আসুন, গণতন্ত্রের চর্চা করি

গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের কথকতার শেষ নেই। অথচ গণতন্ত্রকে আমরা আমাদের চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণে যে ধারণ করি না তা রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের কর্ণধারদের নানা কর্ম ও উচ্চারণে আজ পরস্ফুিট। গণতন্ত্রকে জীবনদর্শন হিসেবে কজন বিবেচনা করেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। গণতন্ত্রের নানা নানা আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও ধনবিজ্ঞানের আলোচনায় আছে। গণতন্ত্রের চুম্বক সংজ্ঞা কিন্তু তিনটি শব্দের সমাহার—লিবার্টি, ইকুয়ালিটি ও ফ্রাটারনিটি। বাংলায় স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব। এই শব্দত্রয়ের পেছনের ধারণা—সব মানুষ স্রষ্টার কাছ থেকে সমান সম্ভাবনা নিয়েই জন্মে, কিন্তু তার প্রস্ফুটন অসাম্য। এটা সামাজিক বিভাজন, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীদারিহীনতা ও হূদয়হীনতার কারণেই ঘটে থাকে। আমাদের মতো দারিদ্র্যপীড়িত, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার দেশে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।স্বাধীনতা কথাটি নানা সংগ্রাম, বিপ্লব ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে উচ্চকিত হলেও এটির নিগূঢ় অর্থ প্রায়শই বোধগম্য নয়। স্বাধীনতা শব্দটির সঙ্গে একটি শর্তবোধক শব্দও সংযুক্ত থাকে, সেটি হলো দায়িত্বশীলতা বা দায়বদ্ধতা। আজ ‘বাজিকরদের’ যে স্বাধীনতা বা জনপ্রতিনিধিদের যে আচরণ, তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই যোজক শব্দটির—যা স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলে—ব্যত্যয় ঘটছে বললে অত্যুক্তি হবে না। যে ব্যক্তি তার কর্মে বিবেকের উচ্চারণ শুনতে পায় না, তার কাছে মনুষ্যকর্মের নানা সীমাবদ্ধতা পরিদৃশ্য হয় না এবং নৈতিকতার উচ্চতর বিবেচনায় স্বাধীনতা ও অধিকারের নামে কৃত অনেক কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞান আমাদের যুক্তিবাদী হতে শিখিয়েছে। সেখানেও যুক্তি ও ব্যবহারিকভাবে যা ভালো বলে প্রমাণিত তাকেই গ্রহণীয় বলে বিবেচনা করা হয়েছে। কেবল অজ্ঞ বা ক্ষমতাদর্পী মানুষই নিজেকে নির্ভুল মনে করে।মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। কোনো মানুষ এককভাবে বা দলীয়ভাবে স্বাধীন হতে পারে না বা অধিকার ভোগ করতে পারে না। যেহেতু সব মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মায়, তাই সব মানুষের জন্য স্বাধীনতা একটি অনস্বীকার্য অধিকার। সে অধিকার খর্ব করার যেকোনো প্রচেষ্টা স্বাধীনতাকেই খর্ব করে। সম্প্রতি বিচার বিভাগের কর্মের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যে আইন পাস হয়েছে, সেটি গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও অধিকারকেই ক্ষুণ্ন করেছে। স্বাধীনতা রক্ষায় তাই নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়।২.সাম্য নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমাদের দেশে সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে। তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয়, ‘জনপ্রতিনিধিদের’ অধিকাংশের সম্পদের পরিমাণ আমাদের জাতীয় মাথাপিছু আয়ের কয়েক শ গুণ; কখনো কখনো কয়েক হাজার গুণ। এ থেকে বোঝা যায়, ক্ষমতার অলিন্দে যাঁরা আছেন, তাঁরা মালিক বনে গেছেন; তাঁরা প্রকৃত মালিকের ক্ষমতা হরণ করেছেন। সমতাভিত্তিক সমাজের সৃষ্টি হয় সমান সুযোগের বর্তমানত্বে। সব মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মায়—গণতন্ত্র যেহেতু এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে, সেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক মননের মানুষের কর্মের একটি সূত্র হলো, সব মানুষের জন্য সমান সুযোগের সৃষ্টি করা। এটা দয়া নয়, দায়িত্ব। আমরা অভাজনদের নানাভাবে দয়াদাক্ষিণ্য দেখিয়ে সন্তোষ পেতে চাই, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সমতার মর্মবাণী সব মানুষের জন্য সমানভাবে পৌঁছে দিতে যে সার্বিক কাঠামোগত পরিবর্তন, তাকে বাস্তব করতে তেমন উদ্যোগ নিতে অপারগ হই। আমাদের দেশে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর যে তীব্র প্রয়োজন, তার ভিত্তিতে যে বিষম সমাজ, সেই সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা আমাদের নেই। সে জন্য সামাজিক স্তরায়ণের এক তীব্র সংশ্লেষে অসমতার বাস্তবতায় ক্ষমতার দাপটের সঙ্গে অক্ষমের ঘৃণা ও দূরত্ব সৃষ্টি করে চলেছে। পুষ্টিহীনতা, পথশিশু, স্বাস্থ্যসেবার বঞ্চনা, শিক্ষায় দীনতা, বস্তুতান্ত্রিকতা, বিত্তের সামাজিক প্রাবল্য, মুনাফার তীব্র আকর্ষণ—এ সবই অসুস্থ ও অসম সমাজের প্রতিফলন। গণতন্ত্রকে এসবের বিপক্ষেই শক্ত অবস্থান নিতে হয়। কিন্তু এর বাস্তবতা আমাদের দেশে মেনে নেওয়া ও দয়াদাক্ষিণ্যের যে প্রবণতা, সেটা গণতান্ত্রিক মননের প্রকাশ হতে পারে না।