আকারে ছোট, গুণে বড় লটকন

বাংলায় ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ বলে একটি কথা আছে। তেমনি এ দেশে বারো মাসে ফলও আছে হরেক রকমের। এসব মৌসুমি ফলের জন্য গ্রীষ্মের খ্যাতিই শীর্ষে—সে কথা সবার জানা। গ্রীষ্ম বিদায় নিলেও তার ফলের সম্ভার এখনো ফুরায়নি বাজারে। লিচু ঢের আগেই উঠে গেছে বাজার থেকে। আম-কাঁঠাল এখনো ফলের বাজারে তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। তবে লিচু-জাম-জামরুলের শূন্যস্থান পূরণ করতে এসে গেছে বর্ষার পেয়ারা, আনারস, লটকন প্রভৃতি।লিচুর মতোই গুচ্ছ গুচ্ছ লটকন এখন পাড়া-মহল্লা, অলিগলির ফেরিওয়ালার পসরা আর ফলের দোকানের সাজানো ঝুড়িতে সুশোভিত হয়ে আছে। সদ্যসমাপ্ত বিশ্বকাপের জাবুলানি বলটি যেমন নিখুঁত গোলাকার, তেমনি বাংলার ফলসম্ভারের মধ্যে লটকনও সুগোল ফলের অন্যতম। আকারে অবশ্য জাবুলানির মতো নয়, বরং মার্বেলের চেয়ে খানিকটা বড়। হলুদ রঙের ফলগুলো লম্বা বৃন্তের সঙ্গে গুচ্ছাকারে সন্নিবেশিত থাকে। কাঁচা অবস্থায় অবশ্য এর রং সবুজ। লিচু গোনাগুনতির হিসাবে বিক্রি হলেও ঢাকায় লটকন বিক্রি হয় ওজন করে। খুচরা দাম ৬০ থেকে ১৩০ টাকা কেজি। এক কেজিতে আকারভেদে ২৫ থেকে ৭০টি পর্যন্ত হয়।রাজধানীতে কারওয়ান বাজার লটকনের প্রধান আড়ত। কথা হচ্ছিল পাইকারি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ জহিরের সঙ্গে। তিনি জানালেন, প্রতিদিন এখানে নরসিংদী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ থেকে ঝুড়িতে করে তিন-চার ট্রাক লটকন আসে। প্রতি ঝুড়িতে থাকে ২০ কেজি, পাইকারি দাম ৮০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত। তিনি জানালেন, সবচেয়ে ভালো মানের লটকন কেজিতে হয় ২৫ থেকে ৩০টি। এগুলোর বেশির ভাগই এখন বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। খুচরা ফল বিক্রেতা হাবিব খান ও আনোয়ার হোসেন জানান, বরাবর এ রকমই থাকে লটকনের দাম। বিক্রি মন্দ নয়। প্রতিদিন প্রায় দুই ঝুড়ি বিক্রি হয়। তাঁরা পাইকারি কিনে আনেন ৫০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে।নরসিংদীর ওদিকটাতেই লটকনের ফলন বেশি। এ ছাড়া সিলেট, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাজীপুর—এসব জেলায়ও ইদানীং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লটকনের চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে নরসিংদীর বেলাব এলাকা এখন লটকনের গ্রাম বলেই পরিচিত হচ্ছে বলে কৃষিবিদ মৃত্যুঞ্জয় রায় উল্লেখ করেছেন তাঁর বাংলার বিচিত্র ফল নামের বইতে।লটকন আমাদের দেশি ফল। অঞ্চলভিত্তিক এর বেশ কিছু স্থানীয় নাম আছে। চট্টগ্রামে এর নাম হাড়ফাটা, সিলেটবাসী চেনে ডুবি নামে। ময়মনসিংহে বলে কানাইজু। এ ছাড়া লটকা, লটকাউ, কিছুয়ান —এসব নামেও ফলটি পরিচিত। আঙুরের মতো থোকায় থোকায় ধরে বলে ইংরেজিতে এর নাম Burmese grap। বৈজ্ঞানিক নাম Baccaurea sapida। গাছ ছোটখাটো ঝাঁকড়া ধরনের। পাতা ডিম্বাকৃতির, গাঢ় সবুজ। বসন্তে ফুল আসা শুরু। ফল পাকতে বর্ষা। ডুমুরের মতো লটকনও গাছের কাণ্ড ও মোটা ডালের বাকল ফেটে লম্বা বৃন্তে গুচ্ছাকারে ধরে। একটি গুচ্ছে কুড়ি থেকে ত্রিশটি পর্যন্ত ফল ধরতে পারে। লটকন বেশ পরিচিত ফল। সে কারণে কম-বেশি সবাই জানে এর মোটা খোসার ভেতরে তিন-চারটি রসাল কোষ থাকে, যেগুলোর স্বাদ অম্লমধুর। কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে জানা গেল, লটকন নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণামূলক কাজ হয়েছে। গবেষকেরা বারি-১ নামে লটকনের একটি উন্নতজাত উদ্ভাবন করেছেন।লটকনের পুষ্টিমান প্রচুর। আসলে আমাদের দেশি মৌসুমি ফলগুলোর প্রতিটিই স্বাদে যেমন বিচিত্র, তেমনি পুষ্টিমানেও অনন্য। লটকনে প্রচুর পরিমাণ রয়েছে ভিটামিন বি-২, ভিটামিন-সি। এ ছাড়া ফলটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। রোজ আমাদের দেহের জন্য যে পরিমাণ ভিটামিন সি প্রয়োজন, চারটি লটকন সেই চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। লটকনের ভেষজগুণও রয়েছে। এটি অত্যধিক তৃষ্ণা নিবারণ ও বমনের ভাব দূর করতে কার্যকর। শুকনো পাতার গুঁড়ো সেবনে ডায়রিয়া নিরাময় ও মানসিক চাপ কমে। কাজেই হাতের নাগালে থাকা দেশি ফলের স্বাদ যত বেশি, আস্বাদন করা যায় ততই ভালো।