বিরাট জনগোষ্ঠীর বিবর্ণ শিক্ষাচিত্র

দেশে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব, নামের মোহ এবং দুর্নীতি। সব মিলিয়ে শিক্ষাচিত্রটা বিবর্ণ। এসব নিয়ে প্রচ্ছদের প্রতিবেদনগুলো তৈরি করেছেন শরিফুজ্জামান।দেশে স্কুল-কলেজের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত এ সংখ্যা বেড়েই চলছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। কিন্তু বাড়ছে না লেখাপড়ার মান। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ পাওয়া পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু ওই চিত্র মূলত রাজধানী বা বড় কয়েকটি শহরকেন্দ্রিক। এর বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠীর শিক্ষাচিত্র বিবর্ণ, হতাশাব্যঞ্জক।দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেয় সরকার। চাহিদা যাচাই না করে দেশজুড়ে অপরিকল্পিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় সরকারি তহবিলের একটি বড় অংশ অপচয় হচ্ছে।সরকারি হিসাবে, দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৬ শতাংশ ছাত্র। এই হিসাবে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় তিন কোটি ৩৩ লাখ। এদের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে প্রায় তিন কোটি শিক্ষার্থী। চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরে শিক্ষা বাজেটের অনুন্নয়ন খাতের ৬২ শতাংশ বা তিন হাজার ৯০৪ কোটি টাকা বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ খরচ হচ্ছে। তাই দেশের বেসরকারি শিক্ষার হালচাল নিয়েই এই অনুসন্ধান।বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০০১ সালে অপ্রয়োজনীয় এবং নিম্নমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়। এর অংশ হিসেবে দেশজুড়ে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, এমপিওভুক্ত প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ১০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুর্বল ও নিম্নমানের। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে করণীয় নির্ধারণ করার আগেই সবকিছু ধামাচাপা পড়ে যায়। তবে নতুন করে এমপিও দেওয়া বন্ধ রাখে জোট সরকার। এর কারণ সম্পর্কে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এম ওসমান ফারুক বলেন, একেকজন সাংসদ ৫০ থেকে ১০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সুপারিশ করেন। চাপ সামলানো সম্ভব নয় বলে এমপিওভুক্তি বন্ধ রাখতে হয়।২০০৩ সালের ৪ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয় দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার সম্পাদক মাহবুবুল আলমকে আহ্বায়ক করে ১২ সদস্যের কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ২০০৬ সালের জুন মাসে প্রতিবেদন দেয়। এতে বলা হয়, ‘১৯৯৫ সালে এমপিও দেওয়ার পরিমাণ ৫০ থেকে ৮০ শতাংশে উন্নীত হয়। এর ফলে যত্রতত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের হিড়িক পড়ে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে অনুসরণীয় নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে বহিঃচাপ, দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এতে সরকারের আর্থিক সংশ্লেষ বহুগুণে বেড়েছে।’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের ক্ষেত্রে সুষম বণ্টনব্যবস্থা থাকা দরকার বলে প্রতিবেদনে সুপারিশ রাখা হয়েছে।২০০৯ সালে এসে বতর্মান সরকারও অপ্রয়োজনীয় ও দুর্বল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছে। । শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, ইতিমধ্যে রাজশাহী বিভাগে এই কাজ শেষ হয়েছে। আগামী দুই মাসের মধ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ করা হবে।নীতিমালা মানা হয় না: বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) পরিচালিত জাতীয় শিক্ষা জরিপ অনুযায়ী (মে, ২০০৯) দেশে এখন এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৪ হাজার ৯৯১টি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকাশিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যালোচনা প্রতিবেদনের (জুন, ২০০৬) পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বেতনের সরকারি অংশ (এমপিও) পাওয়া কমপক্ষে পাঁচ হাজার ৫৯০টি বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসাস্থাপনের ক্ষেত্রে ওই নীতি মানা হয়নি। ওই প্রতিবেদন বলছে, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় প্রয়োজনের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। এ ছাড়া ৬২ জেলার ২৭২টি উপজেলায় নীতমালা লঙ্ঘন করে মাধ্যমিক স্কুল তৈরি করা হয়েছে। মোট ২০৭টি উপজেলায় রয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কলেজ। এ ছাড়া ১৯৪টি উপজেলায় আছে প্রাপ্যতার চেয়ে বেশি মাদ্রাসা। অন্যদিকে নীতিমালা অনুযায়ী প্রাপ্যতা থাকলেও ২২টি উপজেলায় প্রয়োজনীয় স্কুল, ১০৭টি উপজেলায় প্রাপ্য কলেজ এবং ২৬টি উপজেলায় চাহিদামাফিক মাদ্রাসা নেই।প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলছিলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই, সেখানে আধিক্য আছে। আবার যেসব এলাকায় প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন সেখানে গড়ে ওঠেনি। এ বিষয়টি ছাত্র ও শিক্ষকসংখ্যার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তিনি আরও বলেন, দেশে বহু বছর আগে স্কুল ম্যাপিং হয়েছিল। এরপর আর এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাই আসলে কত সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, তা নিয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নেই। এ সমস্যা সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষক, ছাত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রকৃত চাহিদা নিরূপণে একটি জাতীয় জরিপ করে অতিরিক্ত প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আতিকুর রহমান বলেন, নীতিমালায় কিছু অস্পষ্টতাও রয়েছে। বলা হচ্ছে, ১০ হাজার জনসংখ্যার জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে। মাধ্যমিক পর্যায়ের তিন ধরণের প্রতিষ্ঠান হতে পারে। দেখা গেছে, ১০ হাজার জনসংখ্যার জন্য আইনের ফাঁক দিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের একটি করে বিদ্যালয়, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও দাখিল মাদ্রাসা স্থাপন হয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক: নবম জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিষয়ে অসংগতি চিহ্নিত করতে সাংসদ মো. শাহ আলমের নেতৃত্বে একটি সাব-কমিটি গঠন করে। গত ২২ জুন ওই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, সুষম নীতি অনুসরণ না করে কেবল রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও এমপিওভুক্তি হয়েছে। শিক্ষানগর নামে পরিচিত রাজশাহী। নগরসহ জেলা জুড়ে ব্যাঙের ছাতার মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। জেলায় প্রাপ্যতা অনুযায়ী ৩৫টি কলেজ থাকার কথা। সেখানে গড়ে উঠেছে ১৫৬টি কলেজ। এর মধ্যে মহানগরেই গড়ে ওঠা কলেজের সংখ্যা ৩২।রাজশাহী জেলায় রাজনৈতিক প্রভাবে কীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, এর প্রমাণ পাশাপাশি পাঁচ গ্রামে ছয়টি কলেজ স্থাপনের ঘটনা। জেলার দাউদকান্দি, তেজপাড়া, ভেড়াপোড়া, কালুপাড়া, ধোপাঘাটা ও কোরিসা গ্রাম মিলিয়ে বড়জোর দুই বর্গ কিলোমিটার এলাকা। এর মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে ছয়টি কলেজ। পাশাপাশি এই পাঁচটি গ্রাম পড়েছে রাজশাহীর দুর্গাপুর, মোহনপুর ও পবা উপজেলায়। এই তিনটি আবার পৃথক সংসদীয় এলাকা। এ জন্য সাংসদদের সুপারিশে দূরত্ব ও জনসংখ্যার শর্ত শিথিল করে পাঁচ গ্রামে ছয়টি কলেজ স্থাপন করা হয়েছে।ভেড়ামারা আদর্শ কলেজের অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম বলেন তখন স্থানীয়সাংসদ আনুষ্ঠানিক পত্রের মাধ্যমে দূরত্ব বিষয়ে বিদ্যমান শর্ত শিথিল করার অনুরোধ করেছিলেন। স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, এই এলাকায় এতগুলো কলেজ বানানো গেলেও ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা তো আর বাড়ানো যায় না। ছাত্রছাত্রী সংগ্রহের জন্য শিক্ষকেরা তাই বাড়ি বাড়ি যান। উপহারসামগ্রী নিয়ে হাজির হন।শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘ক্র্যাশ প্রোগ্রাম’-এর আওতায় গত জুন মাসে রাজশাহীর ২০৪১টি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা পরিদর্শন করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তাহমিনা বেগমের নেতৃত্বে ২৪টি গ্রুপ এসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। এ সময় তারা ৯৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ দেখতে পায়। এসএসসি, দাখিল এবং এসএসসি কারিগরি পরীক্ষায় শূন্য ভাগ পাস করা ৭২টি প্রতিষ্ঠান তারা পরিদর্শন করে। পরিদর্শক দলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিদর্শনে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্তির শর্ত পালন করা হচ্ছে না বলে দেখা গেছে।