৩.গণতন্ত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সৌভ্রাতৃত্ব। আমাদের সাংঘর্ষিক রাজনীতি, দখলদারির কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা, বিত্ত ও ক্ষমতার শারাফতি, ক্ষমতাধরের অন্যায়কে মেনে নেওয়া, অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়া বিঘ্নিত করা—এমনি সবকিছুই যে সৌভ্রাতৃত্ব মতভিন্নতা মেনেও অন্যের অধিকারের জন্য জীবনদানের অঙ্গীকারকে গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তাকে অস্বীকারের নামান্তর। মানুষ সামাজিক জীব, কিন্তু যে সমাজ মানুষের অধিকারকে সমুন্নত রাখে না, ক্ষমতার দর্পে মানবিক সম্পর্ককে বিনষ্ট করে, যে সমাজ ভালোবাসায় মানুষে মানুষে দায়বদ্ধ বন্ধন সৃষ্টি করে না, সে সমাজ মানুষের কল্যাণে ব্রতী হয় না, সে সমাজ মানুষের দুঃখ বিনাশে সচেষ্ট হয় না বরং নানা কর্মের মধ্যে অন্যের জন্য দুঃখ-কষ্ট সৃষ্টি করে। যে সমাজে মানুষ নিঃস্ব হওয়ার প্রক্রিয়া উচ্চ করে অন্যকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আঘাত করার মাধ্যমে আনন্দ লাভ করে সে সমাজে গণতান্ত্রিকতা সৃষ্টি হতে পারে না। মানুষে মানুষে সহমর্মিতার আন্তরিকতা শত মতভিন্নতার মধ্যে যে মনন ও মানসিকতার জন্ম দেয়, সেটিই যুক্তিবাদ ও পরমতসহিষ্ণুতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিকতার ভিত রচনা করে। আমাদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী যে মানসিকতা, ক্ষমতার প্রতি যে তীব্র আকর্ষণ, অন্যায় সুযোগ-সুবিধা লাভের যে ক্রিয়াকর্ম, সেসবই গণতান্ত্রিক সৌভ্রাতৃত্বের বিপরীতে অবস্থান করে। সে জন্য সংবাদমাধ্যমে সমালোচনা বা নাগরিক সমাজের ভিন্নমত আক্রমণের শিকার হয়। যাঁরা গণতন্ত্রের পথে চলতে চান, তাঁদের পথ হয়ে ওঠে কণ্টকাকীর্ণ। কর্ম আমাদের বিভাজিত করছে, ধর্মও আজ আমাদের বিভাজিত করছে। বিত্ত আমাদের স্তরায়িত সমাজ সৃজন করছে, শিক্ষা আমাদের অসম অবস্থানে উপনীত করছে। এ জন্যই সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সহমর্মিতা আজ এত কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠছে, তা না হলে যে সামাজিক পুঁজি আমাদের উন্নয়নকে সম্ভব করে, যে সামাজিক বন্ধন আমাদের উজ্জীবিত করে, যে সামাজিক সহিষ্ণুতা আমাদের শান্তিময় করে তোলে, তার অভাবে গণতান্ত্রিক অবস্থান সৃষ্টি অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমরা আমাদের নিত্যকার ঘটনা ও উচ্চারণের যে প্রকাশ দেখি, সেখানে কি গণতন্ত্রের এই ভিতকে মজবুত অবস্থানে দেখি? আমাদের দুর্ভাগ্য যে ইতিবাচক উত্তর দেওয়া সত্যবাদী স্পষ্টভাষীর জন্য সম্ভব হয় না।৪.গণতন্ত্রে জনগণের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি প্রয়োজন। এই উপস্থিতির মাধ্যম হলো নাগরিক সমাজের আলোচনা, সংবাদপত্রে ঘটনার বিবেচনা, মতভিন্নতার উপস্থাপনা, ক্ষমতাধরের সব কর্মের তথ্য ও বিবেচনার স্বচ্ছতার দাবি ও মানবিক অধিকার সংরক্ষণের সদাজাগ্রত অবস্থান। এ না হলে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, বিচারালয়ের ন্যায়িক অবস্থান, ভোটাধিকারের সুব্যবস্থা, সংসদের আলোচনার পুনরালোচনা, জনপ্রতিনিধির দায়বদ্ধ অবস্থান—কিছুই নিশ্চিত করা যায় না। আমাদের নাগরিক সমাজের সচেতনতা বাড়লেও দলগত আনুগত্য তাকে সব সময় সত্য উচ্চারণের সাহস জোগায় না। প্রশাসনে আজ যে ভীতি, বিচারালয়ে আজ যে অস্থিরতা, নির্বাচনে আজ যে লুকোচুরি, সংসদে আজ যে স্থবিরতা—এসব আমাদের সুস্থ গণতন্ত্রের পথ রচনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এখনো বৃহৎ জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। অস্ত্র ও বিত্তের প্রভাবে আজ যে নির্বাচন, সেটি এক অনুগত মেধাহীন প্রতিনিধি সৃষ্টি করছে, যাঁরা নিজেদের স্বার্থ পূরণে ব্যস্ত, জনস্বার্থে তাঁদের দৃষ্টি ও কর্ম অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কম। এই মেধাহীনতা সার্বিক উন্নয়ন আর কর্মচঞ্চল জনগোষ্ঠীর জন্য নেতৃত্ব প্রদানে ব্যর্থ বলেই গণতন্ত্র এমন স্থবিরতায় নিপতিত। দক্ষতা ও সৃজনশীলতায় এই গণতন্ত্র ঋদ্ধ হয়ে ওঠেনি, তাই সবার জন্য সমান অধিকার, আইনের শাসন, নিরপেক্ষ প্রশাসন—এ সবই এখনো স্বপ্ন হয়েই থেকেছে। প্রভাববলয়ের আধিপত্য সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে মাঙ্গলিক অবস্থান সৃষ্টিতে আজ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, দুর্নীতির বিস্তার-প্রসার ও গভীরতা নানা অর্জনকে ব্যর্থ করে দিয়েছে।৫.