যেভাবে কাটাবেন করোনাকালীন সামার

সামারে যেকোনো ধরনের পোশাক পরা যায় আরামে। মডেল: শারমিন সোনিয়া
সামারে যেকোনো ধরনের পোশাক পরা যায় আরামে। মডেল: শারমিন সোনিয়া

নিউইয়র্কে আনুষ্ঠানিক সামার বা গ্রীষ্ম জুনে শুরু হয়ে চলে সেপ্টেম্বর অবধি। শীতের জড়তা কাটতে না কাটতেই চলে আসে স্প্রি বা বসন্ত। বসন্তের ভালোবাসার মাসগুলো চোখের পলকে উড়ে যায়। কিন্তু তখনো ভালো করে উষ্ণ হয় না বাতাস। সাগরের জল তখনো কঠিন শীতল। কেবল ফুল, পাখি, মৃদুমন্দ দখিনা বাতাস হৃদয়-মন ছুঁয়ে যায়। তাইতো রক্ত টগবগ করা, মন চনমন করা গ্রীষ্মের প্রতীক্ষায় বসে থাকে নগরবাসী। সামারের পরে আসে ফল, তারপরই আবার জেঁকে বসে শীত।
আমার লেখায় গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত, বসন্ত শব্দগুলো ব্যবহার করার জন্য ছোট্ট একটু কৈফিয়ত আছে। আমরা অভিবাসী বাঙালি যারা এখানে দীর্ঘদিন বসবাস করছি, আমাদের সঙ্গে খুব ধীরে ধীরে স্বদেশি বাঙালিদের খানিকটা অদৃশ্য দূরত্ব ও পার্থক্য তৈরি হয়। তা এত সূক্ষ্মভাবে হয় যে, আমরা কখনো পরিবর্তনটি অনুভব করি না। কিন্তু আমাদের কথায়, কাজে স্বদেশিরা তা দেখেন বা অনুভব করেন। তাই আমাদের প্রবাসীদের তারা বলেন ডায়াসপোরা। আমাদের লেখনিও নাকি ডায়াসপোরা সাহিত্য। যেমন, আমরা গ্রীষ্মকে সামার, শরৎকে ফল বসন্তকে স্প্রিং, হেমন্তকে অটাম এবং শীতকে উইন্টার বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। এগুলো আমাদের কথ্য বাংলার সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। আমরা নিজের অজান্তেই ভাষার এই জগাখিচুড়ি তৈরি করেছি। তাই গ্রীষ্ম আমাদের কাছে সামার হয়ে আসে।
সামার মানেইতো নিউইয়র্কের আকাশে ঝলমলে রোদ। সামার মানেই সাগরের উত্তাল জলে ঝাঁপিয়ে পড়া, সামার মানেই রৌদ্দুরে পিঠ খুলে ঘাসের ওপর শুয়ে থাকা, দূরে বহু দূরে যেদিকে খুশি হারিয়ে যাওয়া। তাই সামার নিউইয়র্কবাসীর কাছে অতিপ্রিয় ঋতু। সামার এলেই শরীর থেকে শীতের জমে থাকা আলস্য, মেদ, চর্বি ঝরাতে নিউইয়র্কবাসী গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে।
কিন্তু ২০২০ সালের করোনাকালীন সামারটা নিউইয়র্কবাসীর জন্য অন্যরকম। বছরটি শুরুই হয়েছিল বিষবাষ্প নিয়ে। প্রবল শীত আর তুষারে যখন জনজীবন হয়ে পড়ে খানিকটা শ্লথ, ঠিক তখনই মহামারি এসে হানা দিয়েছিল বিশ্বে। আর নিউইয়র্ক হয়ে উঠেছিল পৃথিবীর মধ্যে করোনার রেড জোন। ভয়াবহ মৃত্যুপুরী। নগরজুড়ে শুরু হয়েছিল মৃত্যু মিছিল। বাতাসে লাশের গন্ধ, স্বজন হারানোর হাহাকার।
অজস্র মৃত্যুকে পার করে নিউইয়র্ক মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে ঘুরে দাঁড়াতে। করোনাকালীন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে একটি ‘নিউ নরমাল’ জীবন তৈরির জন্য। একজন নিউইয়র্কবাসী হিসেবে আমি নিজেও আপ্রাণ চেষ্টা করছি, ঘুরে দাঁড়াতে, এই ’নিউ নরমাল’ জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনে সামঞ্জস্য আনতে।
করোনাকালীন এবারের সামার আমরা কীভাবে উদ্‌যাপন করতে পারি?

মহামারি কিন্তু এখনো আমাদের ছেড়ে যায়নি। আর সহসা যাবে বলেও মনে হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা কোভিড-১৯–এর আচরণে খুবই সন্দিহান।
আসুন এই মহামারিকালে ভালো থাকার জন্য একটি রিচুয়াল তৈরি করে ফেলুন। সারাক্ষণ ঘরে বসে না থেকে একটু বাইরে ঘুরে আসুন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাইরে ঘুরে এলে শরীর ও মন দুটিই ঝরঝরে হবে।
মাস্ক পরেই হাঁটুন, জগিং করুন বা দৌড়ান। সাইকেল চালান, সাঁতারও কাটতে পারেন। ব্যায়াম হিসেবে সাঁতার খুব ভালো। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আউটডোর পুলে বা সাগরে স্বচ্ছন্দে সাঁতার কাটা যায়। শরীরের পর্যাপ্ত রোদ লাগান। ভিটামিন ডি’র অভাব পূরণে রোদ একটি প্রাকৃতিক উপাদান।
রাতে ঘুমানো ও সকালে ওঠার সময় ঠিক করে রাখুন। পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা ভালো অভ্যাস। ভোরে দিন শুরু হলে হাতে প্রচুর সময় পাওয়া যায়।
কারও যদি শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, দুর্বলতা ও মাথা ঝিমঝিম করে, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
‘যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ’, এরই মাঝে চলবে আমাদের বেঁচে থাকার সুস্থ থাকার লড়াই। অনেকেরই লকডাউনে ঘরে বসে থেকে বাড়তি মেদ জমেছে শরীরে। তাই করোনাকালীন নিয়মনীতি মেনেই তৈরি করুন নতুন রিচুয়াল। যতক্ষণ বেঁচে আছি, নিজেকে ফিট রাখতে হবে। সুস্থ থাকতে হবে।
খেতে হবে প্রচুর তরলজাতীয় খাবার
পানিশূন্যতার কারণে স্ট্রোকের মতো ঘটনাও ঘটতে পারে। শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রচুর পানি ও বিভিন্ন ফলের ফ্রেশ জুস পান করতে হবে। আনারস, বেল, বাঙ্গি, লেবু, তরমুজ ইত্যাদির জুস বা মুদি তৈরি করা খুব সহজ। কমলা, আম, তরমুজ ইত্যাদিতে রয়েছে বেটা ক্যারোটিন। কালো ও লাল সবজিতে থাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা আমাদের শরীরের তারুণ্য ধরে রাখে। তবে জুস ও মুদি হতে হবে চিনি ছাড়া। বাদ দিন চা, কফিসহ ক্যাফেইনযুক্ত যেকোনো পানীয়।
শাকসবজি ও ফল
খাদ্যতালিকায় যোগ করুন প্রচুর শাকসবজি। কড়াইশুঁটি, ব্রকোলি, বিট, ছোলা, বিভিন্ন ধরনের ডাল, চানা, তিল, কুমড়ো ইত্যাদি। হালকা খাবারের মধ্যে রয়েছে সিদ্ধ মাংস, মাছ, ভাত, বিনস, ডিম, স্যামন, আটার রুটি, দুধ, মাখন ইত্যাদি। ঘরে বানানো খাবারের ওপর বেশি জোর দিন মহামারির এই সময়ে।
জাঙ্ক ফুড বাই বাই
জাঙ্ক ফুড বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত খাবারে প্রচুর ক্যালরি, সোডিয়াম ও সম্পৃক্ত চর্বি থাকে। এ ধরনের খাবার এড়ানোই উচিত।
মাস্ক, গ্লাভস, পোশাক-আশাক, বাইরে বেরোলে পোশাকের মতোই মাস্ক ও গ্লাভস এখন অত্যাবশ্যক। গরমকালে ঢোলা ও সুতি কাপড় পরা সবচেয়ে আরামদায়ক। এ ছাড়া ঢোলা পোশাকে বাতাস চলাচল ভালো হয় বলে আমাদের শরীরে আরামবোধ হয়। সুতি কাপড় আমাদের সানবার্ন থেকেও রক্ষা করে।
রোদে সানগ্লাস, মাথায় ক্যাপ
বাইরের কড়া রোদ থেকে চোখ ও মুখমণ্ডল রক্ষা করতে সানগ্লাস, মাথায় ক্যাপ ব্যবহার করা ভালো। ছাতাও ব্যবহার করা যায়। সৈকতে গেলে সানস্ক্রিন ও যথাযথ বিচের পোশাক পরা প্রয়োজন।
স্ট্যাটিক অথবা ডাইনামিক
এ সময়ে স্ট্যাটিক ব্যায়ামের ওপর জোর দিন। যেমন ইয়োগা, স্ট্রেচিং। তবে ওজন তোলা, কার্ডিও ইত্যাদিও চলতে পারে। মহামারির কারণে জিম, ইয়োগা স্টুডিও এখন বন্ধ। সুতরাং ঘরেই রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড, গ্র্যাভিটি বল, ইয়োগা ম্যাট ইত্যাদি দিয়ে প্রফেশনাল জিম সেটিংয়ের মতোই ব্যায়াম করা সম্ভব। ফ্রিহ্যান্ড বা যোগব্যায়াম করেও নিজেকে ফিট রাখা যায়।
সুস্থ থাকলে মন এমনিতেই ফুরফুরে থাকে। সুস্থতার জন্য দরকার সুষম খাবার আর শারীরিক পরিশ্রম। ভবিষ্যতে কোভিড-১৯–এর মতো অনাহূত রোগ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের শরীরে তৈরি করতে হবে শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা।