করোনার এই সময়ে কোরবানি

ইসলাম ধর্মের বিশেষ দুটি ধর্মীয় উৎসব ঈদ। একটি হচ্ছে ঈদুল ফিতর, অন্যটি হচ্ছে ঈদুল আজহা। কিন্তু এই অদ্ভুত অন্ধকারে ঢাকা পৃথিবীতে চারদিকে যখন মৃত্যু, ক্ষুধা আর হাহাকারের মিছিল, তখন ঈদ আরও কিছু করার বার্তা নিয়ে আসে।
এই অঞ্চলে কোরবানি ঈদের শুরুটা নিয়ে বলতে গেলে যেতে হবে অনেক পেছনে। বাংলাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই আরব বণিকদের এ বঙ্গে যাতায়াত ছিল। হয়তো-বা তাদের মাধ্যমেই এ দেশের মানুষ ইসলাম সম্পর্কে অবহিত হয়। এর পরের ইতিহাস আমরা জানি। ওলি-আউলিয়া, পীর-মুরশিদের মাধ্যমেই এ দেশে ইসলাম প্রচার হতে থাকে। যারা ইসলাম গ্রহণ করেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী, বিশেষত নিম্ন বর্ণের হিন্দু। সমাজে তাদের প্রতিপত্তি কমই ছিল। যখন তারা ইসলামে বিশ্বাস স্থাপন করে ইসলামি উৎসবাদি পালন করতে থাকে, তখন যে উৎসবটি নিয়ে স্থানীয় হিন্দুদের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়, তা হলো কোরবানির ঈদ।
এসব অনেক লম্বা ইতিহাস। গরু কোরবানি নিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে বিরোধ যতই বাড়ুক না কেন, দিন দিন গরু কোরবানিতে আগ্রহ বাড়ছে। বাংলাদেশে করোনাকাল এখনো শেষ হয়নি। তবে ধুমধামের সঙ্গে চারদিকে গরুর বাজার বসে গেছে। এ বছর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে গরু বেচাকেনা হচ্ছে। সচেতন নাগরিকেরা সতর্কতা মেনে অনলাইনে পশু কেনার কাজটি করছেন। বাজারদরও অন্য বছরের তুলনায় বেশি। এসব দেখে মনে হয়, কে বলে দেশের মানুষের টাকার অভাব? কে বলবে করোনায় ১২ লাখ মানুষ বেকার হয়েছে। মানুষ শহরে বাসা ভাড়া দিতে পারছে না বলে গ্রামে ফিরে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু পশু কোরবানির বাসনা ও তৌফিক কোনোটাই কমেনি।
আমরা জানি, ঈদ মানে আনন্দ, উৎসব ও আয়োজন। তবে এ বছর আলাদা। বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের জন্য এ বছর এমন বিবর্ণ দুটি ঈদ এসেছে, যা আগে কখনো আসেনি।
নিউইয়র্ক ছিল করোনার মৃত্যুপুরি। আমার এলাকা বলতে গেলে মুরব্বিশূন্য হয়ে গেছে। ঘরে ঘরে করোনা-আক্রান্ত মানুষ। পঁচিশ লাখ মানুষ এখনো বেকার। বাড়ি ভাড়া নিয়ে সরকারি অনুদানের আশায় মার্চ মাস থেকে অনেকেই বাড়ি ভাড়া দেননি। সিটি থেকে বাড়ি ভাড়া-সংক্রান্ত বিল পাস হয়েছে। তবে যারা পারিবারিকভাবে ফেডারেল সুবিধা ভোগ করেছেন, তাদের অনেকেই এই সুবিধা থেকে বাদ পড়বেন। ফেডারেল সরকার থেকে মহামারি ভাতা সপ্তাহে ৬০০ ডলার। এও এ মাসেই শেষ হচ্ছে । এত কিছুর মধ্যে কোরবানি ঈদ। সরকারি বেকার ভাতা থেকে কোরবানি দেওয়া কতটা সওয়াবের কাজ হবে, তা গুণীজনেরা ভালো বলতে পারবেন।
কাওরান বাজার, মান্নান, প্রিমিয়াম ঘুরে জানা গেছে, তারা অন্য বছরের তুলনায় ১০ শতাংশও অর্ডার পাননি। কেউ কেউ দেখছি বিভিন্ন গ্রোসারিতে কোরবানির অর্ডার দিতে যোগাযোগ করছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেকেই বলেছেন, লোক দেখানো কোরবানি এ বছর দেবেন না। কারণ, করোনার কারণে গত পাঁচ মাস ধরে নিজের কোনো আয় নেই। কেউ কেউ বলছেন, করোনায় নিজের আয়ের কোনো টাকা নেই। সরকারি অনুদানের টাকায় কোরবানি দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না। কেউ বলছেন, চার মাস ঘরভাড়া দেননি। তিনি কোরবানি না দিয়ে ঘরভাড়া পরিশোধ করবেন।
অবশ্য অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, কোরবানি হয়ে গেছে গোশত খাওয়ার উৎসব। বিশাল পশু কিনে লোকেরা এলাকায় জানান দিচ্ছে নিজের বিশালত্ব, ফেসবুকে পশুর ছবি শেয়ার করছেন। অথচ কোরবানি হচ্ছে মহান রবের হুকুমের কাছে নিজের আমিত্ব, কর্তৃত্ব, অহংকার সমর্পণ করা। সবকিছু ভুলে জীবনের সবকিছু তাঁর রাহে ব্যয় করার মাধ্যমে মনিবের সঙ্গে গোলামের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার অতি উত্তম পন্থা। এবারের কোরবানি আমাদের সেই শিক্ষার কাছেই নিয়ে যাক।