কবিতা হাড়ের মধ্যে রাত জাগে

আমার কবিতা কি জীবন্ত?
১৮৬২ সালে টি ডব্লিউ হিগিনসনকে এক চিঠিতে প্রশ্নটি করেন এমিলি ডিকিনসন। চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন, ‘মন নিজেই এত কাছে যে সে স্পষ্ট দেখতে পায় না।’ এমিলির এ প্রশ্ন ও উপলব্ধি কবিতা শাশ্বত জিজ্ঞাসা। জগতে কবিতাজিজ্ঞাসার কোনো শেষ নেই। কবি তাঁর কবিতার এত কাছে, প্রস্তুতি ও রচনা প্রক্রিয়ায় এতটাই যন্ত্রণাবিদ্ধ যে তাঁর পক্ষে দূরে দেখা কঠিন। কবিতা তো শুধু ভাষা নয়, যখন কবিতা লেখা হয়, তখন তা হয়ে ওঠে ভাষার কারুকাজ। এর ভেতরে ভাষার সব দিক—যেমন গতি শব্দ, ছন্দ, গীতিময়তা—শব্দার্থ ও নিহিতার্থ সবকিছুই জড়িয়ে থাকে। পৃথিবীর সব কবিই এমিলির মতো এই শাশ্বত জিজ্ঞাসার মুখোমুখি। আমিও। আমার চলার পথের কত অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে এসব কবিতায়। হাতের কাছে যা পেয়েছি, তাকেই আরাধ্যজ্ঞানে বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছি অক্ষরের তুড়ি বাজিয়ে। এখন চারপাশে সমাপ্ত (অসমাপ্তও) কত চরণ। কত নিদ্রাহীন রাত আর কত অতৃপ্ত দিনের অন্তহীন কোলাহলের সাক্ষী কবিতাগুলো। একজীবন কাটিয়ে দিচ্ছি কবিতার জন্য, এ এক সীমারেখাহীন অন্বেষণ। কবিতা আমার হাড়ের মধ্যে রাত জাগে, আমার রক্তমাংসে বাংলা ভাষায় চিৎকার করে। সে চিৎকার আমাকে স্বপ্ন ও বাস্তবের অতিক্রান্ত এক জগতে নিয়ে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে আমি পাঠকের কাছে বারবার নত হই।

প্রতি জন্মে হতে চাই কবিতা উৎসব
যদি পাথরে পাথর ঘষে কবিতা লিখতে পারি
সেখানে প্রথম শব্দ পূর্বপুরুষের
পেরিয়ে এসেছি আমি বনভূমি, গুহাদিন
কাঁচা মাংস, প্রস্তর মহিমা
পেরিয়ে এসেছি আমি অভিবাসনের কাল
সভ্যতার প্রতর্ক ও কোলাহলসীমা
দিগন্তে অযুত স্বপ্ন, প্রতিফলনের ধ্বনি
ষড়্ঋতু যাপনের তীব্র হাততালি
জাতিস্মর সেই শব্দ—প্রত্ন-চিৎকার
সেই শব্দ ধাবমান কাদা, ধুলোবালি
পাথরে পাথর ঘষি, জানু পেতে বসেছি আদিম
বিন্দু বিন্দু বহ্নিশিখা, দাও অনুভব
প্রতি জন্মে হতে চাই কবিতা উৎসব।

এসো, জেগে উঠি
এসো, জেগে উঠি সুপ্রাচীন কোলাহলে
এসো, কান্না লুকাই আজ উন্মুক্ত সরোবরে
এই পরিযায়ী গ্রামে, এই অবকাশে—এসো
ডাকি নিশাচর। দেখি, দেখি দুঃখগুলো
আমাদের রক্তস্রোতে কীভাবে যাচ্ছে ভেসে
অকাল বন্যায়।
এভাবেই জল ও ডাঙায় আমরা আজ খড়কুটো
এভাবেই প্রান্তরের ট্রেন চেপে আমাদের নাতিশীতোষ্ণ রেখা
এভাবেই অমুদ্রিত চুম্বনে উড়ে যাচ্ছে সব কাঁটাতার
এসো আজ, ধ্বংস চিহ্নের নিচে
ক্যালেন্ডারে লিখে রাখি প্রাচীন তারিখ
আমাদের রক্তমাংসে লেখা ইশতেহার।
এসো, প্রত্নফসিলের ক্লেদে চিৎকার হোক
যে নিষিদ্ধ দিগন্তদৃশ্যে নতজানু অনিচ্ছুক আগুন
সেখানে শান্তিজল, সেখানে বুকসমান উঁচু জলে
থমকে যাক তোমার–আমার সূর্যাস্ত
অক্ষরের আদি পিতা–মাতা, আদিপুত্র, আদি কন্যা, তারা দেখুক
মানুষ এখনো সত্য—পৃথিবীও শরীরে প্রাচীন।