মান্যবরদের জন্য মানপত্র

শহিদ ইসলাম, সাবরিনা ও সাহেদ করিম
শহিদ ইসলাম, সাবরিনা ও সাহেদ করিম

এককালে স্কুল ইন্সপেক্টর ছাড়াও শিক্ষা বিভাগের উচ্চ পদধারীরা মাঝেমধ্যে স্কুলে আসতেন। বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদদেরও স্কুলে আমন্ত্রণ করা হতো। আগমনের দিন, তারিখ নিশ্চিত হওয়ার পরপরই স্কুলজুড়ে হই হই রই রই কাণ্ড শুরু হয়ে যেত। তার ঢেউ এসে স্কুলের সবচেয়ে অমনোযোগী ছাত্রকেও আগমন অনুষ্ঠান বিষয়ে মনোযোগী করে তুলত। আগমন উপলক্ষে মাল্যদান, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এ ছাড়া ও তাদের কর্ম, জ্ঞান, মানবিকতা, শিক্ষানুরাগসহ যাবতীয় মানবিক গুণ নিয়ে একটি পূর্ণ পৃষ্ঠার রচনা লিখে তাঁদের সামনে পাঠ করা হতো। এই রচনাকে রঙিন কাগজে প্রিন্ট করে অত্যন্ত যত্ন সহকারে বাঁধাই করা হতো। অন্যান্য উপহারের সঙ্গে রচনাটিও মহান অতিথির বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতো।
এই বিশেষ রচনাটি মানপত্র, অভিনন্দনপত্র—এমন বহু নামে পরিচিত ছিল। মানপত্র ছাড়া অতিথির অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান কল্পনাও করা যেত না। মানপত্রের প্রতিটি পঙ্‌ক্তিতে তাঁদের নানাভাবে সম্বোধন করা হতো। যেমন, হে কর্মবীর, হে জনদরদি, হে জ্ঞান তাপস, হে আলোর দিশারি, হে পথপ্রদর্শক ইত্যাদি। মনে হতো ঈশ্বর বোধ হয় পৃথিবীতে এমন একটি মাত্র ‘সর্বগুণে গুণান্বীত’ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে শুধু এই স্কুলে আগমন করার মহান উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই। আমরা জানি না, এ সমস্ত গুণী মানুষেরা এমন বিশেষণে বিশেষায়িত হয়ে নিজেরা গৌরববোধ করতেন, নাকি খানিকটা লজ্জাও পেতেন।
আমরা যারা সত্তরের দশকে মাধ্যমিক স্কুলে পড়েছি, তখন অভিনন্দনপত্র যুগের সূর্য অস্ত যায় যায় অবস্থা। তারপরও পুরোনো রচনা বইতে কৌতূহল নিয়ে মানপত্র পড়ে দেখার সুযোগ ছিল আমাদের। পুরোনো প্রশ্নপত্র ঘাঁটলে দেখা যেত এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বাংলা দ্বিতীয় পত্রে পড়ানো হতো এবং পরীক্ষায় প্রশ্ন হিসেবে দেওয়া হতো। আমাদের ধারণা সাতচল্লিশ পূর্ব সময়ে ব্রিটিশ কর্মচারীদের জন্যই এই মানপত্রের সূচনা হয়। উপনিবেশের মানুষ হিসেবে নিজেদের দাসবৃত্তিকে ইংরেজ প্রভুদের সামনে সুন্দর করে তুলে ধরার জন্যই দেশীয় শিক্ষাবিদেরা এই প্রথার প্রচলন করেন। তবে এ কথা সাধারণভাবে বলা যাবে না যে, যারা স্কুল পরিদর্শনে আসতেন তাদের মধ্যে অনেক জ্ঞানী, গুণী, কবি-সাহিত্যিক, রাজনৈতিক নেতা, মহৎ হৃদয়ের মানুষেরাও ছিলেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশে কিছু মান্যবরদের অজানা জীবন কাহিনি ধীরে ধীরে আমাদের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে, আর আমরা বিস্ময়ে হতবাক হচ্ছি। শোনা যাচ্ছে অনেকেই এ রকম কাহিনি শুনে শোকগ্রস্ত ও সুখগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার অনেকেই নাকি শোকে কঠিন শিলাতে রূপান্তরিত হয়ে পড়ছেন। আমি অবশ্য তাদের কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত, উৎসাহিত হয়ে আবার মানপত্রের যুগে ফিরে যেতে উদ্‌গ্রীব হয়ে পড়ছি। তাঁদের নিয়ে মানপত্র রচনার জন্য আমার হৃদয় আকুলি-বিকুলি করছে। যদিও আমি পূর্ণ পৃষ্ঠা মানপত্র রচনা করতে অক্ষম। তাই নমুনা মানপত্র হিসেবে মাত্র তিনজনকে নিয়ে কাঁচা হাতে একটু চেষ্টা করে দেখছি, আবার মানপত্র যুগে ফেরত যাওয়া যায় কি না।