গণতন্ত্রকে ধারণ করতে হলে গণতান্ত্রিক মনন ও মানসিকতার প্রয়োজন। মানুষের অনন্য পরিচয় হলো তার মন আছে। তার বিবেক আছে। বিবেক হলো মূল্যবোধের ধারক। অন্য জীবের থেকে মানুষের ভিন্নতা অর্থবহ হয় যখন তার নিত্যকার কর্মে সৃজনশীলতার মধ্যে ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে সে যুক্তি, আদর্শ, আশা, স্বপ্ন, দূরদর্শিতা, আচরণ ও উচ্চারণ ধারণ করে অন্যের সঙ্গে। ভিন্নতা সত্ত্বেও একাত্ম হতে পারে, হিংসা পরিহার করে সহমর্মী হতে পারে, অসুন্দরকে চিহ্নিত করে সুন্দরকে ধারণ করতে পারে, বিভিন্নতা সত্ত্বেও বিচ্ছিন্নতাকে পরিহার করে মৌল চাহিদার ঊর্ধ্বে এক উন্নত জীবনের সৃষ্টিতে সবাইকে নিয়ে ব্রতী হতে পারে। মানুষের জীবন এ কারণেও বিশিষ্ট। একত্র হতে পারা তো নানা প্রাণীর যূথবদ্ধতায় দৃশ্যমান। একাত্মতা, একাগ্রতা, ভিন্নতা সত্ত্বেও সহাবস্থান, ভিন্নমতকে যথার্থ বিবেচনা, ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে বৃহৎ স্বার্থকে ধারণ করতে পারাই মানুষকে অনন্য করে, গণতন্ত্রকে সংহত করে। সহযোগিতা, সহমর্মিতা, আলোচনা, সমঝোতা আমাদের একাত্মতাকে বাস্তব রূপ দিয়ে থাকে। প্রাণীর মৌল প্রবণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারার মধ্যেই মনুষ্যত্বের বিকাশ আর মনুষ্যত্বই গণতন্ত্রকে প্রস্ফুটিত করে। আমাদের চারপাশে আজ প্রাণিজীবনের প্রাবল্য দেখি, মনুষ্যত্বের বিকাশ স্তিমিত বলেই গণতন্ত্রায়ণ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। আমরা সমাজে ভালোবাসার পরিবর্তে সন্ত্রাস ও ভীতির প্রসার দেখতে পাই ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে। মানুষ কিন্তু ভীতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি, অন্যের ক্ষমতার দাপট ও বিচারের নির্লিপ্ততা তাকে ভীত করে তুলেছে। ভয়ভীতির সমাজে গণতন্ত্রের বীজ উপ্ত হয় না। সমাজে আজ হিংসা, দ্বেষ, ক্রোধ, ঘৃণা, সন্দেহের মতো সব নেতিবাচক ধ্বংসাত্মক উপস্থিতি গণতন্ত্রের ইতিবাচক দিক প্রেম, সাহস, বিশ্বাস, সহযোগ, যূথবদ্ধতা ইত্যাদিকে বিচ্ছুরিত হতে বাধাগ্রস্ত করছে। মনে রাখতে হবে, স্বৈরাচার ভীতির সৃষ্টি করে, সন্দেহের উদ্রেক করে, সাহসের সংহার করে, অজ্ঞতার অন্ধকার সৃষ্টি করে। গণতন্ত্র বিশ্বাসের জন্ম দেয়, সুস্থ অবস্থানের স্বপ্ন তৈরি করে, সাহসী উচ্চারণের অবস্থানে উপনীত করে, মতভিন্নতায় ভীতি সৃষ্টি করে না, জ্ঞানের স্ফুরণ ঘটায়। আমাদের যাত্রা কি ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে যুক্তিবাদী সাহসিকতার পথে? আমরা কি মৌল চাহিদার ঊর্ধ্বে স্বপ্নীল সুন্দরের অভিযাত্রায় ব্রতী? নিত্যকার হিংসা, বঞ্চনা ও ঘৃণার যে চিত্র, তা আমাদের সংশয়গ্রস্ত করে তুলছে।৬.এমনি গণতান্ত্রিক মননের সৃষ্টি করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সামাজিক পরিবেশ। যেহেতু গণতন্ত্র সৃজন ও সুরক্ষা সবার যৌথ দায়িত্ব, সে জন্য সবার জন্য সমান মানের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। শিক্ষালয়ে যূথবদ্ধ কর্ম ও সৃজনশীলতার যে সুযোগ, সেটিই সমাজে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। শিক্ষায় যুক্তিবাদী আবহ ও মতভিন্নতার অবস্থান তাই প্রতিযোগী ও সহমর্মিতার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শেকড় গেড়ে দেয়। শিক্ষালয়ে জ্ঞানের যে আধার, সহশিক্ষা ও সংস্কৃতির যে উন্মেষ, তার মাধ্যমেই সৃজনশীল গণতান্ত্রিকতার জন্ম হয়। শিক্ষার মাধ্যমে যে নিরীক্ষাধর্মী মনন সৃষ্টি হয়, নানা কর্মে যে উৎসাহের জন্ম হয়, বিচার-বিবেচনার যে যুক্তিবাদিতা ধারণ করতে হয়, তাই গণতান্ত্রিকতাকে সুবিদিত করে, উৎসারিত করে। বই-পুস্তকের শিক্ষা ছাড়াও শিক্ষার্থীর মন ও মননে অন্তজ শিক্ষাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেটিও জীবনে সে ধারণ করবে। যেভাবে আজ শিক্ষালয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, সেটা কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধ ও কৃত্রিম, কিন্তু শিক্ষার মাধ্যমে মানসিক যে প্রসারতার জন্ম, যে বুদ্ধিবৃত্তির জন্ম হয়, যে যুক্তিবাদিতা গ্রহণীয় হয়ে ওঠে, যে একাত্মতা ও অন্যের জন্য হিতবাদিতার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, সেগুলোই পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করে। এ দেশে বিভাজিত শিক্ষা, সীমাবদ্ধ শিক্ষা, পুস্তকনিবিষ্ট শিক্ষা, শিক্ষককেন্দ্রিক শিক্ষা তেমনি চেতনার সৃষ্টিতে অনেকটাই ব্যর্থ। বিভাজিত সমাজের বিভাজিত সুযোগ শিক্ষার অসীম সম্ভাবনার উৎসরণকেও সীমাবদ্ধ করে মেধার যথাযথ সুযোগ সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটিয়ে একটি অতৃপ্ত সংঘবদ্ধ অথবা পরমুখাপেক্ষী যে জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি করে, তারা আত্মবিশ্বাসী না হতে পারায় গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় অংশগ্রহণে অপারগ হয়।