বিশ্বজুড়ে স্বস্তি ২০২২ সালে

বিল গেটস
বিল গেটস
>

বিল গেটস প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা। দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠানটিকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। এখন সমাজসেবামূলক কাজ করে যাচ্ছেন বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে। করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় তাঁর ফাউন্ডেশন বিশ্বের সব মানুষের কাছে টিকা পৌঁছে দেওয়ার ব্রত নিয়ে টিকা উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও রাজনীতিবিষয়ক সাময়িকী অয়্যারড-এর সঙ্গে সম্প্রতি তিনি কথা বলেছেন করোনাভাইরাস মহামারি, এই মহামারি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা, টিকা উদ্ভাবন ও জনমানুষের কাছে সে টিকা পৌঁছানো নিয়ে। অয়্যারড-এর ওয়েবসাইটে গত শুক্রবার সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রশ্ন: আপনি অনেক বছর ধরেই একটি বৈশ্বিক মহামারি নিয়ে সতর্ক করে আসছিলেন। আজ তেমনই একটি মহামারি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। মহামারি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র যা করেছে, তা নিয়ে কি আপনি হতাশ?

বিল গেটস: হ্যাঁ। তিনবার হতাশ হয়েছি। প্রথমবার হতাশ হয়েছি এই মহামারির আগে, ২০১৫ সালে। সে সময় থেকে আমরা যদি রোগ শনাক্ত, চিকিৎসা ও টিকা উদ্ভাবনের প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতাম এবং কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন, তা যদি অনুসন্ধান করতাম, তাহলে আমরা নাটকীয়ভাবে মহামারি মোকাবিলা করতে পারতাম। তারপর হতাশ হয়েছি চলমান মহামারির প্রথম কয়েক মাসে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যিকভাবে পরীক্ষা কার্যক্রম শুরুর অনুমতিই দেয়নি, প্রথম দিকে যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ সংস্থার (সিডিসি) মাধ্যমে খুব স্বল্পসংখ্যক পরীক্ষা করেছে এবং তারা মূলত মানুষকে পরীক্ষাই করতে দেয়নি। ভ্রমণনিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে বড্ড দেরি করে। মহামারির প্রথম কয়েক মাস পার না হতেই আমরা মাস্কের বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছি, কিন্তু এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বটা গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন: আপনি কি বিস্মিতও?

বিল গেটস: যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা দেখে আমি বিস্মিত। রোগতত্ত্বে বিশ্বের সবচেয়ে জ্ঞানী-গুণী মানুষগুলো কাজ করেন সিডিসিতে। আমি তাঁদের কাছে আরও ভালো কিছু আশা করেছিলাম। হোয়াইট হাউস কিংবা অ্যান্থনি ফাউসি (যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ ও করোনা মোকাবিলায় হোয়াইট হাউসের টাস্কফোর্সের অন্যতম সদস্য) নয়, আপনি এই মহামারিতে সিডিসিকে সম্মুখভাগে প্রত্যাশা করবেন। কিন্তু তারা তা ছিল না। বরং তারা শুরু থেকেই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। আমরা সিডিসিকে ডাকাডাকি করলাম, কিন্তু তারা পরামর্শ দিল যে আমাদের হোয়াইট হাউসের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এখন তারা বলছে, ‘দেখুন, আমরা ব্যাপক হারে পরীক্ষা করছি, আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারব না।’

প্রশ্ন: আপনার কী মনে হয়, এই ব্যর্থতা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর, নাকি শীর্ষ নেতৃত্বের?

বিল গেটস: আমরা যেকোনো সময়ই (পরিস্থিতির) ময়নাতদন্ত করতে পারি। মহামারি এখনো চলছে, কাজেই আমাদের মনোযোগটা সেদিকেই থাকা উচিত। মার্চের পর থেকে সিডিসিকে প্রয়োজনীয় কাজ করতে দেয়নি হোয়াইট হাউস। অন্য দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পার্থক্য কেবল শুরুর দিকটাতেই ছিল না, পরবর্তী সময়েও রয়ে গেছে। এই যেমন মাস্ক ব্যবহারে যে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হয়নি। এটা সিডিসির ভুল নয়। আমার তো মনে হয়, এপ্রিল থেকে তারা (সিডিসি) ভালোই কাজ করছে। কিন্তু সে ভালো কাজের সুফল আমাদের কাছ পর্যন্ত পৌঁছায়নি।

প্রশ্ন: এই পরিস্থিতিতে কি আপনি আশাবাদী?

বিল গেটস: হ্যাঁ। আপনাকে স্বীকার করতেই হবে, লাখো-কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে গেছে, তবে রোগ শনাক্ত, চিকিৎসা পদ্ধতি ও টিকা উদ্ভাবনে যে কাজ চলছে, তা সত্যিই দারুণ। আর সেটাই আমাকে, বিশেষত ধনী দেশগুলোর ক্ষেত্রে, আশাবাদী করেছে যে ২০২১ সালের শেষ নাগাদ এই মহামারির ইতি টানতে পারব আমরা। তবে বাকি বিশ্বের জন্য স্বস্তি আসবে ২০২২ সালের শেষ নাগাদ। আর এটা সম্ভব হবে কেবল ব্যাপক মাত্রায় দ্রুতগতিতে টিকা উদ্ভাবন চেষ্টার কারণে। আমরা যখনই এই সাফল্য পাই না কেন, তত দিনে ম্যালেরিয়া, পোলিও ও এইচআইভি মোকাবিলার চেষ্টায় অনেক বছর হারিয়ে ফেলেছি। ২০২০ সালের শুরুতে আমরা যে অবস্থানে ছিলাম, সেই অবস্থানে ফিরতে আমাদের আরও বেশ কয়েক বছর লাগবে। বর্তমান পরিস্থিতি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি নয়।

প্রশ্ন: আমরা এখন টিকা নিয়ে কথা বলতে চাই, যাতে আপনার ফাউন্ডেশন বিনিয়োগ করছে।

বিল গেটস: মহামারির আগে আমরা আরএনএ টিকায়, যেমন মডার্না, ফাইজার/বায়োএনটেক ও কিওরভ্যাকের টিকার অনেক সম্ভাবনা দেখেছি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের টিকা কেবল ধনী রাষ্ট্রগুলোর জন্যই সহায়ক হতে পারে। এই টিকাগুলোর উৎপাদন প্রক্রিয়া, উৎপাদনের হার বৃদ্ধিতে বাধার কারণেই এমনটা হবে। এই টিকাগুলো স্বল্প মূল্যের হবে না। এমন পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে অ্যাস্ট্রাজেনেকা (ব্রিটিশ-সুইডিশ বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান) কিংবা জনসন অ্যান্ড জনসনের (যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান) দিকে তাকাতে হবে। প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, টিকার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। তবে টিকা কত দিন সুরক্ষা দেবে, প্রবীণদের শরীরে টিকার কার্যকারিতা, কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কি না ইত্যাদি অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো পাওয়া বাকি। মানবদেহে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার বিষয়ে প্রশ্নটির জবাব পাওয়া যাবে।

প্রশ্ন: আমরা যেভাবে টিকার পেছনে ছুটছি, তাতে কি ততটা নিরাপদ ও কার্যকর নয়, এমন টিকাও অনুমোদন পেয়ে যেতে পারে বলে আপনার আশঙ্কা রয়েছে?

বিল গেটস: হ্যাঁ। চীন ও রাশিয়ায় পূর্ণোদ্যমে কাজ চলছে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, বিশ্বের কোথাও না কোথাও কিছু এমন টিকা রোগীদের ওপর প্রয়োগ করা হবে, যা পুরোপুরি পর্যালোচনা ছাড়াই বাজারে চলে আসবে। তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানতে আমাদের তিন থেকে চার মাস সময় লাগবে। যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ) এখনো টিকার কর্মক্ষমতার প্রমাণের ওপরই নির্ভর করছে। রাজনৈতিক চাপ থাকা সত্ত্বেও তারা পেশাদার আচরণই করে চলেছে।

প্রশ্ন: এবার আসি চিকিৎসা পদ্ধতিতে। আপনি যদি করোনা সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতেন, তাহলে কী ধরনের চিকিৎসা আপনি চাইতেন?

বিল গেটস: রেমডেসিভির। দুঃখজনক বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্রে এই ওষুধের পরীক্ষা এতটাই গোলযোগপূর্ণ ছিল যে এর কার্যকারিতার প্রমাণ খুব সামান্যই পাওয়া গেছে। ডেক্সামেথাসোনের ওপরও নির্ভর করতাম, যদি রোগটা একেবারেই জটিল আকার ধারণ করে থাকত। এই ওষুধ তুলনামূলক অনেক সস্তা।

প্রশ্ন: আপনি রাজনীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চান। আপনার আগ্রহ সবচেয়ে বেশি জনস্বাস্থ্য ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা নিয়ে। কিন্তু বর্তমানে দেশের নেতৃত্বে যিনি রয়েছেন, তাঁর কারণে এই দুই খাত পিছিয়ে পড়েছে। সে ক্ষেত্রে আপনি কি রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য বিনিয়োগের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করছেন?

বিল গেটস: যুক্তরাষ্ট্রে যিনিই নির্বাচিত হোন না কেন, আমরা তাঁর সঙ্গেই কাজ করতে চাই। আশা করি, জনগণই বর্তমান প্রশাসনের কাজকর্ম মূল্যায়ন করে রায় দেবেন। আমি রাজনৈতিক বিষয়ে পয়সা খরচ করা পছন্দ করি না। এই মহামারি যদিও পরিষ্কার করেছে যে আমাদের আরও ভালো কিছু প্রত্যাশা করা উচিত, তবে সে বিষয়টি প্রচারের জন্য অন্য অনেক মানুষ রয়েছেন।

প্রশ্ন: এই মহামারিতে আপনার জীবনে কী কী পরিবর্তন এসেছে?

বিল গেটস: আমি প্রচুর ভ্রমণ করি। ধরা যাক, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁকে আমার বলা দরকার, ‘করোনাভাইরাসের টিকার জন্য কিছু অর্থ দিন।’ তাহলে বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরতে আমি সশরীর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যেতাম। কিন্তু জিএভিআই (টিকা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের বৈশ্বিক জোট) সম্মেলনে আমি বাড়িতে বসেই যোগ দিয়েছি, সেদিন শুধু একটু আগেভাগে ঘুম থেকে উঠেছি। আমার সন্তানেরা এখন বাড়িতে এত সময় কাটায়, যা আমি কখনো ভাবিইনি। বিষয়টি আমার জন্য অত্যন্ত সুখের। আমি এখন আরও বেশি খাবার রান্না করি, দিনে দিনে রান্নায় আরও দক্ষ হয়ে উঠছি।

প্রশ্ন: আপনি কী ধরনের মাস্ক ব্যবহার করেন?

বিল গেটস: আমি খুব সাধারণ মাস্ক ব্যবহার করি। প্রতিদিনই মাস্ক পরিবর্তন করি। আমার হয়তো একটি ডিজাইনার মাস্ক বা এমন সৃজনশীল কিছু থাকা দরকার ছিল। কিন্তু সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করেই আমি সন্তুষ্ট।