মানপত্র এক
হে সেলফি বীর, জাতির এই ক্রান্তিকালে আপনি আপনার উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে হাল আমলে আবিষ্কৃত সেলফিকে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা প্রদর্শন করে জাতিকে যে ঋণভারে নিমজ্জিত করেছেন, জাতি অচিরেই ধ্বংস হয়ে গেলেও ধ্বংস-পূর্ব সময়ে ঋণ অপরিশোধিত থেকে যাবে—এ বিষয়ে জাতির কোনো সন্দেহ নেই। আপনি দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া দেশি-বিদেশি সমস্ত ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সেলফি তুলে কীভাবে তা বহুবিধ উপায়ে ব্যবহার করা যায় এবং এর দ্বারা ঝরনাধারার মতো অর্থ পকেটস্থ, ব্যাংকস্থ করা সম্ভব। আপনি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের তরুণ, তরুণীদের সামনে অনুকরণ ও অনুসরণযোগ্য যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, তা অভাবনীয়।
হে জাতীয় ত্রাতা, আপনাকে জাতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধাভরে কুর্নিশ জানানো হচ্ছে। হে বহুরূপী মান্যবর, আপনার ক্ষণে ক্ষণে রূপ পরিবর্তন করা অবলোকন করে গিরগিটিসহ বিশ্ব প্রাণীকুল মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন। আমাদের একটি বাহিনী যখন আপনাকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, তখন আপনি বোরকা পরে এমন এক রূপে আবির্ভূত হলেন যে, সেই বাহিনীসহ সমগ্র জাতি আপনার বহুরূপী সাজার প্রতিভায় মুগ্ধ না হয়ে পারেনি। এ ছাড়াও অবৈধ (লোকে বলে) কর্মসাধনের জন্য আপনি কখনো সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাসহ নানা পদধারীর অভিনয় করে ‘একই অঙ্গে অসংখ্য রূপের’ প্রভা দেখিয়ে আমাদের চমৎকৃত করেছেন। আপনার এই প্রতিভা বিশ্ববাসীও প্রত্যক্ষ করেছে। সিনেমা না করেও বাস্তব জীবনে অভিনয়ের জন্য আপনাকে অস্কার নমিনেশনের জন্য প্রস্তাব করতে জাতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ না হয়ে তাই পারে না।
হে আইকনিক চরিত্র, জাতির পক্ষ থেকে আমরাও আপনার সঙ্গে সহমত যে, আপনার মতো প্রতিভাবানকে ছয় মাসের বেশি ‘কারার ওই লৌহ কপাটে’র ভেতরে ধরে রাখা সম্ভব নয় এবং তা অনুচিত কর্মও বটে। আমরা নৃত্য সহকারে ‘কারার ওই লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট’, সংগীতটি পরিবেশন করে আপনার মুক্তি আন্দোলনকে একটি অভিনব আন্দোলনে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর।

