এক অসামান্য শিল্পীর আত্মকথা

>
অভিনয়জীবন আমারফেরদৌসী
মজুমদারপ্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯
১৫২ পৃষ্ঠা, দাম: ৩০০ টাকা।

কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পী ফেরদৌসী মজুমদার। বাংলাদেশের মঞ্চ ও টেলিভিশনে তাঁর নানা ধরনের স্মরণীয় চরিত্রচিত্রণ এখনো দর্শকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। এর মধ্যে পার করেছেন অভিনয়জীবনের ৫০ বছর। এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের নাট্যজগতে তৈরি হয়েছে তাঁর স্বতন্ত্র একটি অবস্থান। সম্প্রতি অভিনয়জীবন আমার নামে তাঁর যে একটি আত্মজীবনীমূলক বই প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে লেখা আছে তাঁর অভিনয়জীবনের অদ্যোপান্ত। আমি এক ক্ষুদ্র অভিনয়শিল্পী। ফলে অগ্রজ শিল্পীর অভিনয়জীবন সম্পর্কে জানতে এ বইটি যখন পড়ছিলাম, চোখের সামনে ভেসে উঠছিল নানা চরিত্র ও অনেকগুলো কাল। এই বইয়ে ফেরদৌসী মজুমদার নিজের অভিনয়জীবন উন্মোচন করেছেন টুকরো টুকরো স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে। ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে শুরু করেছেন অভিনয়জীবন। কাজ করছেন এখন পর্যন্ত। সে সবের বর্ণনাগুলো পড়লে মনে হবে যেন তিনি আমারই সামনে বসে খোলামনে বলে যাচ্ছেন কথাগুলো। শুধু নিজের একার কথা নয়, তাঁর পরিবার, জীবনসঙ্গী রামেন্দু মজুমদার, মেয়ে ত্রপা মজুমদার এবং সহশিল্পী আবদুল্লাহ আল মামুন, মমতাজউদ্দিন আহমেদ, আতিকুল হক চৌধুরী, সৈয়দ আহসান আলী সিডনী, হুমায়ুন ফরীদিসহ আরও অনেকের কথাই এসেছে প্রসঙ্গক্রমে।

আলোচ্য বইয়ে নিজের জীবনকে তিনি চারটি ভাগে ভাগ করেছেন—প্রারম্ভিকা, মঞ্চের আমি, টেলিভিশনের আমি, অন্যান্য মাধ্যমের আমি। প্রারম্ভিকায় বলেছেন তাঁর পরিবারের কথা, কীভাবে ভাই মুনীর চৌধুরীর হাত ধরে মঞ্চে প্রথম কাজ শুরু করলেন, বাবার কড়া শাসনের আগল ভেঙে পরম নিষ্ঠায় অভিনয়কে আপন করে নিলেন। তাঁর প্রেম ও পরিণয়–জীবনের কথাও বলেছেন। লিখেছেন কেমন করে স্বামী-সংসার-সন্তান সামলে কাজ করেছেন তিনি।

সেই যে শওকত ওসমানের ডাক্তার আবদুল্লাহর কারখানা নাটকের মাধ্যমে অভিনয়জীবন শুরু হলো তাঁর, তারপর একে একে অভিনয় করেছেন যোগাযোগ, চারিদিকে যুদ্ধ, পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, ওথেলো, ম্যাকবেথ, কৃষ্ণকান্তের উইল, কুহকজাল, কোকিলারা—এই সব উল্লেখযোগ্য নাটকে। অনেক নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি নির্দেশনাও দিয়েছেন। এ বইয়ের একটি চমকপ্রদ বিষয় হলো, এখানে প্রতিটি নাটক প্রসঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে স্মৃতিরোমন্থন করেছেন ফেরদৌসী। একটি নাটকের ভেতর নিজেকে কীভাবে প্রবেশ করান, কিংবা স্ক্রিপ্ট আত্মস্থ করা থেকে শুরু করে অভিনয়ের টেকনিকগুলো—সবকিছুই তিনি বর্ণনা করেছেন সাবলীল ভাষায়। ফলে অভিনয় শেখার জন্য এবং অভিনয়শিল্পীদের জন্য বইটি খুবই দরকারি বলে মনে হয়েছে আমার।

ফেরদৌসী মজুমদারের বইটি পড়ে আমাকে যা আলোড়িত করেছে তা হলো শিল্পীর বিনয়। এত শিল্পসফল কাজ করার পরও নিজের লেখায় কোনো অহংবোধ নেই তাঁর; বরং প্রতিমুহূর্তেই তাঁর প্রতিটি ভালো কাজের জন্য তাঁর নির্দেশক, দর্শক, সহকর্মীদের উচ্চে তুলে ধরে মূল্যায়ন করেছেন, ধন্যবাদ দিয়েছেন। আর যে কাজটি তাঁর নিজের কাছে উল্লেখযোগ্য হয়নি, অবলীলায় সেখানে তিনি তাঁকে নিজের অক্ষমতা বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতো অবিসংবাদিত অভিনয়শিল্পীর পক্ষে এমন কথা বলা নিরহংকারী মানুষের পরিচায়ক বৈকি। এ থেকে কাজের ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

বইয়ের আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো ফেরদৌসী মজুমদার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে নিজেকে পরিবর্তিত করেছেন, চরিত্র রূপায়ণে ভিন্নতা এনেছেন। এ বিষয়ে বেশ খোলাখুলিই লিখেছেন তিনি। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর মনের দ্বান্দ্বিকতা যে আসেনি তাও নয়, আঘাত তাঁর মনেও বেজেছিল গোচরে-অগোচরে। বর্ণনা করেছেন এভাবে: ‘দলীয় নাটকে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত থাকাটাই বড় কথা। “এ নাটকে আমি আছি”—এ অনুভূতিটাই মহা স্বস্তির ও শান্তির, তাই যখন মাধবীর মহড়া চলছিল, আমি বাড়িতে বসে অস্থির থাকতাম। ভাবতাম, আমি কিছু করতে পারছি না। আমি সবার সঙ্গে থাকতে পারছি না। তবে কি আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে?’ (পৃ: ৯৯)

ছোট্ট এই পুস্তকে অকপটে নিজের অভিনয়জীবনের যে কথাগুলো লিখেছেন লেখক, আশা করি তা পড়তে খুবই ভালো লাগবে। ভাব প্রকাশের সরলতায়, বয়ানে বয়ানে নিজের ইতিহাসের ভেতর দিয়ে এ অভিনয়শিল্পী যেন আমাদেরই বলে যাচ্ছেন, শিল্পীজীবনও নিঃশেষ হবে। তাঁর ভাষ্যে, ‘আস্তে আস্তে এ দেউটিগুলোও নিভে যাবে। তথাকথিত অভিনয় থেমে যাবে। আর কেউই থাকবে না। সেটাই সর্বকালের সবচেয়ে বড় সত্য। কিন্তু থাকল আমার এই বই আর আমার কাজ আর কথা।’ (পৃ: ১১৯)।

বইটি বড় ভালো লেগে গেল, পড়ার পর মনে হলো, ‘পিপাসা হায় নাহি মিটিল...।’