স্ট্রেস রেসপন্স: ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে

আদিম যুগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যখন গুহা বা জঙ্গলে বসবাস করত, তখন সচরাচর তারা হিংস্র বন্যপ্রাণীর আক্রমণের শিকার হতো। হিংস্র বন্যপ্রাণীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাদের একটাই পথ ছিল—হয় প্রাণীটির সঙ্গে লড়াই কর, নয়তো দৌড়ে পালাও।

যুগ পাল্টেছে। এখন বন্যপ্রাণীর সঙ্গে লড়াই করার প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। তারপরও দৈনন্দিন জীবনে টিকে থাকতে গিয়ে প্রতিনিয়ত আমরা পাওয়া না-পাওয়া, হার-জিত, আশা-নিরাশার যে লড়াই করে যাচ্ছি, তাতে আমাদের সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেম উদ্দীপ্ত থাকছে এবং নিঃসৃত হচ্ছে বিভিন্ন স্ট্রেস-হরমোন, যেমন- এড্রিনালিন, নর-এড্রিনালিন ও কর্টিসল। বুনো আদিমতা শেষ হলেও লড়াই আমরা প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছি। আর এই লড়াই করতে গিয়েই আমরা প্রতিনিয়ত ফাইট অর ফ্লাইট রেসপন্স করছি, যাকে স্ট্রেস রেসপন্সও বলা হয়। স্ট্রেস রেসপন্স হচ্ছে আমাদের অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেমের একটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সাদা বাংলায় চাপের মুখে আমরা যেভাবে সাড়া দিই, হোক তা ইতি বা নেতি, এই সাড়াই হলো মনোবিজ্ঞানের ভাষায় স্ট্রেস রেসপন্স। এই সাড়ার হেরফেরে রোগও বাসা বাঁধতে পারে শরীরে ও মনে। দিনের পর দিন ক্রমাগত দুশ্চিন্তা ও স্ট্রেস করতে থাকলে শরীরের স্নায়ু ও পেশিগুলো যে পরিমাণে সংকুচিত হয়, সে অনুপাতে শিথিল হতে পারে না। ফলে নানা রকম সাইকোসোমাটিক বা মনোদৈহিক রোগব্যাধি আমাদের আক্রমণ করে বসে।

আমেরিকার সানফ্রান্সিসকোর চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা. মেয়র ফ্রেডম্যান ও ডা. রে রোনেম্যান দীর্ঘ গবেষণার পর দেখিয়েছেন যে, হৃদ্‌রোগের সঙ্গে অস্থিরচিত্ত, বিদ্বেষ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও ভুল জীবনাচরণের সরাসরি যোগ রয়েছে। আর এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জীবন সম্পর্কে আমাদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। আর এটাই স্ট্রেস রেসপন্স।

ধরুন, আপনি কারও থেকে টাকা ধার করেছেন। পাওনাদার সে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। কিন্তু আপনি এই মুহূর্তে টাকা শোধ করতে পারছেন না। তখন কি করবেন? নিজেকে রক্ষার্থে পাওনাদারকে মেরে ফেলবেন? পালিয়ে যাবেন? নাকি পাওনাদারকে অনুরোধ করে সময় চাইবেন দেনা শোধ করতে? আপনি এখন পরিস্থিতি সামাল দিতে যেভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন, সেটাই ফাইট অর ফ্লাইট বা স্ট্রেস রেসপন্স। এবং রি-অ্যাকশন যা-ই হোক, তা আমাদের সিমপ্যাথেটিক নার্ভাস সিস্টেমকে উদ্দীপ্ত রাখছে। কাজেই স্ট্রেস এড়ানো কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না।

নেতিবাচক স্ট্রেস রেসপন্সের বাস্তবিক উদাহরণ, ফাহিম সালেহ হত্যা। ৯০ হাজার ডলার কারচুপি শোধে এমন নির্মমভাবে টুকরো টুকরো করে ফাহিম সালেহকে হত্যা করার কারণ ছিল ডলার পরিশোধের স্ট্রেস এবং উদ্দেশ্য ছিল স্ট্রেস থেকে মুক্তি পাওয়া। একইভাবে জর্জ ফ্লয়েড হত্যায় বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কিছুসংখ্যকের লুটপাট করার প্রতিক্রিয়া একটি নেতিবাচক স্ট্রেস রেসপন্স।

ধরা যাক, একই প্ল্যাটফর্মে আপনি ও আপনার সহকর্মী বা বন্ধু। আপনি পুরস্কারটি পেলেন না। কিন্তু আপনার পাশের জন পেয়ে গেল। এতে আপনি ঈর্ষান্বিত না হয়ে যখন তাঁর অর্জনে খুশি হবেন বা খুশি না হতে পারলেও তাঁর প্রতি আপনি বিরূপ কোনো আচরণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন, তখন সেটা ইতিবাচক স্ট্রেস রেসপন্স।

স্ট্রেস বা চাপ আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি উপাদান। একে ছাড়া জীবন যাপন বলা যায় অসম্ভব। তবে, যতটা সম্ভব বাস্তব পরিস্থিতি মেনে নিয়ে তার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসিকতা গ্রহণ করতে পারলে, সময়কে ভাগ করে পরিকল্পনা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে এবং দৈনন্দিন জীবনধারণে বিরূপ মনোভাব ও আচরণ এড়িয়ে চলতে পারলে টেনশন ও স্ট্রেস অনেকটাই কমে যাবে। এতে স্ট্রেস রেসপন্স ইতিবাচক হবে বলে আশা করা যায়। আর এই ইতিবাচকতা বাড়তি চাপ থেকে মুক্ত রাখবে শরীর ও মনকে।