মানপত্র দুই
হে মানব সম্পদ রপ্তানিকারক কর্মবীর, দেশ ও জনগণকে উদ্ধার ও জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করায় আপনার যে অবদান, ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা তা ভন্ডুল হয়ে যেতে দেখে আমরা মর্মাহত, শোকগ্রস্ত। আপনি সম্মানিত আইনপ্রণেতা। আপনার মতো আইন প্রণয়নকারী বেআইনিভাবে মানবসম্পদ পাচারের সঙ্গে যুক্ত—এমন অভিযোগ জাতিসংঘের মাধ্যমে উত্থাপন করলেও তা ‘অবিশ্বাস্য’। সম্প্রতি আপনার বেগমসাহেবা মিডিয়ার সামনে উপস্থিত হয়ে যে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন, সে বিষয়ে আমরা চোখ বুঁজে তার সঙ্গে একমত পোষণ করছি।
হে ভাবমূর্তির রক্ষাকর্তা, আপনি দেশের ভাবমূর্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অহর্নিশ পরিশ্রম করে ‘লক্ষ্মী’ আনয়নের জন্য নিজ জেলার সম্মান রক্ষায় যে ত্যাগ ও নিবেদন প্রদর্শন করেছেন, তা বন্ধুবেশী মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি যাতে কোনোভাবে নষ্ট করতে না পারে, সে জন্য আপনার ভক্ত হিসেবে আমরা আমাদের চক্ষু, কর্ণ, নাসিকাকে সদা জাগ্রত করে রেখেছি। হে লক্ষীমন্ত বীর, দেশ ও জাতি আপনার অপেক্ষায় আছে। অচিরেই আমরা (পড়বেন ঈদের পরপর) মধ্যপ্রাচ্যের দেশে লোক রপ্তানি করে প্রবল গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করে আপনাকে মুক্ত করে নিয়ে আসব।
হে আমদানি ও রপ্তানিকারক জনবন্ধু, আপনি নিশ্চিত থাকুন আপনাকে মুক্ত করে আমরা আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বলতর করে বিশ্ববাসীর সামনে দেশপ্রেমের নমুনা হাজির করব।
হে জননায়ক, আমরা হস্তকে মুষ্টিবদ্ধ করে শপথ নিচ্ছি, আপনার জীবন ও কর্মকে জাতির সামনে তুলে ধরার জন্য স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণিতে ‘ভাবমূর্তি’ শিরোনামে রচনা পাঠ করানোর ব্যবস্থা করব এবং সারা দেশে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে আপনার ভাস্কর্য স্থাপনকে নিশ্চিত করব। হে গণপ্রতিনিধি, আপনাকে টুপি ও হৃদয় খোলা অভিবাদন।

মানপত্র তিন
হে কাদম্বিনী সমতুল্যা চিকিৎসক, কাদম্বিনী দেবী যে পথের সূচনা করেছিলেন, অবলা নারীকুলকে সে পথ দিয়ে আপনি অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছেন, আপনাকে হৃদয়ের দু কূল থেকে ভেসে আসা শুভেচ্ছা। হে হৃদয়ের কারিগর, আপনি হৃদয় বিষয়ক জটিলতা নিরসনের জন্য বাংলাদেশের সরকারি ফাউন্ডেশনে নিজেকে একান্তভাবে নিবেদন করেছেন। কিন্তু জাতির এই করোনাক্রান্তিকালে আপনি বসে থাকেননি।
হে করোনা শনাক্তকারিনী, আমরা আপনার অভিনব শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া দেখে আনন্দিত। পায়রার মতো বাকবাকুম করে জাতি আপনাকে অভিবাদন জানাতে চায়। নারী যে কোনো ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই, আপনি যে অধুনার নায়ক ‘সেলফি বীরে’র সমতুল্য, তা আপনার অরোগীকে রোগী, রোগীকে অরোগী বানানোর কৌশলেই প্রমাণিত। আপনি চক্ষু মুদে জোড়-বিজোড় খেলে, করোনা রোগী শনাক্তকরণের যে আচানক খেলা নীরবে করে দেখিয়েছেন, আমরা সে প্রতিভায় মুগ্ধ।
হে সব্যসাচী, আপনি যে শুধু চিকিৎসক নন, আপনি মডেল কন্যা, চিত্রনায়িকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হওয়া রমণী, আপনি তেজস্বিনী। আপনিও সেলফিবীরের মতো বহুরূপী। ক্রান্তিকালে আপনার এসব গুণ জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে জানা না গেলে, জাতি যে কত বড় তথ্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতো, বিশ্বসমাজ বিষয়টি অনুধাবন করতে না পারলেও বঙ্গসমাজ আজ সহজেই তা বুঝতে পেরেছে।
হে তরুণ-তরুণীর উৎসাহদাত্রী, জীবনকে বসন্তের প্রকৃতির মতো সাজিয়ে তুলতে কী করতে হবে, আপনি তা প্রদর্শন করে প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। আপনাকে আমরা করোনাকালে ছত্রিশ কোটি হস্ত গগনের দিকে উত্তোলন করে অভিবাদন জানাচ্ছি।
আমার ধারণা, এই তিনটি মানপত্র পাঠ করে আমরা অন্তত তিনজন মান্যবরকে যথাযথ সম্মান দেখাতে পারলাম। স্থানাভাবে সমতুল্য অনেকের জন্যই মানপত্র লিখতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করছি। আশা করি নমুনা মানপত্র পাঠ করে কিছু মানুষ অন্তত উৎসাহিত হয়ে বাকিদের জন্যও মানপত্র প্রস্তুত করে জাতিকে কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে নিজেকে তুলে ধরতে উদ্বুদ্ধ হবে। আমরা আরও মান্যবরদের আগমনের অপেক্ষায় থাকলাম।