উর্দুর বিপক্ষে পাকিস্তানও

অধুনা একটি পাকিস্তানি প্রচারপত্রের অংশ:‘পাকিস্তান সৃষ্টিতে স্মরণীয় অবদানের জন্য আমরা কায়েদ-ই-আজমের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে এটা মানতে হবে, মানুষ হিসেবে তিনিও পুরোপুরি খাঁটি ছিলেন না। উর্দুকে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা ঘোষণা করে তিনি দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে বড় ভুলটি করেছেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে মেনে নেওয়ার সমালোচনা করলে তা অনেক পাকিস্তানির মর্মবেদনার কারণ হবে। কিন্তু মিথ্যা ও মায়ার জাল বুনে এটাকে উপেক্ষা করলে সমস্যার জটিলতাই বাড়বে, পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। চলুন আমরা খোলামেলা আলাপ করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালু থাকার ব্যাপারটি বন্ধ করে দিই। একই সঙ্গে উর্দু ভাষাকে আমাদের সম্মানও করতে হবে এবং যারা লিখতে বা বলতে চায়, তাদের সেই সুযোগ ও স্বাধীনতা দিতে হবে। স্থানীয় ভাষাকে সেই প্রদেশ বা জেলার দাপ্তরিক ভাষায় উন্নীত করাটাই শ্রেষ্ঠ সমাধান। ধীরে ধীরে নেটিভ ভাষাই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা। তা হলেই আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণসহ বিভিন্ন ভাষাভাষীর মধ্যে সৌহার্দ্য রক্ষা করে ঐক্যবদ্ধ থাকা, বিভিন্ন জাতিসত্তার মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা সম্ভব হবে। সুইজারল্যান্ডের মতো একটি বহু ভাষাভাষী দেশে যদি সফল বহুজাতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে, তাহলে পাকিস্তানেও পারে। বেশি দেরি হওয়ার আগে জাতির মঙ্গলের জন্য চলুন এই সিদ্ধান্তটি বদলে দিই।’পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে গেছে। পাকিস্তানের সচেতন নাগরিক সমাজের প্রশ্ন—আমরা কি চাই পাকিস্তানের আরও এক বা একাধিক অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক? পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই মনে করেন, উর্দু ভাষার চাদরে ঢেকে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার চেষ্টা সফল হবে না। কারণ উর্দু চাপিয়ে দিয়েই বিভেদের বীজ বপন করা হয়েছে। ১৯৪৮ সাল থেকেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, পাঞ্জাবিকে কেন রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করা হবে না? সিন্ধি কেন রাষ্ট্রভাষা হবে না? প্রধান যুক্তি, উর্দু পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মূলধারার সঙ্গে মিশে নেই, মূলত পাকিস্তানের প্রেক্ষাপটে উর্দু বহিরাগত মোহাজেরদের ভাষা। বর্তমান পাকিস্তান ভৌগোলিকভাবে চারটি প্রদেশে (পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) বিভক্ত হলেও ভাষা ও সংস্কৃতিগত বিভাজন আরও বেশি। সাংস্কৃতিক অনৈক্যের রূপটি পাকিস্তানে সহিংস। কোনো জাতি, কোনো নির্দিষ্ট ভাষাভাষী এতটুকুও ছাড় দিতে রাজি নয়। সেই প্রেক্ষাপটে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ধর্মীয় আবেগকে পুজি করে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার যে ব্যাখ্যাই দিন না কেন, আঞ্চলিক নেতৃত্ব ও ভাষাভিত্তিক বুদ্ধিজীবীরা শুরু থেকেই এর প্রতিবাদ করে এসেছেন। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলার দাবি বরাবরই উচ্চকণ্ঠ ছিল। এখন পাকিস্তানেও পাঞ্জাবি, পশতু, সিন্ধি, বেলুচি ও কাশ্মীরিকে উর্দুর সমমর্যাদায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি উঠেছে।তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলনের সূচনা সিন্ধুতে।