হলোগ্রামে দেখা মুখ

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

সাইকেল

তাহমিনা বেগম স্বপ্নে দেখেন, লিজার বাবা একটা নতুন সাইকেল নিয়ে ঢুকছেন উঠানে। তাঁকে খুব হাস্যোজ্জ্বল আর সুখী দেখাচ্ছে। লিজার মাকে দেখতে পেয়েই বললেন, ‘লিজার জন্য কিনে আনলাম। কত দিন ধরে আবদার করছে মেয়েটা।’

‘কিন্তু লিজা তো নেই। তুমি যেন কিছুই জানো না!’

লিজার বাবাকে খানিকটা বিচলিত দেখাল। তিনি লিজার মায়ের ভুল ভাঙাতে চাইলেন, ‘তুমি যেটা বলতেছ, সেটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল। এখন সব ঠিক হয়ে গেছে।’

‘কিন্তু এখন কি আমি স্বপ্ন দেখতেছি না?’

‘ওই যে, দেখো লিজা আসতেছে।’

স্কুলের পোশাক পরা লিজা বেরোল ঘর থেকে। সে উঠানে এসে সাইকেলসহ বাবাকে দেখে খুশি হলো এবং সাইকেলটা নিয়ে উঠানের আয়তাকার জায়গাটাতে চালাতে চেষ্টা করল।

তাহমিনা বেগম লক্ষ করলেন মেয়ের মাথার চুল এলোমেলোভাবে কাটা। হাত ও মুখে আঘাতের চিহ্ন। জঙ্গলে ওর মৃতদেহ পাওয়ার আগে কাটা চুলগুলো পাওয়া গিয়েছিল খালের পাড়ে। তাহমিনা বেগম মেয়ের এই হাল দেখে উদ্বিগ্ন হলেন।

‘তাহলে সেটা কি সত্যিই দুঃস্বপ্ন ছিল?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী দেখছিলা তুমি?’

‘ঠিক তোমার দুঃস্বপ্নটার মতো। সব ঘটনাই এক।’

‘কিন্তু স্বপ্ন দুটো একই রকম ছিল কি না, আমরা তো মিলায়া দেখি নাই।’

‘আমি জানি, সবকিছুই ছিল এক। আমাদের উদ্বেগ, লিজাকে খুঁজতে বেরোনো, জঙ্গলে মৃতদেহ পাওয়া, থানা-পুলিশ, গোয়েন্দা-পুলিশ তারপর অপরাধ তদন্ত বিভাগ, প্রচুর জেরা, ডিএনএ টেস্ট, মৃতদেহ কবর থেকে তোলা, কয়েকবার পোস্টমর্টেম, কিন্তু ফরেনসিক বিভাগের কোনো রিপোর্টেই মৃত্যুর কারণ লেখা না থাকা...। তখন কেউ একজন বলবে, “লিজা মরেনি। মৃত্যুর কারণ না থাকলে সে মরতে যাবে কেন?” আবার কেউ বলবে, “জীবন্ত মেয়েকে কবর দেওয়া ঠিক হয় নাই।”... এসব নিয়া হুলুস্থুল কাণ্ড, তারপর হুমকি-ধমকি...।’

‘হ্যাঁ, একদম তাই।’

‘কিন্তু দুঃস্বপ্নটা কি আমরা একসঙ্গে দেখতেছিলাম?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখন?’

লিজার বাবাকে আনমনা দেখায়। তাহমিনা বেগম জিজ্ঞেস করেন, ‘এখন কি স্বপ্নটা তুমি দেখতেছ না আমি?’

লিজার বাবা কী যেন খুঁজতে ঘরের ভেতর গেলেন। তাহমিনা বেগম দেখলেন, মেয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তিনি কিছু একটা আঁচ করলেন আর মেয়েকে পেছন থেকে অনুসরণ করে গেলেন। লিজা আঙিনার পাশে কাঁঠালগাছের গোড়ায় সাইকেল ঠেস দিয়ে রেখে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই মায়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কি সত্যিই আমাকে কবর দিয়েছ?’

সাধু

আজমত মাঝেমধ্যে সাধু-সঙ্গ করতে যেত।

একবার পরীক্ষা চলছে, ওই সময়ে উধাও হয়ে গেল। হলে ফিরল দীর্ঘদিন পর। জানা গেল, এত দিন ভারতবর্ষের নানা জায়গায়, নানা তীর্থে আর আস্তানায় সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ঘুরেছে সে।

ড্রপ-আউট এড়াতে তাকে অনেক দিন ধরে ক্লাস-পরীক্ষা চালিয়ে যেতে হলো। তাই দীর্ঘদিন ধরে হলে থাকতে সে বাধ্য হলো।

ক্যাম্পাসে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠল সে। বলল, নাগরিক মানুষ তাকে ক্লান্ত করে। বাসনাতাড়িত, লোভী আর কুটিল মানুষগুলোর মধ্যে থাকতে তার দমবন্ধ লাগে।

একদিন দেখা গেল কাঠের বাক্সে করে একটা সাপ নিয়ে এসেছে। সাপটাকে সে টিকটিকি কিংবা পোকা ধরে খাওয়ায়। শীতল রক্তের এই মৌনী প্রাণীটির সঙ্গে এক দুর্বোধ্য যোগাযোগ গড়ে তোলে সে।

মাঝেমধ্য তাকে জিমনেসিয়ামের পেছনের জঙ্গলে একা একা হাঁটাহাঁটি করতে দেখা যায়। কখনো শণে ঢাকা হাঁটাপথের ধারে বসে থাকে একা। কেউ কেউ বলল, জঙ্গলে থাকা শিয়ালগুলোকে সে ডেকে আনতে পারে।

প্রাণিজগতের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা থেকে কিংবা মৌনী প্রাণীটির অত্যধিক নীরবতায় কিছুটা ক্লান্ত হয়েই সে একদিন একটি পাখির খাঁচা নিয়ে হলে ঢোকে। খাঁচার ভেতর দুটি নীল-সাদা বাজরিগার। কিচিরমিচির শব্দে ঘরের নীরবতা খান খান। পাখি দুটিকে সে তিল-তিসি খাওয়ায় আর তাদের দুর্বোধ্য ভাষা রপ্ত করার চেষ্টা করে।

কিছুদিনের মাথায় দুটি ঘটনা ঘটল। একদিন ক্লাস থেকে ফিরে সে দেখল, সাপটা বাক্সের বাইরে আর সেটা বাজরিগার দুটিকে হত্যা করেছে। দ্বিতীয় ঘটনাটি একই রকম মর্মান্তিক—একদল পিঁপড়ের আক্রমণে সাপটির মৃত্যু হয়েছে।

এরপর থেকে একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল সে। ক্লাসে নেই, চায়ের দোকানগুলোতে নেই, জিমনেসিয়ামের পেছনের জঙ্গলেও তাকে ঘুরতে দেখা যায় না। জানা গেল, সে আবার উধাও হয়েছে।

বহুদিন পর এক সন্ধ্যাবেলা সে ফিরে এল। তার দৃষ্টি অত্যধিক শান্ত আর অন্তর্ভেদী। মুখে অদ্ভুত রকম দীপ্তি। আমি বিস্ময় নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি আর তার দৃষ্টির হেঁয়ালি আমাকে বিদ্ধ করছে। মৃদু হেসে সে গুনগুন করে গাইল—ভাব আছে যার গায়, দেখলে তারে চেনা যায়, সর্ব অঙ্গ তাহার পোড়া রে!