পারাপার

দাঁড়িয়ে আছি।
লম্বা সারি। সামনে আমার মতোই আরও অনেক যাত্রী। তাদের বেশভূষা দেখে কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না।
তারা পুরুষ না মহিলা?
অস্ট্রিয়ান না ক্যারাবিয়ান?
আশ্চর্য! কাস্টমসের এই ঘরটা আমার দেখা সবচেয়ে আলোকিত আর আধুনিক। কিন্তু চেহারা কিংবা লিঙ্গ আঁচ করতে পারছি না মোটেও। শুধু দুপেয়ে অবয়ব বলে দিচ্ছে তারা সবাই মানুষ।
ঘরটার চারপাশ দেখতে দেখতেই আমার ডাক পড়ল। সাদা মসলিনের চাদর জড়ানো একজন গার্ড আমার ব্যাগ খুলে দেখতে চাইলেন। উফফ...। কী বিরক্তিকর! প্রতিবার কাস্টমসে এই একই ঝামেলা। শিলং যাওয়ার বেলা সামান্য একটা খেলনা নিয়ে কী একটা ঝামেলায় পড়ে গেলাম ।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও ব্যাগ খুলতে হলো ।
ব্যাগ খুলে গার্ড সাহেব সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। নিঃশব্দে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের করে আমার দিকে তাকিয়ে একটি বাঁকা হাসি দিলেন। তারপর তিনিই স্তব্ধতার কাফন ছিঁড়ে বললেন, ‘তুমি যেতে পারো’।
- কিন্তু আমার ব্যাগ?
- সেটার আর কী প্রয়োজন?
-কী প্রয়োজন মানে? এই ব্যাগে আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আর সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলো রাখা...।
শৈশবে বাবার কিনে দেওয়া গোলাপি রঙের বারবি পুতুল। আমি এতগুলো বছর থেকে সেটা আগলে রেখেছি। সেটা আজ ফেলে যাব?
আমার শৈশবের অসংখ্য অমূল্য ক্রেস্ট, মেডেল। একসময় এগুলোর মোহেই বাঁচতাম। আমি সব রেখে যাব?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন’স অ্যাওয়ার্ড, আমার ‘ফটোফাই’। ফটোফাই যন্ত্রটি বানাতে আমি ১৩ বছর লাগিয়ে দিয়েছি। সূর্যালোকের কারণে গাছের পাতায় হওয়া উদ্দীপনাকে ওয়াইফাই সিগন্যালে বদলে দিত এ যন্ত্রটি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার আমি সঙ্গে নেব না? কোনো কথা হলো?
ব্যাগের একদম কোনায় রাখা টোপাজের আংটি। আমার জন্মদিনে আমার স্বামী দিয়েছিলেন। আমি মধ্যাঙ্গুলে পরলে তিনি প্রায়ই ম্যাক্রো মোডে ছবি তুলতেন।
আমার সবচেয়ে পছন্দের অলংকার আমি আর পরব না?
আমি চিৎকার করে গার্ডকে এসব বলছি। অশ্রু চোখের বাঁধ ভেঙেছে কবেই...। জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদগুলো ফেলে কেন যাব, কী করে যাব?
গার্ড আবার হেসে বললেন, ‘সম্পদ কোথায়? এ তো সব সম্পত্তিমাত্র। ভ্রমের পৃথিবীকে পেছনে ফেলে এ মহাযাত্রায় তুমি এগুলোকে আর সম্পদ বলতে পারো না। তুমি যে দেশে যাচ্ছ, সে দেশে এগুলোর কোনো প্রয়োজন নেই।’
তিনি কথা শেষ করতে করতেই অন্য দুজন গার্ড আমাকে কাস্টমসের বাইরে নিয়ে গেলেন। অসম্ভব সুন্দরী এক রমণী বললেন, ‘পরকালে তোমাকে স্বাগতম!’
অন্ধকার, অচেনা একাকী পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি...। অদৃশ্য দেয়াল থেকে শুনতে পারছি আমার আর্তনাদের প্রতিধ্বনি ‘রিক্ত আমি, আমায় ঋদ্ধ করো।’