দিনাজপুরে প্রাথমিক থেকে শুরু করে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার ২০০। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ১৮০০। এ ছাড়া অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ১৪০০। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রাপ্যতার তুলনায় ওই জেলায় মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সংখ্যা প্রায় তিন গুণ। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শামসুল আলম বলেন, জেলায় এমন বিদ্যালয় আছে যেখানে বোর্ডের পরীক্ষায় অংশ নেয় তিনজন, পাস করে একজন। দিনাজপুর সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. ছফর আলী প্রথম আলোকে বলেন, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চলছে না, সেগুলো বন্ধ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিকটবর্তী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া উচিত।প্রদীপের নিচেই অন্ধকার: রাজশাহীতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অস্বাভাবিক হলেও ঢাকা শহরে এই সংখ্যা চাহিদার তুলনায় কম। ২০০৩ সালে জনসংখ্যা হিসাব করে দেখা যায়, ঢাকা মহানগরে আরও ৬৫৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকা উচিত। এর মধ্যে ৩৭৪টি বিদ্যালয়, ২৭৪টি মাদ্রাসা এবং আটটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ আছে। গত পাঁচ বছরে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বেড়েছে, এখন রাজধানীতে বসবাস করে প্রায় সোয়া কোটি মানুষ। এই হিসাবে কত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন তার হিসাব শিক্ষাবিভাগের কাছেও নেই।এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ২০০৩ সালের তুলনায় জনসংখ্যা বেড়েছে। তখনই ঢাকা শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ঘাটতি ছিল। এখন তা প্রকট হয়েছে। তিনি আরও বলেন, একটি মহাপরিকল্পনা ছাড়া শহরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়া ঠিক হবে না। তা ছাড়া এলাকাভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার বিকল্প নেই।সরকারি হিসাবে ঢাকা জেলায় ৫৮৫টি মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল থাকলেও দিনাজপুর জেলায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠান ৬৮৭টি। ঢাকার চেয়ে দিনাজপুর জেলায় ১০২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেশি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। কারণ ঢাকা জেরায় জনসংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ, দিনাজপুরে এই সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ।শিক্ষা বিভাগের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, গত তিন দশকে সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার দিক থেকে ঢাকা শহর পিছিয়ে আছে। এর মূল কারণ হিসেবে জমির দুষ্প্রাপ্যতা। ১৯৯৯ সালে সরকারি উদ্যোগে রাজধানীতে ১১টি মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে রাজধানীতে তিনটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। বাদবাকিগুলো চলে গেছে ঢাকার বাইরে। বিদ্যালয়ের জমির মূল্য বাবদ যে টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল, এর পরিমাণ যথেষ্ট ছিল না। ঢাকা শহরে যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর মানেও রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। মহানগরে সরকারি বিদ্যালয় রয়েছে ২৪টি। সব কটি সরকারি খরচে পরিচালিত হয়। শিক্ষকদের মানও কাছাকাছি। কিন্তু ঢাকা গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে প্রথম শ্রেণীর একটি আসনের জন্য প্রতিযোগিতা করে ১৪ থেকে ১৫ জন শিশু। মোহাম্মদপুর, মতিঝিল ও ধানমন্ডি এলাকার সরকারি বিদ্যালয়েও প্রতি আসনের জন্য ১০-১২ জন শিশু প্রতিযোগিতা করে। আর নবাবপুর, নিউ গভর্নমেন্ট স্কুল, ইসলামিয়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও মুসলিম হাইস্কুলে যত আসন তত শিক্ষার্থীও অনেক সময় পাওয়া যায় না।মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মো. ফরিদ উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠানের সুনাম আছে, সেই প্রতিষ্ঠানের দিকেই অভিভাবকেরা ঝোঁকেন। এ ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তি করার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের অবস্থান, শিক্ষার পরিবেশ ও অভিভাবকের সচেতনতা বড় বিষয়।