'আমেরিকায় আনারকলি'

আলেয়া চৌধুরী
আলেয়া চৌধুরী

কবি আলেয়া চৌধুরীর বই ‘কাব্যসমগ্র’। শেষ ফ্লাপে পাই কবির সংক্ষিপ্ত জীবনী। এক বাঙালি মুসলমান ঘরের বালিকা ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে এবং আর ফিরে যায়নি। নানা পথ পেরিয়ে ১৮ বছর হওয়ার আগে মাছ ধরার নৌকায় আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেছে মায়ামিতে। এখন তিনি নিউইয়র্কের বাসিন্দা। কবি অসীম সাহার কাছ থেকে এই সংগ্রামী নারীর টেলিফোন নম্বর সংগ্রহ করি।

২০১৭ সালে আমেরিকায় যাওয়ার সুযোগ হয়। নিউইয়র্কের হোটেলে বসে রাত ১০টায় ফোন করলাম কবি আলেয়া চৌধুরীকে। টেলিফোনে জানতে চাইলাম, তাঁর সংগ্রামী জীবনের কথা। তাঁর জীবনসংগ্রামের ওপর একটি উপন্যাস লিখতে চাই। তিনি না করে দিলেন। কিন্তু নদী তো বহমান। সেই স্রোতের টানে কবি পরদিন রাতে ফোন করলেন। টেবিলে খাতা-কলম ছিল। তিনি প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা কথা বললেন, শোনালেন জীবনের চমকপ্রদ কাহিনি। তার পরদিন আবার ৫০ মিনিট। দেশে ফিরে আসি। বই লেখা শুরু করি। মাঝে মাঝে কবি ফোন করেন নিউইয়র্ক থেকে, শুক্রবারে শুক্রবারে। আমি লিখতে থাকি। কোথাও আটকে গেলে তথ্য ধার নেই, অপেক্ষা করি কবির টেলিফোনের। আমার বই লেখা শেষ করি। উপন্যাসের নাম দিই ‘আমেরিকায় আনারকলি’। ২০১৯ সালের একুশের বইমেলায় বইটি প্রকাশ পায়। উৎসর্গ করা হয় ‘কবি আলেয়া চৌধুরী/জীবনযুদ্ধের এক সাহসী নারী’কে। প্রকাশক ‘মুক্তচিন্তা’। পৃষ্ঠা সংখ্যা ১১২।

ঢাকায় একটি প্রকাশনা উৎসব করি । প্রধান অতিথি ছিলেন কবি অসীম সাহা, বিশেষ অতিথি কবি-সাংবাদিক সোহরাব হাসান। আলোচনা করেন কথাশিল্পী আন্দালিব রাশদী ও কবি শাহজাদী আঞ্জুমান আরা। সভাপতিত্ব করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কবি গোলাম মোহাম্মদ। কবির অনুরোধে এসেছিলেন নিউইয়র্ক থেকে কবি রওশন হাসান। অনেক সুধীজন উপস্থিত ছিলেন। হলভর্তি দর্শক শুনেছেন এক অসামান্য নারীর সংগ্রামী জীবনের চমকপ্রদ কাহিনি। সবাই অভিভূত, বিস্মিত। বর্ণিল আলোচনাকে অতিক্রম করে একটি নাম উচ্চারিত হল সবার মুখে মুখে—‘কবি আনারকলি, তোমাকে চিনেছি আমরা, আমরা তোমাকে নিয়ে গর্ব করি, তুমি আমাদের গৌরব কবি আলেয়া চৌধুরী। অযুত অভিবাদন তোমাকে।’ আজ সেই অভিবাদন নেওয়ার কেউ নেই।

আলেয়া চৌধুরী (Aleya Chowdhury) এক সংগ্রামী নারীর নাম। আজীবন তিনি সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু দুরারোগ্য ক্যানসারের কাছে তাঁর হেরে যেতে হল। নিউইয়র্কে রডল্যান্ডে তাঁর বাসভবনে একাকী ৩ আগস্ট চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর।

স্বাধীনতার আগে, ঘরের প্রিয়জনকে বাঁচাতে প্রায় কপর্দকহীন স্কুল বালিকা কাউকে না জানিয়ে ট্রেনে চড়ে ঢাকায় চলে আসেন। সেই শুরু। তারপর আর পেছনের দিকে তাকাননি। ওই বয়সেই কে যেন বলেছিল তাকে, সামনের টানে না এগুলো পেছন এসে ঘিরে ধরবে। রেলস্টেশনে দিনরাত কাটে, খেয়ে-না খেয়ে। শুরু হয় বস্তি জীবন। সব বাঁধা পেরিয়ে আলেয়া চৌধুরী এ সময় হয়ে ওঠেন ঢাকা মহানগরের প্রথম নারী বাস কন্ডাক্টর। একসময় ঠাঁই হয় আজিমপুরে সলিমুল্লাহ এতিমখানায়। পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখির হাতেখড়ি এ সময়েই। পাশেই ছিল দৈনিক আজাদ অফিস। সেখানে একদিন সাহস করে ঢুকে ছোটদের পাতা যিনি দেখেন, তার কাছে পৌঁছে যান। অভিভাবকহীন এক ছন্নছাড়া কিশোরীর পথ চলা বাঁক নিতে থাকে, ক্ষুধার তাগিদে শুরু করেন খবরের কাগজ বিক্রি করা। রাত কাটে কারও বারান্দায়, কখনো ঝুপড়ি ঘরে।

এক লেখক মুরব্বির হাত ধরে একদিন পৌঁছান মতিঝিলে। বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টিতে ধরা পড়েন আলেয়া চৌধুর। বলেন, প্রতিদিন একটি করে দৈনিক ইত্তেফাক আমার ধানমন্ডির বাসায় পৌঁছাতে পারবি? আলেয়ার উত্তর, এতদূর কীভাবে যাব? তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কেন, ডাবল ডেকারে যাবি’। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত চলেছে এই আসা-যাওয়া। একদিন পৌঁছে যান প্রিয় খালাম্মা, কবি সুফিয়া কামালের কাছে। তাঁর স্নেহের মায়ায় বাঁধা পড়েন। ১৯৭১ সালে বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে যান মুন্সিগঞ্জে। মিশে যান মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে।

দেশ স্বাধীন হয়, কিন্তু আলেয়া চৌধুরী কর্মহীন। এই সময় সুযোগ ঘটে একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসন কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হওয়ার। একান্ত সান্নিধ্য পান কবি সুফিয়া কামাল ও অধ্যাপক নীলিমা ইব্রাহিমের। সময় হলে চলে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি চত্বরে, শরিফের ক্যানটিনে কবি-বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন। শুধু চা, আর কিছু কেনার সংগতি নেই। শেখেন গাড়ি চালানো, লাইসেন্স পান। কিন্তু স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশের অস্থির সময়ে একজন নারী গাড়িচালকের কোনো চাহিদা নেই। খবর পেয়ে যান ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাসে। চালক নিয়োগ দেবে তারা। পরীক্ষা দিলেন, পাস করলেন। কিন্তু ওই যে নারী...কর্তাব্যক্তিকে ধরলেন। ওরা রাজি হলেন, আলেয়া চৌধুরী পেলেন গাড়ির চাবি। এত গাড়ির চাবি নয়, জীবননাট্টের চাবি। কর্মকর্তা বদলি হলেন তেহরানে। ড্রাইভার আলেয়া চৌধুরীও তার সঙ্গী হলেন। সেখান থেকে পশ্চিম জার্মানির বনে।

কুমিল্লার যে বালিকা দেখেছে বাংলাদেশের বৃষ্টি, জ্যোৎস্না, ক্ষুধা, সেই তেহরানে এসে পেল গোলাপ ফুল, শীতের বাতাস, লেফট হ্যান্ড ড্রাইভ। বনে এসে পেল ইউরোপীয় সভ্যতার দেখা, একই সঙ্গে তুষারপাত, মুক্তি ও স্বাধীনতার স্বাদ। এবার স্বপ্ন আমেরিকায় যাওয়া। দালালের শরণাপন্ন হলেন। প্রথমে জর্ডানে, তারপর আম্মান থেকে বাহামা দ্বীপপুঞ্জে। এক শেষরাতে ১২ পুরুষ বাঙালিসহ উঠলেন মাছ ধরার নৌকায়। নৌপথ আটলান্টিক মহাসাগর। ওপারে আমেরিকার মায়ামি।

আলেয়া চৌধুরীর বয়স তখন কত? কবি নিজেই বলেছেন, আমি তখন ১৮ বছর পার করিনি। হঠাৎ নৌকা থেকে নেমে গেল, পা রাখলেন আমেরিকার মাটিতে। ধীরে ধীরে উঠে পড়লেন রাস্তায়। পুলিশ ধরে ফেলল। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, আমি কপর্দহীন, এই জীবনে কোনো অপরাধ করিনি, ছেড়ে দাও। তাঁকে ছেড়ে দিল, কিন্তু জেনে নিল নৌকার খবর। শুরু হলো জীবননদীর সবচেয়ে বড় বাঁক পরিবর্তন। কোনো দিন ঘাস কেটেছেন, কোনো দিন করাত দিয়ে গাছ কেটেছেন। দিন, মাস, বছর পেরিয়ে বহু ত্যাগ আর সংগ্রামের ফসল কবি আলেয়া চৌধুরী পেলেন কাঙ্ক্ষিত গ্রিনকার্ড। নিজের বাসা হলো নিউইয়র্কে। নিজেকে নানা কাজে যুক্ত করলেন। কিন্তু দুরারোগ্য ব্যাধি তাঁকে থামিয়ে দিল। কবি আলেয়া চৌধুরী বেঁচে রইলেন আমাদের স্মৃতিতে আর কবিতার পঙ্‌ক্তিতে পঙ্‌ক্তিতে।