৭.গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। এ কারণে মানুষে মানুষে সম্পর্ক গণতন্ত্রে এক প্রয়োজনীয় মাত্রা নির্দেশ করে। এখানে রাজা-প্রজার সম্পর্ক নয়, মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক নয়, মানুষে মানুষে সমসম্পর্কই গণতন্ত্রকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। ধর্ম, বর্ণ, বিত্ত, মেধা, শিক্ষা, দক্ষতা, ভাষা ইত্যাদির ভিন্নতা সত্ত্বেও গণতন্ত্রে সমসম্পর্ককে মূল্য দিতে হয়। সে জন্য পক্ষপাতিত্ব, প্রতিকূল ধারণা, ঘৃণা, সংস্কার, বৈষম্য, বিবদমানতা—এ সবই গণতান্ত্রিক সম্পর্কের বিপরীতে অবস্থান করে। এসব কারণে মানুষে মানুষে সম্পর্কের যে ঘাটতি, সেটা গণতন্ত্রের জন্য ঘাটতি বলে বিবেচিত হয়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এসব কারণে সৃষ্ট যে দূরত্ব ও সম্পর্কহীনতা বিদ্যমান, তার ফলে পারস্পরিক সম্পর্কে আজ এক বিশাল গণতান্ত্রিক ঘাটতি বিরাজ করছে। সে জন্য যে শব্দাবলি, শারীরিক ভাষা ও উচ্চারণ আমরা শুনি, পড়ি অথবা দেখি, সে সবই গণতান্ত্রিকতার মাপকাঠিতে গ্রহণীয় নয়। এ জন্য প্রতিটি মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা, সম্মানীয় ও সমতুল্য বলে ধারণ করা, নিজের কথা ও আচার-আচরণে দায়িত্বশীল হতে চেষ্টা করা এবং অন্যের অবস্থানে নিজেকে স্থাপন করে সেভাবে অন্য সম্পর্কে উক্তি করা আমাদের গণতান্ত্রিক সম্পর্ক নির্মাণ করতে পারে। বাস্তবে তারই অভাব রয়েছে। গণতন্ত্রে আমরা সবার জন্য সম-অবস্থানকে মৌলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছি, সে কারণে গণতন্ত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক সমতা ও সম্মানের ভিত্তিতেই হতে হবে, না হলে না-বাস্তব এক অবস্থার সৃষ্টি হয়, যা শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রকে বিনাশ করে।নির্বাচিত হিটলার জাতি ও রক্তের গুণে নিজেদের বিশুদ্ধ জাতি হিসেবে বিবেচনা করে জার্মানি ও ইউরোপ শুধু নয়, পৃথিবীতে এক অন্যায় সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছিলেন, যার অভিঘাত থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। ৮.গণতন্ত্রে তাই সুবিবেচক নেতৃত্বের গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। সে নেতৃত্ব সবাইকে নিয়ে ভাবে। নিজে, নিজের গোষ্ঠী বা নিজের দলের ওপরে তাঁরা সব মানুষকে স্থান দেন। সে নেতৃত্ব দূরদর্শী, কেবল বর্তমান তাঁদের বিবেচনায় থাকে না, তাঁদের সব কর্ম ও উচ্চারণে তাঁরা সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনায় সৃজনশীল থাকেন। তাঁরা সুন্দর মন ও মননের অধিকারী হন। তাঁদের বিশ্লেষণক্ষমতা যেমন তীক্ষ, তেমনি সম্পর্ক গড়ার আন্তরিকতায় তাঁরা ঋদ্ধ। সমস্যা তাঁদের বিচলিত করে না; কারণ, সমস্যা সমাধানের মধ্যে তাঁরা কল্যাণধর্মী অবস্থান সৃষ্টি করার সুযোগ পেয়ে যান। তাঁদের মধ্যে রসবোধ উত্তম বলেই সম্পর্ক নির্মাণে তাঁরা পটু। তাঁদের মানসিক শক্তি অদম্য এবং মানুষের কল্যাণের মাধ্যমে তাঁদের শক্তির নবায়ন ঘটে। তাঁদের জ্ঞানের আধার সীমাহীন এবং জ্ঞান আহরণের ক্ষমতাও সীমাহীন, যে কারণে সহজেই অনুধাবন ও অনুসন্ধানে তাঁরা বিশেষ দক্ষতা রাখেন। তাঁদের সততা এমনি অনুকরণীয় যে তাঁদের উচ্চারণ সহজেই গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। তাঁদের মানুষের জন্য ভালোবাসা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে সুসম্পর্কের যে বন্ধন সৃষ্টি করে, তা-ই সমতাধর্মী দায়বদ্ধ গণতান্ত্রিকতাকে সঞ্জীবিত রাখে। মহাত্মা গান্ধীর বিখ্যাত উক্তি যে ‘আমি দ্রুততার সাথে জনতার মাঝে একাত্ম হব, কারণ আমি তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছি, তাদের পথের দিশারি হয়েছি।’ Lao tsu খ্রিষ্টপূর্বকালে অনুধাবন করেছেন, মানুষ তাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে গ্রহণ করলেই নেতা হওয়া যায় না, বরং মানুষ যখন বিবেচনায় তাদের নেতৃত্বের ধারণাকে ও কর্মকে নিজের বলে গ্রহণ করতে পারে, সেই বিচারে উত্তীর্ণ নেতৃত্বই যোগ্য নেতৃত্ব।আমাদের দেশে ভাড়া করা মানুষের ঢলে হাততালির যে নেতৃত্ব, কিছু পাওয়ার জন্য যে আনুগত্য, সেটি যোগ্য গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ব্যর্থ। গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের উদারতা, মহানুভবতা, দূরদর্শিতা ও মাঙ্গলিক বিচিন্তা আজ দৃশ্যমান নয়। নাগরিক সচেতনতাই সেই নেতৃত্ব সৃষ্টি করে।৯.