মায়ের চোখে শহীদ বদির মুক্তিযুদ্ধ

শহীদ বদিউল আলম বদি। ছবি: সংগৃহীত
শহীদ বদিউল আলম বদি। ছবি: সংগৃহীত

রওশন আরা খানম মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলার আর দশজন মায়ের মতোই মা ছিলেন। সে সময় যাঁরা সারা দেশের শহর-নগর ও গ্রামাঞ্চলের আনাচে-কানাচে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ও তাদের এ–দেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামসের নেতা-সদস্যদের নির্বিচার নির্যাতন, লুটপাট, জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, গুম-খুনের ঘটনা দেখেছেন, সরাসরি তাদের লালসার শিকার হয়েছেন, তাঁরা যেমন ক্ষেত্রবিশেষে নিজেরাই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, তেমনি নিজেদের প্রিয় সন্তান, স্বামী কিংবা আত্মীয়স্বজনকে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে নিঃসংকোচে সমর্থন দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে মায়েদের এহেন নানা চরিত্রের বীরত্বসূচক ভূমিকার কথা ক্রমেই উঠে আসছে আমাদের সাহিত্যে—কখনো তাঁদের নিজেদের লেখা স্মৃতিভাষ্যে, কখনোবা দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় পক্ষের সংগৃহীত ও পরিবেশিত মুক্তিযুদ্ধসম্পৃক্ত তথ্যের মাধ্যমে। রওশন আরা খানম তেমন একজন মা, যিনি প্রায় অনুপুঙ্খভাবে লিখেছেন নিজের বীর ছেলে, মুক্তিযুদ্ধে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য শহীদ বদিউল আলম বীরবিক্রমের শৈশব, কৈশোর এবং তরুণ বয়সের বৃত্তান্ত, স্কুলজীবন ও ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে তাঁর শিক্ষাজীবনের কথা। বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও করাচির শিক্ষাজীবন এবং তখনকার পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের প্রত্যক্ষ সাক্ষী বদিউল আলম বদির ব্যক্ত অনুভূতি ও মতামত সম্পর্কেও। ছোট-বড় ৫১টি অধ্যায়ের মাধ্যমে বদির সামগ্রিক জীবনগত পরিচয় তুলে ধরেছেন তিনি।

ফলে আমরা দেখি, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর ‘অপারেশন সার্চ লাইট’–এর দুদিন পর ২৭ মার্চ আধবেলার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হলে নিজের মোটরবাইক নিয়ে বদি বেরিয়ে পড়েন বাসা থেকে। ঢাকা শহর ঘুরে ঘুরে দেখেন পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া গুলিগালায় নিহত অগুনতি মানুষের লাশ, ধ্বংস ও বর্বরতার চিহ্ন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা ওই দিনই ঢাকা ছাড়েন। কিন্তু মা রওশন আরার হাজার কাকুতি-মিনতির মুখে বদি বলেন, তিনি যাবেন না। বাড্ডা পর্যন্ত এসে সেখান থেকে মা-বাবা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের বিদায় জানান তিনি। মাকে বিদায় দেওয়ার সময় বলেন, ‘মা, তোমার ছয় ছেলে। এক ছেলেকে দেশের জন্য উৎসর্গ করতে পারবে না?’

বদির সেদিনের চিত্র এঁকেছেন তাঁর মা, ‘সেদিন তার চোখে-মুখে প্রতিশোধের যে আগুন ঝরে পড়েছিল, হানাদারদের বিরুদ্ধে যে আক্রোশ, ঘৃণা ফুটে উঠেছিল, তা দেখে তাকে বাধা দেওয়ার শক্তি আমার আর ছিল না।’

তারপর প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন বদি। সাহসকে সঙ্গী করে বহু পথ ঘুরে কিশোরগঞ্জে যান তিনি। এখানে তখন অবস্থান করছিল দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। শপথ নেন। অস্ত্র চালনার ট্রেনিংও নেন। তারপর পুরোদমে নেমে পড়েন গেরিলা অভিযানে। অবশেষে হন ক্র্যাক প্লাটুনের সাহসী, জীবন বাজি রাখা সদস্য।

মা হিসেবে রওশন আরা খানম ছেলের সামরিক অভিযান যতটুকু দেখেছেন, এ বইয়ে তা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু যা তিনি দেখেননি, যা ছিল তাঁর দৃষ্টিসীমা ও এলাকার বাইরের, এখানে সেসবের বিবরণও তুলে ধরা হয়েছে একটু ভিন্নভাবে, ভিন্ন সূত্র থেকে। তাই শহীদ বদিকে জানার জন্য আলোচ্য গ্রন্থের বিকল্প নেই।

এর ‘প্রকাশকের কথা’–তে বলা হয়েছে, ‘শহীদ বদির মা রওশন আরা খানম...তাঁর পাণ্ডুলিপিটি চূড়ান্ত করে যেতে পারেননি। তাতে কিছু অসম্পূর্ণতা ও তথ্যগত অসংগতিও ছিল।’

প্রকৃত গবেষকের মতো এই অসম্পূর্ণতা ও তথ্যগত অসংগতি দূর করেন রুবিনা হোসেন। কাজটি করার জন্য তাঁকে অভিনন্দন। এ কাজটুকু না করলে বদিউল আলম পরিচালিত অভিযানগুলো সম্পর্কে আমরা অন্ধকারেই থেকে যেতাম।

শহীদ বদি ও আমার স্মৃতিতে একাত্তর

রওশন আরা খানম
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৯
১৪৩ পৃষ্ঠা
দাম: ৩০০ টাকা।