প্রাথমিকে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাতে ভারসাম্য নেই: রাজধানীর বেশির ভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষক অনুপাতে বড় ধরনের তারতম্য রয়েছে। বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বাড্ডার ভোলা সরকারি বিদ্যালয়, এরশাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মান্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ রাজধানীর কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক অনুপাতে শিক্ষার্থী বেশি। প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, বাড়তি শিক্ষার্থী নিয়ে এসব বিদ্যালয় চললেও আরও অনেকেই এসব বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায়; কিন্তু সবাইকে সুযোগ দেওয়া যায় না।সরকারি হিসাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত এখন ১:৫০। এই অনুপাত কমিয়ে ১:৪৬ নির্ধারণের চেষ্টা চলছে। ২০০৩ সালের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা শিক্ষা কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিকে প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য ৪০ শিক্ষার্থী থাকা মানসম্মত। অন্যদিকে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে এই অনুপাত ১:৩০-এ নেমে আসা উচিত। খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে ৬৮ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু এবং প্রাথমিক শিক্ষার স্তর বিন্যাসের ফলে অবকাঠামো নির্মান ও শিক্ষক নিয়োগ খাতে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাব মতে, দেশের ৪৮ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালিত হয় সরকারি উদ্যোগে। বেসরকারি ও দাতা সংস্থাসহ বিভিন্ন উদ্যোগে পরিচালিত হয় বাকি ৫২ ভাগ প্রতিষ্ঠান। উল্লেখ্য, দেশে সরকারিসহ ১১ ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭৮ হাজার ৩৬৩টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষক আছেন প্রায় সোয়া তিন লাখ এবং শিক্ষার্থী প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ।মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ভারসাম্যহীনতা অস্বাভাবিক: মাধ্যমিক স্তর ও কলেজে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতের অবস্থা আরও খারাপ। সরকারি হিসাবে, দেশের ৪০ শতাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক অনুপাতে ছাত্র কম, বাকি ৬০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক অনুপাতে ছাত্র বেশি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১৮ হাজার ৭৭০, কলেজের সংখ্যা তিন হাজার ২৫৫টি।২০০৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায় একজন পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হওয়ায় গোপালগঞ্জের সাতপাড় হেমলতা আদর্শ গার্লস হাইস্কুল শতভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান পেয়েছে। টাঙ্গাইলের গোপালপুর শিমলা জমিরুন্নেসা গার্লস হাইস্কুল থেকে তিনজন, মাদারীপুরের শিবচর আব্দুস সাত্তার ইবনে হালিমা সিরাজ গার্লস একাডেমি থেকে ছয়জন, টাঙ্গাইলের ধোপকান্দি গার্লস হাইস্কুলের নয়জন শিক্ষার্থীর সবাই পাস করেছে। শতভাগের তালিকায় স্থান পেলেও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সেখানকার লেখাপড়া, শিক্ষকসহ সামগ্রিক অবস্থা ভালো নয়। গত ২৯ অক্টোবর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত ডিগ্রি পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, একজন পরীক্ষার্থীও পাস না করা কলেজের সংখ্যা ১৭টি। গত ২৬ মে প্রকাশিত মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, ৭২টি প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো পরীক্ষার্থী পাস করতে পারেনি। ২০০৪ সালে ওই সংখ্যা ছিল ৫৪৮। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, শিক্ষকের বেতন বন্ধ, এমপিও বাতিল, কারণ দর্শানোসহ বিভিন্ন কারণে শূন্যভাগ পাস করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমছে। মাদ্রাসায় নয় শতাংশ শিক্ষার্থী: দেশের মোট শিক্ষার্থীর নয় শতাংশ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। মাদ্রাসাশিক্ষা আধুনিকায়নের কথা বলা হলেও এর পাঠ্যবই, পাঠক্রম, পরীক্ষাসহ সবকিছুই পশ্চাত্পদ ধারায় চলছে। ফলে এই স্তরের বিপুল শিক্ষার্থী সমাজের মূল স্রোতধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। ২০০৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলে ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৬৯.