আমাদের দেশে গণতন্ত্র ভঙ্গুর, এর পরিচয় আমরা বারবার পেয়েছি। আমরা নানা দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণ যেমন দেখেছি, তেমনি অনেক দেশেই দেখেছি সংকটপূর্ণ ও সংশয়গ্রস্ত গণতান্ত্রিক অবস্থানও। আমরা জানি, গণতান্ত্রিকতার মধ্যে যে মুক্তি ও স্বাধীনতা, সেটি পৃথিবীর নানা দেশের ইতিহাসে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে জ্ঞানের স্ফুরণ যে সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে, তার স্থিরতা ও উল্লম্ফন সম্ভব হয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকতার কারণে, যার মাধ্যমে উন্নয়নের সাফল্যে বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশীদার হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিবর্তনের মধ্যেও সংকটের আবর্ত নানাভাবে আবির্ভূত হয়েছে। গণতন্ত্রের সংকট নানাভাবে নানা কারণে এসেছে। পরিবর্তনের নামে বিপ্লব-ভাবনায় সহিংসতা নানা সময়ে দেখা দিয়েছে, তার ফলে গণতন্ত্র সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। বিপ্লবের তাড়না ছাড়াও ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীনের দ্বন্দ্বমুখর অবস্থান নানা সময়ে গণতন্ত্রকে সংকটের আবর্তে ফেলে দিয়েছে। আমাদের দেশে এ অবস্থা বিভিন্ন সময়ে উচ্চকিত হয়েছে; কারণ, ক্ষমতা হলো সবকিছু পাওয়ার দায়বদ্ধতাহীন এক প্রশস্ত পথ। গণতন্ত্রের সংকটের আবহে অগণতান্ত্রিক শাসনের অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে।গণতন্ত্র না হওয়ার একটি কারণ ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও সুযোগের বিষম সম্ভাবনা। আমরা সংসদীয়ভাবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব ক্ষমতা একটি কেন্দ্রে ন্যস্ত করেছি। সাংবিধানিক এই দুর্বলতা এ দেশে প্রশাসনিক অদক্ষতা সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে সরকারের প্রসার ও বিস্তার এমনই ঘটেছে যে ছোট সরকারে, দক্ষ সরকারে, কার্যকরী সরকারে আমরা আর আস্থা রাখিনি। এই কেন্দ্রীভবনের ফলে মতভিন্নতায় আমরা সহিষ্ণু হয়ে উঠিনি, মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক গণতান্ত্রিকতাকে লালন করে, সে সম্পর্ক আমরা গড়ে না তুলে বরং তার বৈপরীত্যকে লালন করে চলেছি, ফলে গণতন্ত্র যা মানুষের অধিকারকে নিশ্চিত করে, সে থেকে নানাভাবে আমরা দূরে সরে গিয়েছি। অর্থনৈতিক গণতান্ত্রিকতা ও সার্বিক সামাজিক ন্যায়বিচার আজ কেবল স্তুতিবাক্যে পরিণত হয়েছে। সরকারের বিশালতা ও অস্বচ্ছ পরিচালনা ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের যে প্রবণতা সৃষ্টি করেছে, তার ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ক্ষমতাবলয়ের বাইরে এক সংঘবদ্ধ অবস্থানে চলে গেছে। ফলে অনেক সময়ই অনিশ্চয়তা, জটিলতা, বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি ও অক্ষমতা নানাভাবে নানা বিষয়ে দৃশ্যমান হয়। গণতান্ত্রিকভাবে অংশীদারি ও বিকেন্দ্রীকরণ এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব করে তুলতে পারে, কিন্তু আমরা ক্ষমতা সব সুযোগের উৎস—এই ধারণা থেকে কেন্দ্রীভবনকেই নানাভাবে বেছে নিয়েছি, যার ফলে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধ সম্পর্কভিত্তিক আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান দৃঢ় হতে পারছে না। সরকারের বিশালতা যেহেতু আমলানির্ভরতা বাড়িয়ে দেয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ক্ষমতাবলয়ের বাইরে এক অতৃপ্ত পরিমণ্ডলের সৃষ্টি করে; তখন দক্ষতা নয় আনুগত্য প্রাধান্য পায়, অদক্ষতা অগণতান্ত্রিকতার জন্ম দেয়। যেহেতু ক্ষমতা সব সুযোগের উৎস, সে কারণে রাজনীতি সুযোগের বলয়ে যাওয়ার একটি পথ হয়ে দাঁড়ায়, যার ফলে অর্থনীতিতেও কেন্দ্রিকতার প্রবণতা বাড়ে এবং পরিতোষণার মানসিকতা সর্বব্যাপী হয়ে পড়ে। এই সীমাবদ্ধতাই গণতান্ত্রিক পথকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। গত শতাব্দীর শুরুতে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ধারণায় যে দর্শন উদ্দীপ্ত মানুষকে আন্দোলিত করেছিল, তা হলো, সব মানুষের সমান অধিকার এবং কোনো সুবিধাভোগীর জন্য বিশেষ অধিকার নয়। আজ যখন সাংসদদের মধ্য থেকে বিশেষ সুবিধা ও বিশেষ অধিকারের উচ্চারণ শুনি, তখন তাঁদের গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়েই সংশয় জাগে। আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধ যে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, সে মন ও মনন আজ বর্তমান নেই। সমতাভিত্তিক উন্নয়নের পরিবর্তে যখন আমরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক উন্নয়নের ধারাকে প্রাধান্য দিয়েছি এবং জনস্বার্থের ধারণা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে অবদমিত হয়েছে, তখনই জনগণকে স্বার্থের ভিত্তিতে বিভাজিত হতে দেখেছি এবং ক্ষুদ্র স্বার্থের উত্থান রাষ্ট্রশক্তি নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সেই প্রতিযোগিতায় সমাজে প্রতিষ্ঠা অর্জনে চারিত্রিক গুণের বদলে বিত্ত বিশেষ স্থান করে নিয়েছে, আর বিত্ত অর্জনে সুনীতি আজ দুর্নীতির কাছে অবদমিত হয়ে পড়েছে। আর দুর্নীতির প্রভাববলয় রাজনীতি। প্রশাসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিষ্ঠানসমূহ, নতুন প্রজন্মকে পথনির্দেশনার শিক্ষালয়সমূহ, জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাকে আজ নীতিহীনতার শিকারে পরিণত করেছে। প্রতিষ্ঠা অর্জনের ব্যক্তিতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা সে কারণে জনস্বার্থ উন্নয়নের সহায়ক হয় না বলেই ব্যক্তি ও বস্তুতান্ত্রিক রাজনীতি আমাদের গণতন্ত্রের বিকাশকে রুদ্ধ করেছে। আমরা জনস্বার্থের যুক্তিবাদিতা পরিহার করেছি বস্তুতান্ত্রিক ভোগবাদিতা দিয়ে চালিত হওয়ার কারণে। পারস্পরিক সম্পর্কে আজ গণতান্ত্রিক ঔদার্য তিরোহিত হয়েছে। আমাদের উন্নয়ন-চিন্তায় আজ আর্থসামাজিক সমতা সাধনের রাজনীতি পরিহার করা হয়েছে বলেই সমাজ বিনির্মাণে আজ আধিপত্যবাদের বিস্তার ঘটেছে; যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত হয়েছে দুর্নীতির জট। প্রতিষ্ঠা লাভের অসম প্রচেষ্টার যে রাজনীতি, সেটা গণতান্ত্রিকতা উদ্দীপ্ত করে না, অংশীদারিকে মূল্য দেয় না বরং কেন্দ্রীভবন, বিশেষ সুযোগ, বিশেষ ব্যবস্থা, তাৎক্ষণিকতাকেই উসকে দেয়। এ থেকে দীর্ঘ পথযাত্রায় মাঙ্গলিক কিছু ঘটার সম্ভাবনা কম থাকে বলেই ক্ষমতাবলয়ের বাইরের মানুষের কিছু দান, অনুদান অথবা ভীতি প্রদর্শনের প্রশাসন ও সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়, গণতন্ত্রের চর্চা ও দায়বদ্ধতার জন্ম হয় না। সে জন্য জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি আজ রাজনৈতিক চেতনায় দৃশ্যমান নয় এবং এ কারণেই গণতান্ত্রিক চেতনায় নানা রকমের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গণতান্ত্রিকতার বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি ও তার ফলিত ধারণাকে উজ্জীবিত করতে আজ ব্যক্তিস্বার্থভিত্তিক ও পরিতোষণায় উদ্দীপ্ত যে ক্ষমতার অবকাঠামো সৃষ্টি করেছি, তার বিশেষ গুণগত পরিবর্তনের প্রয়োজন, যার জন্য যে পুঁজিবাদী মতবাদ নিয়ে আমাদের উন্নয়ন-ধারণার সৃষ্টি, তার জাতীয় সমতা দর্শনের আলোকে কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। বিশেষ অবস্থান, বিশেষ অবস্থা, বিশেষ ক্ষমতা ও বিশেষ সুযোগের অবলুপ্তি ঘটতে হবে। বস্তুতান্ত্রিকতার মননে গঠিত নানা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন প্রয়োজন হবে। আর্থসামাজিক সমতা দর্শনের সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত বা নীতিনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিস্বার্থের সংঘাত আছে এবং থাকবে। গণতন্ত্র যদি বৃহত্তর জনস্বার্থকে ধারণ না করতে পারে, যদি সমসুযোগের অবস্থানকে বাস্তবে রূপ না দিতে পারে, তাহলে দায়বদ্ধ গণতন্ত্র ও নীতিভিত্তিক সমতার সহাবস্থান নিশ্চিত হতে পারে না, ফলে সমাজে ও রাজনীতিতে অস্থিরতা বিরাজমান থাকবে। আমরা এই সহাবস্থানকে নিশ্চিত করতে অপারগ হয়েছি। আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির আজকের ব্যর্থতা এখানেই। গণতন্ত্রকে সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে ব্রতী না করা গেলে দায়বদ্ধ নীতিনিষ্ঠ আর্থসামাজিক রাজনীতির পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। সে কারণে সংবিধিবদ্ধ রাজনীতি কেবল নির্বাচনের বিষয় নয়, জনগণকে ক্ষমতায়িত করার সার্বিক ব্যবস্থা। গণতন্ত্র কেবল বিধিমালা দিয়ে রচিত হয় না, প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়ে তাকে রক্ষা করা যায় না, গণতন্ত্রকে মন ও মননে, চিন্তা ও চেতনায়, আচার ও আচরণে ধারণ করতে হলে ক্ষমতায়িত জনগণের উচ্চারণকে সর্বদাই বিবেচনায় নিতে হবে। এ জন্য জনগণকে ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে রাগ-অনুরাগের ওপরে স্থান দিতে হবে।১০.সংবিধিবদ্ধ গণতন্ত্র আজ নির্বাচনসর্বস্ব হয়ে পড়ছে, সেখানে জনকল্যাণকে স্বতঃসিদ্ধ ভাবার কোনো সুযোগ নেই। একমাত্র অংশীদারি বিকেন্দ্রীভূত দায়বদ্ধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই জনকল্যাণকে অর্থবহভাবে ধারণ করতে পারে। যে ব্যবস্থায় বিশেষ অবস্থান ও বিশেষ ব্যবস্থা গুরুত্ব পায়, সেখানে গণতান্ত্রিকতার বিকাশ ঘটে না। আইনের শাসন ও আইনের সামনে সবাই সমান—এই তত্ত্বের পেছনে এক নির্ভীক জ্ঞানী দূরদর্শী সামাজিক মননের অধিকারী বিচারকের চরিত্রের ধারণা আছে। আমরা আমাদের বিচারব্যবস্থায় এমনি দৃঢ়চিত্ত, ন্যায়নিষ্ঠ অবস্থানের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের গণতন্ত্রে, বিধিবিধানেও ঐকমত্য সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছি এবং বিভিন্ন বিষয়ে এমন দ্বন্দ্বমুখর অবস্থানের সৃষ্টি হয়েছে যে গণতন্ত্রের সার আজ কিছু বিধিবিধানের কাছে সমর্পিত, জনকল্যাণের কাছে নয়। আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োজনীয়তা গণতান্ত্রিকতার মূল কথা। তা ছাড়া ওসবের অন্তর্নিহিত মূল্য তেমন কিছু নেই।আমাদের দেশে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য বেশ লক্ষণীয়। ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আমলাতন্ত্র তখনই গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখে, যখন জনগণের অংশীদারির সার্বভৌম অবস্থানকে তাদের ক্রিয়াকর্মে গ্রহণ করে। আমাদের আমলাতন্ত্রের একটি ইতিহাস আছে, যে ইতিহাস আধিপত্যবাদকে ধারণ করে। সে জন্য আমাদের আমলাতন্ত্র ক্ষমতার কেন্দ্রিকতায় স্বস্তি বোধ করে। আমলাতন্ত্র আজ বিশাল, তাদের কর্মের নিশ্চয়তাও আছে এবং আজ যখন ক্ষমতাবলয়ে তারা অনুগত, বুদ্ধিদাতা, কাজে লিপ্ত, তখন দায়বদ্ধতার জনমুখিনতা দৃশ্যমান থাকে না এবং গণতন্ত্রের প্রাণ অনেক সময়ই চেতনাহীন হয়ে পড়ে। আজ ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থবাদিতা যখন রাজনীতিকে জনমুখী করে না, তখন আমলাতন্ত্র অনেক সময় তাদের সাধারণভাবে নিয়মসিদ্ধ অবস্থানে কর্মতৎপর থাকে না বা থাকতে পারে না। এর সঙ্গে দুর্নীতির নানা সংশ্লেষ এবং বিভাজিত আমলাতন্ত্রের নানা অন্তর্দ্বন্দ্ব গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের উদ্যমকে বিনষ্ট করছে। ফলে জনগণের টাকার অপচয় ঘটছে। অনুগত কিন্তু কর্মসম্পাদনে অপারগ আমলাতন্ত্র সমাজের অস্থিরতায় স্বাভাবিক ভূমিকা রাখতে পারছে না। ঔপনিবেশিক ধারণা বহন করে তারা স্থানীয় সরকারকে যথাযথ মর্যাদা ও সহায়তা না দিতে সাংসদদের সহযোগী হয়ে উঠেছে। অথচ ক্ষমতায়িত জনগণই গণতান্ত্রিকতার ধারক, তাদের স্থানীয় সরকারই স্থানীয় সমস্যা ও উন্নয়নের জন্য দায়বদ্ধ। গণতান্ত্রিক অবস্থার উন্নতির জন্য আমলাতন্ত্রের সাবেকি ধারণার পরিবর্তন ঘটতে হবে। যেহেতু এই পরিবর্তন আমলাতন্ত্রের শীর্ষে গ্রহণীয় নয় এবং কেন্দ্রিকতায় তাদের ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে, সে কারণে গণতান্ত্রিক বিকাশে বিধিবিধানের নিগড়ে আমলাতন্ত্র অধিপতি সাংসদদের সহায়তায় বাধার প্রাচীর নির্মাণ করে। উন্নত গণতন্ত্রে আমরা স্থানীয় সরকারের যে বিকাশ দেখি, সেখানে রাজনীতিতে কেন্দ্রীভবনের ধারণা সীমাবদ্ধ হয়েছে এবং আমলাতন্ত্রের অধিপতি-সহায়ক মানসিকতাও পরিবর্তিত হয়েছে।১১.অংশীদারির চেতনা আজ কেবল রাজনীতিতে নয়, বিভিন্ন ধরনের সংগঠনেও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রকাশ হিসেবে আজ ব্যবস্থাপনায় এক স্বীকৃত বিষয়। এর ফলে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হয়। অংশীদারির বিকাশে স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই অংশগ্রহণ, আলোচনা, মতভিন্নতা সত্ত্বেও সহমর্মিতা, সাযুজ্য, সমসুযোগের বিকাশ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির শেকড় গড়ে দেয়। অংশীদারির দাবিতে ব্রিটেনে যখন শ্রমিক সংস্থার উত্থান সে দেশের রাজনীতিতে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়, তখনই সংশোধনবাদী শ্রমিকভিত্তিক রাজনীতি সে দেশে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ও বিকেন্দ্রীকরণের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সুস্থ গণতন্ত্রের ধারা সৃষ্টি করে। কারণ, কোনো গোষ্ঠীস্বার্থের প্রাধান্য গণতন্ত্রকে দুর্বল করে তোলে। নির্বাচনেও সচেতনভাবে ভোটের সমর্থন পরিবর্তিত হয়। উন্নয়নের ধারায় নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটে। সে চেতনা কেবল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ধারণ করলে গণতন্ত্র সমুন্নত থাকে না, তাকে বিস্তৃতভাবে জনচেতনায় ছড়িয়ে দিতে স্থানীয় সরকার ও তার নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সমাজে নতুন নতুন চেতনা ও নতুন নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়, সে চেতনা ও সম্ভাবনাকেই ধারণ করে উন্নয়নের গতিধারাকে বেগবান করা সম্ভব। সমসুযোগ ও সমমানের শিক্ষা শ্রেণীবিভাজনের পরিবর্তন ঘটায়, নগরের সংশ্লেষে গ্রামীণ সমাজের পরিবর্তন ঘটে, শিল্পায়নের ধারায় শিল্প-শ্রমিকের সংহত বিকাশ ঘটে, কৃষির উন্নয়নে এর বিপণনধারায় নতুন পুঁজির বিকাশ ঘটে। এমনি পরিবর্তনকে জনগণের উন্নয়নের ধারায় সমতাধর্মী সমাজ নির্মাণে দায়বদ্ধ ক্ষমতায়িত স্থানীয় সরকার গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে ও কেন্দ্রীভূত সরকারের গোষ্ঠীপ্রধানকে প্রতিহত বা সীমিত করে। স্মরণ করা দরকার, আমরা এ দেশে এতকাল যে স্থানীয় সরকার দেখেছি সেটি হলো, প্রশাসনের তৈরি, প্রশাসনের অনুগত ও অধীন স্থানীয় সরকার। এ পথে গণতান্ত্রিকতার বিকাশ ঘটে না। গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণে স্থানীয় সরকারকে স্থানীয় সমস্যা ও উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে দায়বদ্ধ গণতান্ত্রিক অংশীদারির মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের বিস্তৃত নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থায় নিজেদের আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বশাসনের অধিকারী থাকবে, যদিও এ ক্ষেত্রে জবাবদিহির ব্যবস্থাও কার্যকর হতে হবে। আমরা লক্ষ করেছি, স্থানীয় সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ স্বশাসনের অধিকার দিতে সাংসদ ও আমলাতন্ত্রের অনীহা প্রবল। এ দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্রীয় শাসনের মাধ্যমে গোষ্ঠী-প্রাধান্য সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে সংহত করা সম্ভব নয়। এ কারণেই সংবিধানের চেতনায় স্থানীয় সরকারকে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়িত করে গণতন্ত্রের বিকাশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।১২.গণতন্ত্রের আলোচনা যা করা হলো তা সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু যে বিষয়গুলোর অবতারণা করা হয়েছে, সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বলেছি, গণতন্ত্রের চুম্বক হলো স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব। এসবের অবস্থান যত বিস্তৃত ও দৃঢ় হবে, গণতন্ত্র তত কার্যকর হবে। আমাদের বিভাজিত সমাজের বিপরীতে অর্থ ও অস্ত্রের প্রবল উপস্থিতির বিপরীতে সুষম সমাজ নির্মাণ কঠিন ও দীর্ঘকালীন কার্যক্রম। কিন্তু গণতান্ত্রিক চেতনার প্রকাশ এখন থেকেই হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ও সার্বিকভাবে প্রশাসনের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে রাজনৈতিক দলের ভেতরে, গণতন্ত্রের উচ্চকিত উপস্থিতি কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয়, রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীভবন। এর ফলে মতভিন্নতার প্রকাশ হবে, কিন্তু সংলাপ ও আলোচনায় সমঝোতার সৃষ্টি হবে, যার ভিত্তি সুবিধাবাদিতা নয়। অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ও আচরণে আজ যে ঘৃণা ও হিংস্রতা দেখা যায়, তা থেকেও আমাদের উত্তরণ প্রয়োজন। এখানেও প্রকাশ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্যে মতভিন্নতার অবস্থানকে মেনে নিতে হয়। আমাদের বৃহৎ দুটি দলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক চিন্তায় বিশেষ পার্থক্য নেই। কেবল ক্ষমতার সংশ্লেষ ও ইতিহাস তাদের মধ্যে যে সাংঘর্ষিক অবস্থানের সৃষ্টি করেছে, তার দ্রুত নিষ্পত্তি না হলে গণতন্ত্র ঝুঁকিতেই থেকে যাবে। এদিকে আমাদের সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতাতেই রয়েছে।১৩. গণতন্ত্রে অন্যায়-অবিচার-অশুভের বিরুদ্ধে, ন্যায় ও সুবিবেচনার পক্ষে জনগণের উচ্চারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই বাকস্বাধীনতা আর্থ-রাজনৈতিক অধিকারের একটি মৌল স্তম্ভ। স্তুতিবাদ বা তোষামোদ জন-অধিকারকে সংহত করে না। বস্তুনিষ্ঠ আলোচনাই গণতান্ত্রিকতার জনভিত্তি রচনা করে। সচেতনতা তাই অপরিহার্য। সচেতন নাগরিক দেশপ্রেম ও জনস্বার্থে সর্বদা সোচ্চার হলেই আর্থ-রাজনৈতিক অধিকার গণতান্ত্রিক সমাজে অর্জন করা যায়। সংবাদপত্র জনসচেতনতা সৃষ্টি ও জনগণের উচ্চারণকে শ্রুত করতে সহায়তা করে। ব্যবসায়িক স্বার্থ বা গোষ্ঠীবিবেচনা গণমাধ্যমের ভূমিকাকে বেপথু করতে পারে। কিন্তু সংবাদপত্র ও অন্যবিধ গণমাধ্যম জনস্বার্থকে ধারণ করে ন্যায়নিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ হলেই গণতান্ত্রিক ধারণা প্রবল হয়। গণতন্ত্রচর্চায় জনগণের উচ্চারণকে তুলে ধরতে গণমাধ্যম বাকস্বাধীনতার কার্যকর বাহন হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এর নানা স্খলন দেখি। সেখান থেকে উত্তরণে সচেষ্ট হতে হবে।১৪. গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। গণতন্ত্রকে ধারণ করেই জনগণ ক্ষমতায়িত হতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্রকে গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন এবং কেবল নির্বাচনসর্বস্ব করা জনকল্যাণে সহায়ক নয়। আসুন, আমরা সচেতনভাবে আমাদের কর্মে, উচ্চারণে ও আচার-আচরণে জনকল্যাণের জন্য গণতন্ত্রের চর্চা করি, গণতন্ত্রকে সংহত করি। মোজাফ্ফর আহমদ: অর্থনীতিবিদ, সভাপতি, সুজন