিলুপ্ত হয়ে যায় তবে সরাসরি প্রভাব পড়বে বনাঞ্চলের অস্তিত্ব ও বিস্তারে। সবচেয়ে বড় কথা যে জলবায়ুর বিষণ্নতায় ক্ষতির সম্মুখীন আমরা, তার জন্যও বনায়ন বিশেষ জরুরি। এ জন্য জরুরি প্রজাপতির বংশবিস্তার।
প্রজাপতি খুবই ইউনিক প্রাণী। এটি একবার যে গাছে ডিম পাড়ে এরপর অন্য কোনো গাছে আর ডিম পাড়ে না। সেই গাছটি যদি পরে কেটে ফেলা হয়, তবে সেই প্রজাপতি আর ডিম পাড়ে না। প্রজাপতি মধু আহরণের জন্য গাছে গাছে ঘোরে। বন কিংবা ঝোপঝাড়ের গাছপালায় ঘুরলেও ডিম পাড়ে কিন্তু নির্দিষ্ট একটি গাছে। প্রাণী বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ১৮৮টি প্রজাতির প্রজাপতি বিলুপ্ত হওয়ার হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। প্রাণিকুলের আবাস ধ্বংস ও বন উজাড় হচ্ছে প্রতিনিয়ত। পরিবেশ দূষণও প্রজাপতির বিপন্ন হওয়ার একটি বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
প্রজাপতিরা সাধারণত ১২টি গোত্রে বিভক্ত। বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। বাড়ির বাগান থেকে ঝোপঝাড় ও বনভূমির সর্বত্র বিভিন্ন পরিবেশে প্রজাপতি দেখা যায়। প্রজাপতি নিয়ে অনেক মিথ রয়েছে বিশ্বজুড়ে। প্রজাপতি যদি কোনো অবিবাহিত মেয়ে কিংবা ছেলের গায়ে বসে তবে ধরেই নেওয়া যায় অচিরেই তার বিয়ে হচ্ছে। আমাদের দেশে এ সব মিথ সবার জানা।
সাধারণত প্রজাপতিকে পরিবর্তন, আনন্দ ও ভালোবাসার প্রতীক বিবেচনা করা হয়। যেমন গ্রীকরা বিশ্বাস করে প্রতিটি মথ থেকে প্রজাপতি বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আত্মার জন্ম হয়। আবার জাপানি মিথে রয়েছে, যার ঘরে প্রজাপতি প্রবেশ করে , তার সবচেয়ে পছন্দের ব্যক্তিটি তাকে দেখতে আসবে। মেক্সিকোর কিছু কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর ধারণা, প্রজাপতি হলো পৃথিবীর উর্বরতার প্রতীক।
বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন মেলা বসে, তখন ক্যাম্পাস ভরে ওঠে বর্ণিল প্রজাপতিতে। তাদের রঙের ছটায় রঙিন হয়ে ওঠে মানুষের মন। প্রজাপতির রঙে রাঙা মানুষেরা সুন্দরকে ভালবাসাবে, সুন্দরের ধ্যানে হবে নিমজ্জিত—এটাই প্রত্যাশিত। প্রজাপতির প্রেমে পড়া কোনো মানুষ উইনস্টন চার্চিলের মতো যুদ্ধে জড়াবে না, বরং দেশে দেশে শান্তির বার্তা বয়ে নেবে—এমনটাই হোক।