১১ শতাংশ এবং মাদ্রাসা বোর্ডে ওই হার ছিল ৮৫.৮৫। এর কারণ জানতে চাইলে বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. ইউসুফ বলেন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ১০০ নম্বরের ইংরেজি পরীক্ষা দেয়, সাধারণ ধারায় ২০০ নম্বরের ইংরেজি পরীক্ষা দিতে হয়। এছাড়া মাদ্রাসার প্রশ্ন কিছুটা গতানুগতিক হয়। তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে মাদ্রাসায় ২০০ নম্বরের ইংরেজি চালু করা হয়েছে। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার সমমানে আনতে নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপ।দেশে মোট নয় হাজার ৩৭৬টি সাধারণ মাদ্রাসা রয়েছে (কওমি বাদে)। ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান বলছে, রাজশাহী বিভাগে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা তিন হাজার ৮৯টি দাখিল মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত ওই বিভাগের জেলাগুলোতে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও বেশি। ওই সব জেলায় শিক্ষার হারও তুলনামূলক কম। সারা দেশের মধ্যে মাদ্রাসার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহ জেলায়, ৩৯২টি। চট্টগ্রামে মাদ্রাসাশিক্ষার্থীর সংখ্যা শিক্ষার অন্যান্য স্তরের তুলনায় বেশি।মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাবে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ২০০১—২০০৫ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসার সংখ্যা বেড়েছে ২২.২২ শতাংশ এবং ওই সময়ে সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে ৯.৭৪ শতাংশ। তার আগে আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে (১৯৯৬—২০০১) সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছিল ২৮ শতাংশ এবং মাদ্রাসা বেড়েছিল ১৭ শতাংশ।উল্লেখ্য, দেশে কওমি মাদ্রাসা রয়েছে ১৫ হাজার ২৫০টি। এগুলোর ওপর সরকার বা শিক্ষা বিভাগের কোনো নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ নেই।অবহেলায় কারিগরি শিক্ষা: দেশে কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। শিক্ষার এই ধারায় বস্ত্র, কৃষি, কম্পিউটার, গ্রাফিক আর্টস, গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকস, মেরিন টেকনোলজিসহ ২৫ ধরনের কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। এ মুহূর্তে দেশের মাত্র ৪০ শতাংশ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত। অথচ মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত হয়েছে ৮০ শতাংশ। নবম জাতীয় সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির গঠন করা সাব-কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারিগরি শিক্ষার পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবই আধুনিক নয়। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই, অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ অপ্রতুল। সর্বোপরি, প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও চাহিদার তুলনায় কম। এ প্রসঙ্গে কমিটি আরও বলেছে, ২০০৮ সালে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পেছনে মোট বরাদ্দের শতকরা মাত্র ১.৮৭ শতাংশ ব্যয় হয়েছে কারিগরি শিক্ষা খাতে।শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, কারিগরি শিক্ষাকে অনাদর-অবহেলার জায়গা থেকে বের করে আনার চেষ্টা চলছে। যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে না, তাদের দক্ষ মানবশক্তিতে পরিণত করার লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষায় জোর দেওয়ার বিকল্প নেই।ঝরে পড়ার হার উদ্বেগজনক: সরকারি হিসাবে, এখন পর্যন্ত ১০ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসে না। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ৪৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। প্রথম শ্রেণীতে যারা ভর্তি হয় তাদের শতকরা ২০ জন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। শিক্ষাবোর্ডগুলোর কম্পিউটার কেন্দ্রগুলোর হিসাবে, গত কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, নবম শ্রেণীতে নিবন্ধন করা ছাত্রছাত্রীদের ৪২ থেকে ৪৬ শতাংশ এসএসসি পরীক্ষার আগেই ঝরে যায়। এ প্রসঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন, শিক্ষার সব স্তরে ঝরে পড়ার বড় কারণ দরিদ্রতা। এ ছাড়া সামাজিক বিভিন্ন কারণ ও সুযোগের অভাব রয়েছে। মন্ত্রী বলেন, রাতারাতি এ অবস্থায় পরিবর্তন আসবে না। তবে সরকার দরিদ্র এলাকায় টিফিন দেওয়া, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল এবং অনগ্রসর এলাকায় শতভাগ বৃত্তি দেওয়াসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (১৯৭০—২০০৮): সরকারি হিসাবে, ১৯৭০ সালে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার সংখ্যা ছিল সাত হাজার ৫২৩টি। এই সংখ্যা ২০০৮ সালে হয়েছে ৩১ হাজার ৪০১টি। তবে সারা দেশের গড় হিসাবে চার গুণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়লেও দেশের কিছু এলাকায় এই সংখ্যা বহু গুণে বেড়েছে। চার গুণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও শিক্ষার্থী বেড়েছে ১৯৭০ সালের তুলনায় পাঁচ গুণ। ১৯৭০ সালে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ছিল ২৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩৫১ জন। গত ৩৮ বছরে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে এক কোটি ৭৭ লাখ তিন হাজার ৫৮৫ জন।অন্যদিকে শিক্ষকের সংখ্যা বেড়েছে ছয় গুণ। ১৯৭০ সালে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকসংখ্যা ছিল ৭৪ হাজার ৮৯৫ জন। ২০০৮ সালে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ছিল চার লাখ ২৬ হাজার ৭৯১ জন।দায়দায়িত্ব কার, কতটুকু: অপরিকল্পিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, এর স্বীকৃতি ও এমপিওভুক্তিসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকেন জনপ্রতিনিধি বা শিক্ষা কর্মকর্তা। এদের কারও বিরুদ্ধে, কখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির গঠন করা সাব-কমিটির প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, এমপিও-সংক্রান্ত দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত, আগে তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা বাঞ্ছনীয়। প্রবীণ তিন শিক্ষক নেতা অধ্যক্ষ এম এ আউয়াল সিদ্দিকী, অধ্যক্ষ মাজহারুল হান্নান এবং এম এ বারী পৃথক শিক্ষক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তাঁদের অভিন্ন বক্তব্য হচ্ছে, শিক্ষায় আজকের সংকটের মূল কারণ রাজনৈতিক প্রভাবে অপরিকল্পিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। তাঁরা ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে এবং প্রয়োজনের ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির দাবি জানান। এর পাশাপাশি কারা, কীভাবে এসব প্রতিষ্ঠান গড়ার পেছনে কাজ করেছে, তা খুঁজে দেখার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করেন।প্রচলিত নিয়মে একবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হলে তা সাধারণত বাতিল হয় না। এতে বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি কমতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলাম বাজেট বক্তৃতায় প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে দেওয়া বরাদ্দ লেখাপড়ার পরিবেশ, পাসের হার প্রভৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করার কথা বলেন।শেষ কথা: এই মুহুর্তে শিক্ষার অনুন্নয়ন বাজেটের ৬২ শতাংশ খরচ হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা খাতে। রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি বা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে শিক্ষার রাজস্ব বাজেটের বাকি ৩৮ শতাংশও ধীরে ধীরে বেতন-ভাতা খাতে চলে যাবে, এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষাবিদ, শিক্ষকসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কেউই মনে করছেন না, ঢাকা শহরের বাইরে আর নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন আছে। এ প্রসঙ্গে সবার অভিন্ন মত হচ্ছে, জাতীয় পর্যায়ে আগে জরিপ করে কোথায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রয়োজন, তা চিহ্নিত করা উচিত। এ ছাড়া প্রয়োজন না থাকলেও গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধ বা পার্শ্ববর্তী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হোক।শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানিয়েছেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্বাচন করার লক্ষ্যে নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা আলাউদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে ১২ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাঁর আশা, আর কোনো অযোগ্য প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হবে না। রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার সামনে এই আশা কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে।বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৭ বছরে অপচয় ৩৫৬ কোটি টাকাবেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গত ২৭ বছরে ৩৫৬ কোটি ২৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকা অপচয় করেছে। ১৯৮১-৮২ সালে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) প্রতিষ্ঠার পর এই বিপুল আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সম্প্রতি এক তদন্তে দেখা গেছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত ১৬ ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: ভুয়া শিক্ষকের নামে টাকা উত্তোলন, নিয়োগবিধি অনুসরণ না করে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, সরকারের আর্থিক বিধি না মেনে অর্থ খরচ, প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও উচ্চতর স্কেল দেওয়া, ভুয়া শিক্ষার্থী ও শাখা দেখিয়ে শিক্ষকের নামে টাকা উত্তোলন প্রভৃতি।জানা যায়, ১৯৮১-৮২ সালে ডিআইএ দেশের ১৬১০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে প্রায় ১১ লাখ টাকার অনিয়ম খুঁজে পায়। সর্বশেষ ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ৮১০টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে প্রায় ৫৪ কোটি টাকার অনিয়ম পাওয়া যায়।একনজরে দেশের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রতিষ্ঠানের ধরন সংখ্যা শিক্ষার্থী শিক্ষক শিক্ষক: শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয় (১১ ধরন) ৭৮৩৬৩ ১৭৫৬১৮২৮ ৩১৫০৫৫ ১: ৫০ (মূল ধারা)মাধ্যমিক স্কুল ১৮৭৭০ ৬৮৪০৫৪১ ২১১৬৪৯ ১: ৩২ কলেজ ৩২৫৫ ১৯৪৮৪১৮ ৮৭১৩৬ ১: ২২ মাদ্রাসা ৯৩৭৬ ১৯৮৪৬২৬ ১২৮০০৫ ১: ১৬ কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৩৫৯০ ৪৫১৮১৭ ২১৬৬৬ ১: ২০ মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১১৩৩৫৪ ২৮৭৮৭২৩০ ৭৬৩৫১১ ...তথ্যসূত্র: জাতীয় শিক্ষা জরিপ (পোস্ট-প্রাইমারি), মে ২০০৯ এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত ২০০৫ সালের তথ্য, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন, ২০০৭ দেশের স্নাতক (সম্মান), চিকিত্সা, কৃষি ও প্রকৌশল শিক্ষা দেয়—এমন ৩৭০টি উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। এ ছাড়া কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের দাবি অনুযায়ী দেশে এ ধরনের মাদ্রাসা ১৫,২৫০; শিক্ষার্থী ১৮,৫৭,৫০০ ও শিক্ষক ১,৩২,১৫০ জন। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের দাবি অনুযায়ী কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি-মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৪০,০০০, শিক্ষকসংখ্যা ৩,২০,০০০ এবং শিক্ষার্থী প্রায় এক কোটি।এমপিও ফেরত দিয়েছে কয়েকটি কলেজদেশের প্রায় সাত হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিও পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করছে। এর পাশাপাশি রাজধানীর নটর ডেম কলেজ, সেন্ট্রাল রোডে আইডিয়াল কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এমপিও ফেরত দিয়েছে। রাজধানীর শেখ বোরহানুদ্দীন কলেজ এমপিও ফেরত দিতে চাইলেও কিছু শিক্ষক আইনের আশ্রয় নেওয়ায় বিষয়টি আটকে গেছে।নটর ডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার বেঞ্জামিন কস্তা বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বেতনের টাকায় চলতে পারায় আমরা অনুদান নেওয়া বন্ধ করেছি। আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ শামসুল আলম বলেন, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো অর্থের অভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। আমরা সরকারি অনুদানের অর্থ না নিলে সরকার তা সুবিধাবঞ্চিত এসব প্রতিষ্ঠানের পেছনে খরচ করতে পারবে। ঢাকা সিটি কলেজ ১৯৯৪ সালে সরকারের কাছ থেকে আর্থিক অনুদান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মিরপুর ঢাকা কমার্স কলেজ ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এমপিওভুক্তির আবেদন করেনি।[email protected]