ক্যাপ্টেন এজাজ উর্দুতে বলেন, ‘লে লো’

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন নবীন (৬১) আজ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আগামী রোববার আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাঁকে জেরা করবেন।সাঈদীর বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার দ্বিতীয় সাক্ষী রুহুল আমিন। তিনি গতকাল বুধবার ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করেন। কাল প্রথম সাক্ষ্য দেন মুক্তিযোদ্ধা মো. মাহাবুবুল আলম হাওলাদার। রোববার আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাঁকেও জেরা করবেন।আজ সকালে বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে সাঈদীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।রুহুল আমিনের সাক্ষ্য নেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সাইদুর রহমান। ১৯৭১ সালে ২১ বছর বয়সী এই মুক্তিযোদ্ধা তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, ‘একাত্তরের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাল, ডালসহ প্রভৃতি রসদ কেনার জন্য আমি পারেরহাট বাজারে যাই। ওই দিন ছিল বৃহস্পতিবার, হাটের দিন। সকাল অনুমান সাড়ে ১০টা বা ১১টার দিকে বাজারের মাসুম স্টোর নামে একটি পরিচিত দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কিছুক্ষণ পর দেখতে পাই, বাজারের উত্তর দিক থেকে পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরে বাঁ হাতে একটা ঢেউটিন আর মাথায় ঝাঁপিতে করে কাঁসা-পিতলের প্লেট-গ্লাস-বাটি-জগ, কলসসহ দেলাওয়ার হোসেন শিকদার বাজারের দক্ষিণ দিকে পাঁচ তহবিল নামে খ্যাত একটি দোকানের দিকে যাচ্ছেন। আমার পাশে দাঁড়ানো মৌলভি নুরুল হক বলেন, দেখুন, দেলোয়ার সাহেব লুটের মাল নিয়ে যাচ্ছে। এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্বে থাকায় নিরাপত্তার জন্য আমার সঙ্গে একটা রিভলবার থাকত। আমি উত্তেজিত হয়ে মৌলভি সাহেবকে বলি, ওই লুটেরাকে আমি এখনই শুট করব। মৌলভি আমাকে বাধা দিয়ে বলেন, এই মুহূর্তে ঝামেলা করলে পারেরহাটে অবশিষ্ট যে ঘরবাড়িগুলো আছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেগুলোও জ্বালিয়ে দেবে আর নির্বিচারে গণহত্যা চালাবে।’রুহুল আমিনের জবানবন্দি অনুসারে, জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম, জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা খুলনা শান্তি কমিটির সভাপতি এ কে এম ইউসুফ, পিরোজপুর মহকুমা শান্তি কমিটির সভাপতি খান বাহাদুর সৈয়দ আফজালের নির্দেশে পারেরহাট এলাকায় শান্তি কমিটি গঠিত হয়। জামায়াতের নেতা সেকান্দার আলী শিকদার (মৃত), দানেশ আলী মোল্লা (মৃত), মাওলানা মোসলেহউদ্দিন, দেলোয়ার হোসেন শিকদার (বর্তমানে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী) আরও অনেকে শান্তি কমিটিতে ছিলেন।জবানবন্দিতে রুহুল আমিনের বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মে ২৬টি রিকশায় চড়ে প্রায় ৫২ জন পাকিস্তানি সেনাসদস্য পারেরহাট বাজারে আসেন। শান্তি কমিটির সদস্যরা বাজারের হিন্দুসম্প্রদায় ও আওয়ামী লীগের লোকজনদের ঘরবাড়ি দেখিয়ে দেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এজাজ এ সময় উর্দুতে বলেন, ‘লে লো।’ সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা ওই সব দেখিয়ে দেওয়া ঘরবাড়ি লুট করা শুরু করেন। ওই দিন পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা বাজারের প্রায় ৩০-৩৫টি দোকানঘর লুট করেন।রুহুল আমিন আরও বলেন, পরের দিন ৮ মে পাকিস্তানি সেনাসদস্য, রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকজন পারেরহাট বন্দরের পূর্বপারে বাদুরা ও চিথোলিয়া গ্রামে তত্কালীন ধনাঢ্য ব্যক্তি রইছউদ্দিন পসারি, হেলালউদ্দিন পসারি, শহীদউদ্দিন পসারি ও মানিক পসারির ঘরসহ অন্য সাত-আটটি ঘর লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়।রুহুল আমিন তাঁর জবানবন্দিতে বলেন, পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা বিপদ সাহার মেয়ে ভানু সাহাসহ আরও কয়েকটি মেয়েকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের শিকার ছবি রায়, ভানু সাহা পরে ভারতে পালিয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, শান্তি কমিটির লোকজন শুধু লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা স্থানীয় হিন্দুসম্প্রদায়ের ননী সাহা, মাকুম সাহা, গণেশ চন্দ্র রায়, সতীশ চন্দ্র রায়, সুধীর চন্দ্র রায়, গৌরাঙ্গসহ ৫০-৬০ জনকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে।মুক্তিযুদ্ধ শেষে রুহুল আমিন ১৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পারেরহাটে ফিরে যান। সেখানে তাঁরা শান্তি কমিটির সদস্যদের খোঁজ করেন এবং কয়েকজনকে আটক করেন। কিন্তু দানেশ মোল্লা, মাওলানা মোসলেহউদ্দিন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে তখন খুঁজে পাননি তিনি।জবানবন্দির শেষে রুহুল আমিন বলেন, তিনি দেশের সব মুক্তিযোদ্ধা ও শান্তিকামী মানুষের পক্ষ থেকে একাত্তরে মানবতাবিরোধী শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের বিচার চান। ট্রাইব্যুনালের কাছে এটাই তাঁর দাবি।দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রুহুল আমিন বক্তব্য শেষ করলে আগামী রোববার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম মুলতবি করা হয়।