১৯৪৮ সালের জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ ‘পাকিস্তান প্রভিনসিয়াল কনস্টিটিউশন (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডার’ জারি করলেন। এই আদেশ ছিল মূলত প্রাদেশিক রাজনীতির ওপর কুঠারাঘাত । এই আদেশের শক্তিতে যেকোনো প্রদেশে জরুরি অবস্থায় (কিংবা জরুরি অবস্থার আদেশ জারি করে) গভর্নর জেনারেলের পক্ষে প্রাদেশিক গভর্নর সার্বিক ক্ষমতা গ্রহণের এখতিয়ার লাভ করেন। কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় চলে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রাদেশিক সরকারগুলো তখন থেকে ক্ষোভ চেপে রাখতে শুরু করে, আর প্রাদেশিক সরকারের কেউ কেউ সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের দালালি শুরু করে দেন। যেমনটি করেছেন নুরুল আমিন, নাজিমুদ্দিন প্রমুখ। ১৯৪৮ সালের ২৩ জুলাই সিন্ধুর প্রাদেশিক সরকার করাচিকে পাকিস্তানের ফেডারেল রাজধানী করার প্রস্তাব দেয়। গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ, যাঁর জন্মও করাচিতে, প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং করাচি শহরকে ‘ফেডারেল টেরিটরি’ হিসেবে উর্দুর সরব উপস্থিতিতে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। তখনকার চিফ মিনিস্টার এম এ খুরো এই পরিকল্পনায় বাধা দেন। তিনি চাননি সিন্ধি ভাষাভাষী করাচি নগর উর্দুতে ছেয়ে যাক এবং ‘বিদেশি ভাষা’ উর্দুর কাছে সিন্ধি মার খাক। জিন্নাহ সিন্ধুর চিফ মিনিস্টার খুরোকে বরখাস্ত করেন। বলা হলো, খুরো একজন দুর্বল প্রশাসক ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক।ব্রিটিশ শাসনামলে সিন্ধু পৃথক মর্যাদাসম্পন্ন প্রদেশ হিসেবে বিবেচিত হতো। বাংলা ভাষার মতোই গোটা প্রদেশে সিন্ধির একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। ১৯৩০-এর দশকে সিন্ধি ভাষার পক্ষে আন্দোলনও হয়। ফলে ১৯৩৬ সালে সিন্ধুকে বোম্বে প্রেসিডেন্সি থেকে পৃথক করা হয়।১৯৪৭-এর ভারত ভাগ উপমহাদেশে ব্যাপক জনমিতিক পরিবর্তন ঘটায়। উত্তর প্রদেশ থেকে উর্দুভাষী শরণার্থীরা করাচিতে এসে বসত গাড়ে। পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের উর্দুভাষীরাও করাচিসহ সিন্ধুর বিভিন্ন স্থানে অভিবাসী হিসেবে চলে আসে। অন্যদিকে সিন্ধুতে বসবাসকারী হিন্দুরা দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়। এক সময় সিন্ধুর ৬৪ শতাংশ ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী। এই ব্যাপক জনমিতিক পরিবর্তনের পর করাচিতে শরণার্থী-মোহাজিরের আনুপাতিক হিসাব ১৯৫১ সালের আদমশুমারিতে দাঁড়াল ৫৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং হায়দরাবাদে ৬৬ দশমিক শূন্য আট শতাংশ। কার্যত সিন্ধু চলে গেল উর্দুর দখলে। শিক্ষা, চাকরি ও ব্যবসা হয়ে ওঠল উর্দুনির্ভর। পাকিস্তানের উদারপন্থী গবেষক তারিক রহমান তাঁর Language, Politics and Power in Pakistan : The case of Sindh and Sindhi-তে দেখিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকার উর্দুকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য সিন্ধি ভাষানির্ভর বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেয় এবং সিন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় করাচি থেকে হায়দরাবাদে সরিয়ে নেয়। তিনি লিখছেন, ‘আইয়ুবের শাসনের অবসান ঘটায় সিন্ধিরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। যদিও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের শাসনামলে ‘ওয়ান-ইউনিট’ বাতিল হয়ে যাওয়ায় সিন্ধি জাতীয়তাবাদীরা মনে করেন এবার তাঁদের ভাষা গুরুত্ব পাবে। কিন্তু এয়ার মার্শাল নূর খানের নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও অধিক গুরুত্ব প্রদান করে। আরও একবার পাকিস্তানের আদিভাষা আঞ্চলিক ভাষা হিসেবে প্রান্তবর্তী হয়ে পড়ল।’ সিন্ধির জন্য আবার শুরু হলো আন্দোলন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে উত্তাল পাকিস্তানে হয়ে গেল ভাষা দাঙ্গা—ল্যাঙ্গুয়েজ রায়ট।পাকিস্তানে উর্দুর অবস্থান পঞ্চম। উর্দুর ঐতিহ্য ও ভাষার সমৃদ্ধি নিয়ে অনেক বক্তব্য ও বিতর্ক রয়েছে। প্রথম প্রকাশিত উর্দু গ্রন্থ ‘দহ মজলিশ’ ১৭২৮ সালে মুদ্রিত। উর্দু শব্দটি প্রথম ব্যবহূত হয় ১৭৫১ সালে সিরাজুদ্দিন আরজুর রচনায়। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা পাঞ্জাবি সাতটি প্রধান আঞ্চলিক ভাষা। ১৯৮২ সালের পরিসংখ্যানের আগে সেরাইকি (পাঞ্জাবি ও সিন্ধি ভাষার মিশ্রণে গঠিত ভাষা) ভাষাকে পাঞ্জাবির একটি আঞ্চলিক রূপ বলেই মনে করা হত।উর্দুর আধিপত্য এবং অন্যান্য ভাষার প্রতি পদ্ধতিগত অবহেলা এক শ্রেণীর মানুষকে একই সঙ্গে মাতৃভাষা ও উর্দু থেকে সরিয়ে ইংরেজিতে সমর্পিত করেছে। তাদের সন্তানেরা সরাসরি ইংরেজি মাধ্যমকেই বেছে নিচ্ছে। কার্যত পাকিস্তানে এখন উর্দুর বিকাশ কিছুটা থেমে থাকলেও ইংরেজির অগ্রগতি লক্ষণীয়।কিন্তু ভাষার সংবেদনশীলতা এমনই, উর্দুবিরোধী আন্দোলন হয়তো এক সময় বিচ্ছিন্ন হওয়ার আন্দোলনে, স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হতে পারে। উর্দুর পক্ষে সংহতি সৃষ্টির যত যুক্তিই দেখানো হোক, শতকরা সাতভাগের শাসন শতভাগের মেনে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের এক বছর আগে ১৯৫১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের প্রধান স্যার সুলতান মোহাম্মদ শাহ আগা খান করাচিতে প্রদত্ত ভাষণে প্রশ্ন রাখেন : Is it (Urdu) the language of Bengal where the majority of Muslims live? Is it what you hear in the streets of Dhaka or Chittagong?—উর্দু কি বাংলার ভাষা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান? ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের রাস্তায় আপনি কি উর্দু শুনতে পান?আগা খানের লিখিত বক্তব্যটি সুরক্ষিতই আছে। বলাই বাহুল্য, তাঁর বক্তব্যটি উর্দুর বিপক্ষে হলেও কোনোভাবেই তা বাংলার সমর্থনে নয়। তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, পাকিস্তানের জনগণের এটা কি স্বাভাবিক ও জাতীয়ভিত্তিক ভাষা? এটা কি উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের ভাষা? এটা কি সিন্ধুর ভাষা? এটা কি পাঞ্জাবের ভাষা?যে ভাষাটি কারোরই নয়, যে ভাষার সঙ্গে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধন নেই, তা কেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে? অবশ্য তিনি ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হিসাবে হিসাবে হিন্দুকে সমর্থন করেছিলেন।ভারতে হিন্দির জন্য যে যুক্তি তিনি দেখিয়েন, তা পাকিস্তানে প্রয়োগ করলে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা হিসেবে একমাত্র বাংলারই হওয়ার কথা রাষ্ট্রভাষা; বাংলার পরই আসে পাঞ্জাবি। কেবল পশ্চিম পাকিস্তানকেই পাকিস্তান হিসেবে বিবেচনা করলেও ১৯৫১ সালে উর্দু ভাষাভাষী জনসংখ্যা ছিল কেবল শতকরা সাত দশমিক শূন্য পাঁচ ভাগ। আর পূর্ব পাকিস্তান সঙ্গে যোগ হলে উর্দু ভাষাভাষী শতকরা তিন ভাগের বেশি নয়। উর্দুর আধিপত্য বাংলা ভাষাভাষীরা মেনে নেয়নি। সে জন্যই এখনও পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীদের প্রশ্ন—আমরা কি চাই পাকিস্তানের আরও এক বা একাধিক অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক?: