কবি আল মাহমুদ: স্মৃতিকথা

আল মাহমুদের ভুবনে
‘কবিতা তো মক্তবের মেয়ে, চুল খোলা আয়েশা আক্তার’। কবিতাকে একদিন এভাবেই ডেকেছিলেন আল মাহমুদ। সমকালীন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান এই কবি লোকান্তরিত হয়েছেন সম্প্রতি। তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এ আয়োজনে থাকছে তাঁর অপ্রকাশিত কবিতা, নাসির আলী মামুনের নেওয়া সাক্ষাৎকার এবং তাঁকে নিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণের লেখা।

কবি আল মাহমুদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৬৭ সালের কোনো একদিন। ডিআইটি রোডে অবস্থিত বিখ্যাত মাসিক সাহিত্যপত্র সমকাল কার্যালয়ে আমি সম্পাদক কবি সিকানদার আবু জাফরের রুমে বসেছিলাম। কবি সিকানদার আবু জাফরকে আমি বলতাম জাফর ভাই। কণ্ঠস্বর পত্রিকায় আমার কবিতা প্রকাশের আগে জাফর ভাই সমকাল–এ আমার একটি কবিতা ছেপেছিলেন।

সমকাল কার্যালয়ে তখন দেশের সেরা কবি-সাহিত্যিকেরা আসতেন। সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত সেখানে আড্ডা হতো। আমি ছিলাম ওই আড্ডার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। তখন ভালো কবিতা না লিখলেও পরে একসময় আমি ভালো কবিতা লিখতে পারব—এ রকম ধারণা জাফর ভাইয়ের কেন হয়েছিল, তা আজও আমার অজানাই রয়ে গেল। আমি যে ‘হুলিয়া’ কবিতা রচনার দোরগোড়ায় রয়েছি, এটি জাফর ভাই মনে হয় আঁচ করতে পেরেছিলেন। আমি যে হুলিয়া মাথায় নিয়ে, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলাম, জাফর ভাই তা জানতেন। তখনকার দৈনিক পাকিস্তান–এর সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীব বা উন্মত্ত প্রজন্মের প্রিয় সাহিত্যপত্র কণ্ঠস্বর সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আমাকে সে রকম অভয় দিতে পারেননি।

জাফর ভাইকে আমি বলেছিলাম, আমি কবি আল মাহমুদের সঙ্গে পরিচিত হতে আগ্রহী। তিনি কি সমকাল–এ আসেন?

জাফর ভাই বলেলেন, আসবে না মানে, আসতেই হবে।

জাফর ভাইয়ের কথার সত্যতা প্রমাণিত হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। একদিন পড়ন্ত দুপুরের দিকে কবি আল মাহমুদ সশরীরে হাজির হলেন সমকাল কার্যালয়ে।

স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরা, গলায় ময়লা মাফলার জড়ানো, নিঃশব্দ চরণে সমকাল-এ প্রবেশকারী এই আগন্তুককে দেখে আমি ভাবতেই পারিনি, ইনিই কবি আল মাহমুদ। যদিও সমকাল কবিতা সংখ্যায় তাঁর ছবি আমি দেখেছিলাম।

আগন্তুককে স্বাগত জানিয়ে জাফর ভাই বললেন, এই যে আল মাহমুদ, তোমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য এই তরুণ কবি অপেক্ষা করছে।

আল মাহমুদ? আমি চমকে উঠে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। কবি আল মাহমুদ হাত বাড়িয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমি মুগ্ধ হলাম তাঁর সারল্যে। তাঁকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে ভাবলাম, কোট–প্যান্ট পরা আধুনিক কবিদের এই দাপটের যুগেও আল মাহমুদের মতো কবি হওয়া তবে এখনো সম্ভব!

আল মাহমুদ তখন দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় অতি সামান্য বেতনে চাকরি করেন। তিনি উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত কেউ নন, এটা জেনে আমি নিজের ব্যাপারে কিছুটা আশ্বস্ত বোধ করলাম। আমার প্রিয় দুই প্রধান কবির শিক্ষাভাগ্য আমার শিক্ষা দুর্ভাগ্যের বেদনাকে অনেকটাই লাঘব করে দিল।

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ লোক–লোকান্তর আমি পড়েছি এবং ওই গ্রন্থের কিছু কবিতা আমার মুখস্থ আছে জেনে তিনি খুব খুশি হয়ে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

দুই.

আমি আল মাহমুদের লিরিক কবিতার ভক্ত ছিলাম। আমি তাস খেলার পাগল। পরে ভিন্ন খেলায় চলে গেলেও শুরুতে ব্রে খেলাটা আমার খুব প্রিয় ছিল। আমি আল মাহমুদের ‘ব্রে’ কবিতাটি পড়ে মুগ্ধ হই। বলি, আপনার ‘ব্রে’ কবিতাটি আমার মুখস্থ আছে: ‘যখন জীবনে শুধু লাল হরতন/

একে একে জমা হলো, বলো এ কী অসম্ভব বোঝা/ মুক্ত হয়ে হাঁটবার বন্ধ হলো সব পথ খোঁজা—এদিকে তুমিও এলে ইসকার বিবির মতন’।

কবিতাটি তিনি তাঁর স্ত্রী নাদিরাকে উৎসর্গ করেছেন। যাঁরা ব্রে খেলা জানেন, তাঁরা এই কবিতার রস যতটা গ্রহণ করতে পরাবেন, যাঁরা জানেন না, তাঁরা ততটা পারবেন না। তাস খেলার এমন নৈপুণ্যভাস্বর কাব্যরূপ বাংলা কবিতায় আর দ্বিতীয়টি নেই। নবাগতা স্ত্রীকে বিড়ম্বিত কবিজীবনে স্বাগত জানাবার এর চেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল আর কী হতে পারে?

আমার মুখে তাঁর লেখা ব্রে কবিতাটির আবৃত্তি শুনে তিনি মুগ্ধ হলেন।

আমি বললাম, নাদিরা ভাবিকে আমার সালাম জানাবেন।

আল মাহমুদ খুশি মুখে হাসতে হাসতে বললেন, আপনি একবার আসুন আমার বাসায়, নাদিরা তাতে বেশি খুশি হবে।

কিছুদিনের মধ্যেই আমি আল মাহমুদের বাসায় গিয়েছিলাম। নাদিরা ভাবি সেদিন আমাকে ভাত না খাইয়ে ফিরতে দেননি।

‘ব্রে’ কবিতাটি নিয়ে আলাপ হয়েছিল। ভাবি জানতেনও না তাঁর স্বামী তাঁকে নিয়ে এ রকম একটি লজ্জাজনক কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি, ওই কবিতাটি আবার তাঁর নামে উৎসর্গও করেছেন।

ভাবির আগ্রহে ‘ব্রে’ কবিতাটি আমি আবারও পড়লাম।

ভাবি খুশিও হলেন। আবার কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বললেনও, এ রকম কবিতা আপনার ভাই যদি আর কখনো লেখেন, তো আপনার ভাইয়ের কিন্তু খবর আছে।

ফেরার সময় মাহমুদ ভাই বললেন, নাদিরা দারুণ মেয়ে, না?

আমি বললাম, হুম, নিঃসন্দেহে। আমার খুব ভালো লেগেছে ভাবিকে।

তিন.

আমার কাছে, কবি আল মাহমুদ ও নাদিরা ভাবি আজও সেই দৃশ্যে স্থির হয়ে আছেন।

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, নয়াগাঁও, ঢাকা।