বেদনায় থমকে আছে গলিটি

‘ক্রিকেটের পাগল ছিল ছেলেটা। টিভিতে কোনো খেলা দেখানো হলে কাজে আর মন বসত না তার। মাঝেমধ্যেই দোকান ফেলে ব্যাট হাতে পাড়ার ছেলেদের নিয়ে চলে যেত পাশের পোগজ স্কুলের মাঠে। এমনও হয়েছে—ক্রিকেট খেলতে গেছে, এদিকে খদ্দের এসে উপস্থিত। তখন ফোন করে ডেকে আনতে হয়েছে তাকে।’বিশ্বজিৎ দাস সম্পর্কে এই স্মৃতি বাবুল সুরের। শাঁখারীবাজারে তাঁর ভবনটিতেই বিশ্বজিতের দোকান। শনিবার যে ম্যাচটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ, আশপাশের দোকান মালিক-কর্মচারী ও বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে দেখেছিল সেই ম্যাচ। বিশ্বজিতের ‘নিউ আমন্ত্রণ টেইলার্স’ নামের দোকানটির মুখোমুখি বলাকা ইলেকট্রনিকস। দোকানমালিক রনি বর্মণ বিশ্বজিতের প্রায় সমবয়সী। তিনি বলছিলেন, ‘একসঙ্গেই আমরা ম্যাচ দেখলাম। বাংলাদেশ জয়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সামনের রাস্তায় নেমে পড়ি। বিশ্বজিৎ পতাকা বানিয়ে রেখেছিল। তা নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত আমরা শাঁখারীবাজার লেনের এ-মাথা ও-মাথা আনন্দ-উল্লাস করেছি, ছোটাছুটি করেছি।’রাত প্রায় সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বিশ্বজিৎ দাস লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে যে পথটি দিয়ে ছুটেছেন, পরদিন সকালে সেই পথের ওপরই তাঁকে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে হয়েছে নিজের রক্তের স্রোতের ওপর। অথচ মাঠে বসে টি-২০ ম্যাচ দেখবেন বলে টিকিটও কেটে রেখেছিলেন বিশ্বজিৎ। বাবুল সুর গতকাল প্রথম আলোকে জানালেন, ‘খেলাধুলা আর কাজ নিয়েই থাকত সে। আমার বাড়ির ছাদটায় রেলিং দেওয়া আছে। কাজ কম থাকলে ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে মাঝেমধ্যে ছাদে গিয়েও ক্রিকেট খেলত। মাঠে গিয়ে টি-২০ ম্যাচ দেখবে বলে কত আশা করে টিকিট কেটেছিল! এমন একটা নিরীহ ছেলের এই পরিণতি মানা যায় না!’গতকাল দুপুরে শাঁখারীবাজারে গিয়ে দেখা গেল, সরু গলিটি যেন অব্যক্ত বেদনায় থমকে আছে। বিশ্বজিৎ দাসের দোকান ১৩২ নম্বর ভবনের নিচের তলায় পেছনের সারিতে। দোকানটি বন্ধ। ভবনের সামনে পত্রিকায় প্রকাশিত বিশ্বজিতের ছবি আর সংবাদের কাটিং একটি বোর্ডে সেঁটে রাখা হয়েছে। তার ওপর একটি কালো পতাকা টাঙানো। কৌতূহলী লোকজন ভিড় করে আছে সেই বোর্ডের সামনে। প্রায় ছয় বছর ধরে এই দোকানেই দিনের প্রায় ১২ ঘণ্টা কাটিয়েছেন বিশ্বজিৎ দাস। উদ্যত অস্ত্রধারীদের ধাওয়ায় প্রাণ রক্ষার মরিয়া তাগিদে ছুটেও এসেছিলেন এদিকেই।ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আঘাতে বিক্ষত রক্তাক্ত দেহ। পিটুনিও সইতে হয়েছে বেধড়ক। বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তর পাশে ‘ইনসেনটিভ ডেন্টাল কেয়ার’-এর সামনে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকেই দৌড়ে এসেছিলেন প্রায় ৪০০ গজের মতো। হয়তো ভেবেছিলেন শাঁখারীবাজার গলিতে ঢুকে পড়লে পরিচিতজনেরা তাঁকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবেন। ঢুকেও পড়েন। কিন্তু পড়ে গেলেন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ নামে স্থানীয় একটি ক্লাবের সামনে। রক্তের ধারা ভিজিয়ে দিয়েছে সেই পথ, যেখানে আগের রাতেই তিনি বিজয় মিছিল করেছেন বাংলাদেশের জন্য।বিশ্বজিৎ দাসের ধারণা ভুল ছিল। তাঁকে রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। আর্তনাদ করে করে যখন প্রায় নিস্তেজ, তখন মোহাম্মদ রিপন নামের এক রিকশাচালক তাঁকে নিজের রিকশায় তুলে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান। রিপন প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, হাসপাতালে বিশ্বজিৎ দাসকে আনার পর রীতিমতো তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের সামনে পড়তে হয়। টিকিট কাউন্টার ও জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা তাঁকে বলেন, এসব ক্ষেত্রে আহত লোককে হাসপাতালে এনে থাকে পুলিশ, তিনি কেন এনেছেন। রিপন বলেন, জেরা করতে করতেই বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে যায়। তবে চিকিৎসায় বিলম্বের অভিযোগ মানলেন না মিটফোর্ড হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্ব পাওয়া ব্যক্তিরা। গতকাল যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, ‘অভিযোগটি সঠিক নয়। খুবই মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল। চিকিৎসার কোনো গাফিলতি হয়নি। এত রক্তক্ষরণ হয়েছিল যে, তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।’বিশ্বজিৎ দাসের শাঁখারীবাজারের এই দোকানটি প্রথমে ছিল তাঁর বড় ভাই উত্তম কুমার দাসের। এখানেই বিশ্বজিৎ পোশাক কাটা-সেলাইয়ের কাজ শেখেন। পরে উত্তম কুমার ছোট ভাইকে এই দোকানটি দিয়ে নিজে ৫৩ হূষিকেশ দাস রোডে ‘অতিথি টোইলার্স’ নামের একটি দোকান দেন। এই বাড়ির দোতলাতেই দুই ভাই থাকতেন। বাড়ির মালিক আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘উত্তম কুমার সস্ত্রীক তাঁর বাড়ির দোতলায় আছেন অনেক দিন থেকে। বছর পাঁচেক আগে ছোট ভাইকে নিয়ে আসেন। বিশ্বজিতের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কমই হয়েছে। সকাল ১০টা-১১টা নাগাদ শাঁখারীবাজার চলে যেতেন, ফিরতেন সেই রাতের ১১টায়। তবে তাঁরা দুই ভাই খুব নিরীহ গোছের লোক। পাড়ায় কারও সঙ্গে তাঁদের কোনো বিবাদ হয়নি।’ গত বাসায় ছিলেন না উত্তম কুমার। ভাইয়ের লাশ নিয়ে গেছেন গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে।শাঁখারীবাজারের দোকানগুলো খোলে সাধারণত একটু বেলা করে। সকাল ১০টা নাগাদ দোকান খোলা শুরু হয়। বন্ধও হয় বেশি রাতে, ১১টার পর। এটাই মহল্লার রেওয়াজ। বিশ্বজিৎ দাসও তাঁর দোকান খুলতেন ১০টার পর। কিন্তু শনিবার তিনি অনেক আগেই দোকানে গেলেন কেন—এই প্রশ্ন মনে জাগতে পারে। বিশ্বজিৎ আক্রান্ত হয়েছিলেন সকাল নয়টার দিকে। গতকাল উত্তম কুমার দাসের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে এই প্রশ্নে জবাব দেন তিনি। ‘সকাল সাড়ে আটটায় একটি ফোন আসে। তাঁর এক খদ্দের জরুরি প্রয়োজন থাকায় জলদি করে তাঁর পোশাকটি দিতে বলেন। ওই ফোন পেয়েই বিশ্বজিৎ দোকানে যাওয়ার জন্য তৈরি হন। কয়েক দিন আগে মা গ্রাম থেকে পিঠা পাঠিয়েছিলেন। সেই পিঠা খেয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন বিশ্বজিৎ। ঘণ্টা খানেক পর তিনি ফোন পান শাঁখারীবাজারের এক পরিচিত দোকানমালিকের কাছ থেকে। জানলেন, বিশ্বজিৎ গুরুতর জখম হয়েছে। ওকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।’ উত্তম কুমার জানান, তখনো শয্যা ছাড়েননি। আচমকা এই খবরে দ্রুত তৈরি হয়ে তিনি মিটফোর্ডে ছুটে যান। বিশ্বজিতের তখন আর কথা বলার শক্তি নেই। উত্তম কুমার বলেন, ‘একটি ঘরে টেবিলের ওরপ ওকে রেখে দিয়েছে। দেখলাম চোখ পিটপিট করছিল। ডাক্তার-নার্স আমাকে প্রথমে ঘরে ঢুকতেই দেননি। ভাই বলে পরিচয় দেওয়ার পর একটা কাগজে কিছু ওষুধের নাম লিখে দিয়ে আনতে বললেন। ওষুধ এনে দিলাম। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। একটু পর দরজা খুলে একজন নার্স এসে বললেন, ভেতরে আসেন। ভেতরে গেলাম। ডাক্তার বললেন, আপনার ভাই আর নাই।’