বাঙালিদের মধ্যে মারামারি

কথায় আছে, ‘ঘি দিয়ে ভাজ নিমের পাত/ নিম ছাড়ে না আপন জাত’। কলহপ্রবণ জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের ‘খ্যাতি’ রয়েছে। এই খ্যাতি বা কুখ্যাতির জন্য নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সব মানুষ দায়ী নয়। বলা যায়, গুটিকয় মানুষের কারণে বাঙালির কপালে এমন দুর্নাম জুটেছে।
বাংলাদেশের মানুষ যে এমনিতে শান্তিপ্রিয়, তার ভূরি ভূরি স্বীকৃতি মিলবে একটু খুঁজলেই। কিন্তু ওই যে ‘এক মণ দুধে এক ফোঁটা চোনা’ যথেষ্ট। বাঙালির ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটেছে। নিজভূম কিংবা পরদেশ যেখানেই গেছে সে, সিন্দাবাদের ভূতের মতো তাকে অনুসরণ করেছে এই দুর্গতি।
আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনেক বছর ধরে আছেন। এখন পর্যন্ত বহু অর্জন তাঁদের পায়ে এসে লুটিয়েছে। শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে বহুজাতিক আমেরিকাতেও সুনাম কুড়িয়েছেন প্রবাসীরা। আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে বাংলাদেশিদের পৌঁছাতে এই সুনাম সহায়ক হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু ইদানীং এই সুনামের গায়ে কলঙ্ক জমা হতে শুরু করেছে।
গুটিকয় মানুষের জন্য বদনামের ভাগীদার হতে হচ্ছে বাংলাদেশি আমেরিকানদের। কখনো আর্থিক জালিয়াতি, কখনো ভোট জালিয়াতি, কখনো তুচ্ছ কারণে মারামারি, কখনো শঠতা, কখনো স্বদেশিদের ‘পিঠে ছুরি মারা’র মতো কাজ করে কিছু লোক পুরো বাংলাদেশি আমেরিকানদের কলঙ্কিত করছেন। সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ঘটল নিউইয়র্কেই। গাড়ি পার্কিং নিয়ে শুরু হওয়া তর্ক গড়িয়েছে মারামারিতে। পুলিশের সামনেই বাংলাদেশিদের দুই পক্ষ মারামারি করেছে, ভেঙেছে গাড়ি ও মোটরসাইকেল। এমনিতেই করোনাকালে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে নিউইয়র্কে অপরাধের হার বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে গোলাগুলি ও খুনের ঘটনাও। এগুলোর সঙ্গে আগে বাংলাদেশিদের নাম জড়িত হয়নি। কিন্তু এখন এই মারামারি ও ভাঙচুরের ঘটনায় বাংলাদেশের নামও সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত হলো, যা স্থানীয়দের আতঙ্কিত করেছে।
নিজেদের দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি করে কোনো কিছু অর্জন করা যায়নি, বরং শান্তিপ্রিয় জাতি হিসেবে থাকা পরিচিতি ও সম্মানের বিসর্জন হয়েছে। সঙ্গে স্থানীয় মার্কিন ও অন্য দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সামনে নিজ দেশ ও জাতি পরিচয়কে অপমান করার কাজটিও হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
দেশে হোক বা প্রবাসে হোক, একটি ক্ষুদ্র অংশের আচরণ কখনো বদলায় না। মুশকিল হচ্ছে, দেশে থাকলে এটি একজন বা দুজন ব্যক্তির ব্যক্তিগত সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু প্রবাসের বাস্তবতায় একই ঘটনা পুরো দেশের নাম ও তার সঙ্গে এই জাতির সবাইকেই জড়িয়ে ফেলে। প্রশ্নবিদ্ধ করে দিতে পারে সব অর্জনকে।
এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা হচ্ছে সেই নিমের মতো, যার তিতকুটে স্বাদ কিছুতেই বদলায় না। তাই এদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কাজটি করতে হয়। কাজটি করতে হবে বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতৃত্বকে। মনে রাখা জরুরি, আমেরিকায় বাংলাদেশি কমিউনিটি এখনো অনেক ছোট। মাত্রই এই কমিউনিটির কিছু উদ্যোগী লোক মূল স্রোতের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছেন। নিজেদের যোগ্যতায় প্রশাসনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থান করে নিয়ে উজ্জ্বল করছেন বাংলাদেশের মুখ। এই যাত্রায় যাতে এমন কিছু বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, যা সব স্তরে ‘বাংলাদেশ’ নামটিকেই হেয়প্রতিপন্ন করে। যেকোনো অবস্থায় নিজ দেশের সম্মানের বিষয়টি মনে রাখতে হবে। কারণ, এই পরিচয়কে পাশ কাটিয়ে কোথাও কিছু অর্জন করা যাবে না।