ত্রয়ীর প্রাচ্যভাবনা

‘বৃষ্টিস্নাত নৃত্য’, শিল্পী: জাহাঙ্গীর আলম
‘বৃষ্টিস্নাত নৃত্য’, শিল্পী: জাহাঙ্গীর আলম

গুরু–শিষ্য পরম্পরাই হচ্ছে প্রাচ্য শিল্পের মূল চেতনা। প্রাচ্য শিল্প মানেই ঘরানাভিত্তিক শিল্পের বিস্তার। একটি রীতিকে প্রতিষ্ঠিত করা, একটি সাধনালব্ধ আঙ্গিককে প্রতিনিয়ত চর্চার মধ্যে গুরু এক নিজস্ব ভুবন তৈরি করে, অতঃপর শিষ্যদের মধ্যে সেটি ছড়িয়ে দেন। এভাবে তৈরি হয় পরম্পরা। সম্প্রতি ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেসে ‘গুরু-শিষ্য: শিষ্য-গুরু’ এই এক শিরোনামে শুরু হয়েছে এক যৌথ চিত্র প্রদর্শনী ।

প্রাচ্যভাবনা ও প্রাচ্য আঙ্গিক প্রসূত এই প্রদর্শনীটি ইতিমধ্যে শিল্পামোদী কলারসিকদের ভেতরে বেশ সাড়া ফেলেছে। মলয় বালা, জাহাঙ্গীর আলম ও অমিত নন্দী। প্রাচ্য রীতির গুরু–শিষ্য পরম্পরার তিন শিল্পী। তিনজনেই পরস্পরের গুরু আবার শিষ্যও। তবে প্রদর্শনী থেকে বোঝার উপায় নেই কে শিষ্য, কে গুরু। তবে এই শিল্পীরা যে একটি প্রাচ্য বোধের চেতনা দ্বারা তাড়িত তা বলা যায়।

প্রাচ্য বোধ আসলে কী? যা আমাদের এই ভূখণ্ডের সংস্কৃতিকে প্রতিফলিত করে, যা আমাদের জল-মাটি থেকে উৎসারিত, যার শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। অবনীন্দ্র, নন্দলাল, অমিতকুমাররা চেয়েছিলেন প্রাচ্য শিল্পের শেকড়ের অনুসন্ধান এই বাংলাতেই। সফলও হয়েছিলেন। তবে পাশ্চাত্যে বেনোজলে অনেকটাই যেন ভেসে গেল।

মলয়, জাহাঙ্গীর ও অমিত—এই তিন শিল্পীর প্রতিনিয়ত চর্চার স্থল ‘দি ওরিয়েন্টাল পেইন্টিং স্টুডিও’। এই চিত্র-কর্মশালাতেই তাঁরা চর্চা করে আসছেন দীর্ঘদিন। প্রাচ্য রীতি অনুশীলনের পাশাপাশি প্রাচ্যবিষয়ক অধ্যয়ন, আলাপচারিতা ইত্যাদির মধ্য দিয়েও সমৃদ্ধ হয়েছেন তিন শিল্পী। বলার বিষয় হলো, তিনজন একই স্টুডিওর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও প্রত্যেকের স্বকীয়তা এবং স্বাতন্ত্র্যতা চোখে পড়ার মতো। কেউ কাউকে অনুসরণ করেনি। হেঁটেছেন নিজস্ব পথে। যেমন, ধৌত পদ্ধতিতে প্রলেপের পর প্রলেপ এঁকে মলয় এক ঐন্দ্রজালিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেন। শিকড়–বাকড়ের আবহের মধ্যে ধোঁয়াশে মানব অবয়ব তৈরি করে প্রাচ্য শিল্পের এক রহস্যময় বিস্তার ঘটান।

আবার বর্ণ নিয়ে বরাবরই এক ধরনের খেলায় মেতে ওঠেন জাহাঙ্গীর। প্রাচ্য শিল্পের প্রচলিত শৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন আঙ্গিকে নির্মাণে সচেষ্ট তিনি। খেয়ালি বর্ণ বিস্তারের মধ্য দিয়ে যেন এক ধরনের শরীরী অবয়ব দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

অমিতের কাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, প্রাচ্য ভাবাদর্শে কিছুটা আধুনিক আঙ্গিকে ভারতীয় মিথ-পুরাণের নানা কল্প-কাহিনিকে তুলে ধরা। দৃশ্যগতভাবে তা আমাদের সামনে আধুনিকভাবে উপস্থাপিত হলেও সেটি প্রাচ্য ভাবাদর্শে উজ্জীবিত। অমিতের ছবি ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়েছে।

১৮ জানুয়ারি শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে আজ ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।