আট আনার গরু

১৯৪৭ সাল। দেশ ভাগ হয়ে যাচ্ছে। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে দাঙ্গা শুরু হয়েছিল, তার জেরে হিন্দুরা চলে যাচ্ছেন ওপারে। আর ওপারের অনেক মুসলমান চলে আসছেন এপারে।

সুনীল দাসের পরিবার বাড়িঘর জমিজমা স্বল্প মূল্যে বিক্রি করে চলে যাচ্ছেন, বোঝাই নৌকায় জিনিসপত্র। সুনীল দাস অসহায়র মতো একটি গাভির রশি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। জামার হাতায় চোখের জল মুছতে মুছতে ডাক দিলেন পাশের গ্রামের সফর আলীকে।

-সফর আলী...সফর আলী

-কী হয়েছে সুনীল? শুনলাম, সব বিক্রি করে চলে যাচ্ছ।

-ঠিকই শুনেছ, সফর মিয়া।

-কেন? আমরা তো আছি।

-কখন কী হয় ভগবান জানেন। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের ভালো চোখে দেখছে না। আমার বড় আদরের গাভি লক্ষ্মী। একে তোমার বাড়ি নিয়ে যাবে? আশা করেছিলাম সঙ্গে নিয়ে যাব। কিন্তু মাঝি বলছে এত দূরের পথ, এভাবে নেওয়া যাবে না।

-কিন্তু এই মুহূর্তে আট আনা পয়সা ছাড়া আমার কাছে আর কিছু নেই। তোমার এই গরুর দাম তো কম হলেও দশ পনেরো টাকা।

-সফর মিয়া ,তোমাকে দাম দিতে হবে না। শুধু একে একটু ভালোবাসা দিয়ো। আর আমাকে কথা দাও একে তুমি জবাই করবে না, বিক্রি করবে না।

-সে নাহয় হবে। কিন্তু তুমি এই আট আনা পয়সা রাখো। আর যদি পারো একে নিয়ে যেও। অথবা এর ন্যায্য দাম নিয়ে যেও।

এদিকে মাঝি তাগাদা দিচ্ছে, ‘কী হলো বাবু? বেলা হয়ে যাচ্ছে যে। হাওর পাড়ি দিয়ে নদীতে যেতেই রাত নামবে যে।’

সুনীল বাবু আট আনা পয়সা হাতে নৌকায় উঠলেন। লক্ষ্মীর দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন সফর আলী যতক্ষণ নৌকা অদৃশ্য না হয়।

বাড়িতে নতুন গরু দেখে হাজারো প্রশ্ন শুরু হলো। ‘একে কোথায় পেলে? আজকে তো হাটের দিন নয়? কত দিয়ে কিনলে? একে কী কোরবানির জন্য কিনেছ?’

সফর আলী গামছা হাতে ঘাটে যেতে যেতে বললেন, ‘আমার আট আনা পয়সার গরু। একে কখনো কোরবানি দেব না। কথা দিলাম।’

সেই থেকে সবাই একে আটআনি বলেই ডাকতে শুরু করে। বাড়ির অন্য গরুদের সঙ্গে আটআনিরও যত্নের ত্রুটি ছিল না। বছর ঘুরতেই আটআনি ওরই মতো লাল টুকটুকে বাছুর প্রসব করল। তার পরের বছর আবার। গৃহস্থ বাড়িতে দুধের অভাব থাকল না। আরও তিনটা গাভি, আর আটআনি মিলে এত দুধ দিতে শুরু করলে যে বিরাট কড়াইয়ে দুধ জাল হয়। বাড়ির লোকজন, চাকর-বাকর সবাই খেয়েও দুধ থেকে যায়। গৃহিণী অবশিষ্ট দুধ দিয়ে ঘি বানিয়ে বয়াম ভর্তি করে আত্মীয় বাড়িতে পাঠান। সফর আলী মনে মনে ভাবেন, যদি সুনীল বাবু ফিরে আসেন তবে বাছুরগুলোসহ তিনি তার গরু ফেরত দেবেন। কেটে যায় বারো বছর। সুনীল বাবুর আর কোনো খবর নেই। দেখতে দেখতে আটআনি দশটা বাছুর দিল। এর কয়েকটা সফর আলী বিক্রিও করলেন।

আটআনি আসার পর সফর আলীর তিন মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে হলো। বড় ছেলে জাহাজে চাকরি পেল। সেজো ছেলে বিয়ে পাস দিল। মেজ ছেলে বাজারে বড় দোকান নিল। জমিজমার পরিমাণও বাড়ল।

আটআনির বয়স বেড়েছে। এখন আর বাছুর দেয় না। ভারী দেহটা নিয়ে হেলেদুলে চলে। পড়শিরা বলে, ‘একে জবাই করে ফেল।’ সফর আলী রাগ করে বলেন, ‘এই কথা কেউ মুখেও আনবে না।’

ধান কাটা শেষে হাওরের পানি শুকিয়ে যায়। এ সময় পর্যাপ্ত ঘাসের জন্য রাখালেরা গরু আর সঙ্গে দু-তিন দিনের চাল ডাল নিয়ে হাওরে গিয়ে থাকে। আবার ঘুরে এসে আবার যায়। এভাবেই শুকনা মৌসুমে গরুদের ভালো ঘাসের জোগান দেয়।

একদিন ফেরার পথে রাখালেরা দেখে আটআনি খাদের মধ্যে মরে পড়ে আছে। যাওয়ার পথে খাদে পড়ে গিয়েছিল। উঠতে পারেনি, তারা হয়তো খেয়াল করেনি। বাড়ি ফিরে কর্তার কাছে ভয়ে ভয়ে ক্ষমা চাইতেই তিনি বললেন, ‘এতে তোমাদের দোষ নেই। আটআনি বুড়ো হয়ে গিয়েছিল। তবে আমি শান্তি পাচ্ছি এই ভেবে যে, আমি আমার কথা রাখতে পেরেছি।’