চারুকলার ৭০ বছরের শিল্প-ইতিহাস

‘নৌকা’, শিল্পী: জয়নুল আবেদিন
‘নৌকা’, শিল্পী: জয়নুল আবেদিন

এ বছর পূর্ণ হলো শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের হাতে গড়া বাংলাদেেশ প্রাতিষ্ঠানিক চারুকলা শিক্ষার ৭০ বছর। ১৯৪৮ সালে আর্ট স্কুল পর্যায়ের ইনস্টিটিউট এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। ৭০ বছর পূর্তি উৎসবের অন্যতম আয়োজন ছিল ‘প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষক-শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনী’। জয়নুল আবেদিন, আনোয়ারুল হক, সফিউদ্দিন আহমেদ, শফিকুল আমীন, কামরুল হাসান প্রমুখ প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষকদের কাজসহ এখানে ছিল বয়োকনিষ্ঠ শিক্ষকের ছবিও।

জয়নুল আবেদিনের নদী ও নৌকা বিষয়ক একটি জলরঙের ছবি স্থান পেয়েছিল এখানে। কোনো এক বনভোজনে গিয়ে আঁকা হয়েছিল ছবিটি। ‘নৌকা’ শিরোনামের চিত্রটিতে বনভোজনে উপস্থিত সহকর্মী ও শিল্পীদের স্বাক্ষরও রয়েছে। হালকা রঙের প্রলেপ, বলিষ্ঠ রেখা ও তুলির আঁচড়ে জানান দেয় এটি জয়নুলের কাজ।

‘মেলার পথে’, শিল্পী: সফিউদ্দিন আহমেদ
‘মেলার পথে’, শিল্পী: সফিউদ্দিন আহমেদ

১৯৪৭ সালে আঁকা সফিউদ্দিন আহমেদের উড এনগ্রেভিংয়ে করা ‘মেলার পথে’ কাজটিতে জোরালো পাশ্চাত্য পরিপ্রক্ষিতের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ বিষয়ের সামাজিক, নৈসর্গিক প্রেক্ষাপট স্পষ্ট। কামরুল হাসানের চিত্রে আছে লোকবাংলার সরাচিত্রের শৈল্পিক উপাদান।

পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষকদের মধ্যে কাইয়ুম চৌধুরী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, রফিকুন নবী, মরণচাঁদ পাল, আব্দুস শাকুর শাহের কাজে স্বকীয়তা ও দেশজ উপাদানে শিল্পভাষা তৈরি অনুমেয়। তাঁদের কাজে মাটি, মানুষ দেশ ও সংস্কৃতির বয়ান রয়েছে।

আবার পাশ্চাত্য করণকৌশলের মধ্য দিয়েই প্রাচ্য নন্দনতত্ত্বের সংশ্লেষ রয়েছে চারুকলার প্রথম দিকের শিক্ষক আনোয়ারুল হকের পাখির দৃষ্টিতে দেখা ‘মাছ ধরা’ চিত্রটিতে। তেল রঙের দ্বিমাত্রিক লেপনে নীল পানিতে হালকা নীলে পানির ঢেউয়ের রেখা—ছবিটি সরলীকরণের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।

‘মাছ ধরা’, শিল্পী: আনোয়ারুল হক
‘মাছ ধরা’, শিল্পী: আনোয়ারুল হক

অনেকের কাজে আছে প্রাচ্যের ইজমভিত্তিক অনুশাসন, আবার অনেকের কাজে পাওয়া গেল স্বদেশ-কালের আধুনিক ভাষা তৈরি জন্য প্রাচ্যের শিল্পভাষার নানা উপাদানের অনুষঙ্গ। শহিদ কবিরের কাজটিতে নিরাভরণ শরীরী মডেল ও বাংলা বর্ণমালাসহ বাঁশিওয়ালার অভিব্যক্তি প্রাচ্য নন্দনত্ত্বের স্বরূপ বিশ্লেষিত হয়েছে।

শিশির ভট্টাচার্য্য আর নিসার হোসেনের কাজে সৌন্দর্যের চেয়ে বুদ্ধি-বিচার্য পাঠ নিতে পারা যায় বেশি মাত্রায়। এঁদের সূত্রধরে পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষক সহিদ কাজী, বিশ্বজিৎ গোস্বামী, দীপ্তি রাণী দত্ত, সঞ্চয় চক্রবর্তী, সুমন ওয়াহিদের কাজেও বুদ্ধিবৃত্তিক খেলা দেখা যায়। সর্বকনিষ্ঠ শিক্ষক অমিত নন্দীর কাজও ছিল মনে রাখার মতো।

চারুকলার ৭টি বিভাগে হাতে-কলমে শিল্পশিক্ষা দেওয়া হয়। তবে এ প্রদর্শনীতে বিভাগ ভিত্তিক কাজের বৈচিত্র্য ঢাকা পড়েছে মূলধারার শিল্পমাধ্যম পেইন্টিংয়ের বহুত্বে। ফলে শিল্পভাষায় মাধ্যমগত যে বৈচিত্র্যের জন্য বিভাগগুলো সৃষ্টি হয়েছিল তার অগ্রগতি, প্রচার প্রসার নিয়ে প্রশ্ন রাখা যেতে পারে। তবু সব মিলিয়ে বলতে হবে, প্রয়াত শিক্ষকদের স্মরণ, প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষকদের পরিচয় এবং চারুকলার ৭০ বছরের শিল্প-ইতিহাসের হিসাব কষা গেল এ প্রদর্শনী দেখে। ১০ ডিসেম্বর জয়নুল গ্যালারিতে শুরু হয়ে প্রদর্শনীটি চলেছে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত।