'জন্মদিন পালনের দায় থেকে আমি মুক্ত ও স্বাধীন'

>
কবির প্রতিকৃতি ও অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
কবির প্রতিকৃতি ও অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
আজ কবি নির্মলেন্দু গুণের ৭৫তম জন্মদিন। জয়ন্তী উপলক্ষে এখানে প্রকাশিত হলো কবির সাক্ষাৎকার। কথায় কথায় নির্মলেন্দু গুণ বলেছেন সংস্কৃত কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে। বলেছেন কেন জন্মদিন উদ্‌যাপন করতে চান না তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

আলতাফ শাহনেওয়াজ: আজ আপনার ৭৫তম জন্মদিন। ৭৫ বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে আপনি প্রাচীন সংস্কৃত কবিতা অনুবাদ করতে শুরু করেছিলেন। এ বছরের মার্চ মাস থেকে এখন অব্দি অনুবাদ করেছেন বেশ কিছু কবিতা। হঠাৎ সংস্কৃত কবিতা অনুবাদে আগ্রহী হলেন কেন?

নির্মলেন্দু গুণ: ভিনদেশি কবিতার অনুবাদ আমি আগেও করেছি। ভিয়েতনামের কবি তো হুর একটি কবিতার বই আমি ভিয়েতনাম ভ্রমণকালে ১৯৮২ সালে কবির কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলাম। বইটির নাম ছিল ব্লাড অ্যান্ড ফ্লাওয়ার্স। ভিয়েতনামের ভাষা তো আমি জানি না, আমি অনুবাদ করেছিলাম ইংরেজি থেকে। তো ওই বইয়ের কিছু কবিতা বাংলায় অনুবাদ করে একটি বই প্রকাশ করি আমি—রক্ত আর ফুলগুলি নামে। তা ছাড়া কার্ল মার্ক্সের চারটি এবং লুই হোর্হে বোর্হেসের দুটো কবিতাও আমি অনুবাদ করেছি।

কবিতাকুঞ্জ গড়তে গিয়ে বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশের কবিতার বই সংগ্রহ করেছি আমি। এরই একপর্যায়ে প্রাচীন সংস্কৃত ভাষার কবিদের লেখা কবিতার একটি (ইংরেজিতে অনুবাদিত) কবিতা সংকলন হাতে পেলাম। সেখানে চতুর্থ শতক থেকে সপ্তম শতকের সংস্কৃত ভাষার কবিদের কবিতা আছে। আমি যে সময়ের কবিতার কথা বলছি, তখন পৃথিবীতে বাংলা ভাষা বলে কোনো ভাষা তৈরি হয়নি। যাহোক, সংস্কৃত ভাষার কবিদের কবিতাগুলো আকারে ছোট বলে আমি সহজেই এগুলো পাঠ করতে পারি। কবিতাগুলো আমার বেশ ভালো লেগে যায়। এবং আমি ওই কাব্যসংকলনভুক্ত কবিতাগুলোর অনুবাদ করতে শুরু করি। এ পর্যন্ত ৩০টি কবিতার অনুবাদ করেছি, আরও কিছু কবিতা অনুবাদের ইচ্ছা আছে।

আলতাফ: কবিতাগুলো অনুবাদের পর নিয়মিত সেগুলো ফেসবুকে দিচ্ছেন আপনি। সেখানে দেখা যায়, যেসব কবিতায় প্রেম, শরীর ও যৌনতা মুখ্য হয়ে উঠেছে, সেগুলোই আপনি অনুবাদ করেছেন। এর কারণ কী? কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে আপনার বিবেচনাগুলো কী?

গুণ: ওই সংস্কৃত কাব্যসংকলনটির নামই হলো ইরোটিক পোয়েমস ফ্রম দি সাংস্কৃত।কামমুখ্য কবিতাগুলোই সেখানে সংকলিত হয়েছে। সুতরাং আমাকে কামনির্ভর কবিতাগুলো নিজে বেছে নিতে হয়নি। তবেপড়তে পড়তে আমি ওই কবিদের রচিত কবিতার সঙ্গে একাত্ম বোধ করেছি। আমার মনে হয়েছে, এই সংস্কৃত কবিতাগুলো আমিই রচনা করেছিলাম, পূর্বজন্মে—আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে। এ ছাড়া বলার বিষয় হলো, এখানে অনেক কবি আছেন, যাঁদের নাম–পরিচয় পাওয়া যায় না। অন্যদিকে নাম জানা কবিও রয়েছেন বেশ কয়েকজন। কবিতা বিচারে এবং অনুবাদের ক্ষেত্রে অজ্ঞাত কবি ও জ্ঞাত কবিদের মধ্যে পার্থক্য করিনি আমি।

আলতাফ: অনুবাদের ক্ষেত্রে আপনি কিছুটা স্বাধীনতা নিয়েছেন। সংস্কৃত কবিতাগুলো নির্দিষ্ট ছন্দে রচিত হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আপনি এর ছান্দিক অনুশাসন অপেক্ষা সাবলীল গদ্য অনুবাদের দিকেই অধিক মনোযোগ দিয়েছেন। এতে হয়তো কবিতাগুলোর এক ধরনের আধুনিকায়নও ঘটছে। এ ক্ষেত্রে অনুবাদক হিসেবে আপনার ভাবনা জানতে চাই।

গুণ: ছন্দকে আমি কবিতার জন্য কখনোই খুব অবশ্যমান্য কিছু বলে মনে করিনি, এখনো করি না। আর সংস্কৃত কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদেও ছন্দকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। কথা হলো, মূল সংস্কৃত কবিতাগুলো তো আমি দেখিনি, পড়িনি। পড়েছি ইংরেজি অনুবাদ। আমি মনে করি, কবিতার আক্ষরিক অনুবাদ সম্ভব নয়, এবং তা শোভনও নয়। ভাবানুবাদই কবিতার ক্ষেত্রে অধিকতর গ্রহণীয়। নিয়ারার টু ভাইটাল ট্রুথ অব পোয়েট্রি।

আলতাফ: এবার ভিন্ন প্রসঙ্গ। বেশ কিছুকাল ধরে নিজের জন্মদিন পালনে আপনি তেমনভাবে উৎসাহী নন। জন্মদিন পালনের ব্যাপারে হঠাৎ আপনার এই অনাগ্রহ কেন?

গুণ: জন্মে আমার আপত্তি নেই। আমি তো সানন্দেই জন্মগ্রহণ করেছিলাম এক বর্ষাসিক্ত আষাঢ়স্য সকালে। যদিও জন্মগ্রহণের সময়কার স্মৃতি কোনো মানুষের মনে থাকে না, তারা ভুলে যায়। তবে জন্মদিনটিকে মানুষ ভালোবেসে মনে রাখে। পালন করে। ছোটদের জন্য এটা ঠিকই আছে। কিন্তুজন্মদিন পালন করা বা জন্মদিন পালনে অন্যদের উৎসাহিত করাটা আমার কাছে ক্লান্তিকর এবং কিছুটা গ্লানিকর বলেও মনে হয়েছে। এটা সময়ের অপচয়ও বটে। প্রতিদিনের মতো দিনই আমার কাছে স্বস্তিদায়ক, এই রকম ভাবনা থেকেই আমি কয়েক বছর ধরে জন্মদিন পালন করা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছি। এর সুফলও পেয়েছি আমি—এখন আর আসন্ন জন্মদিনের স্নায়ুচাপ অনুভব করি না। মনে হয়, জন্মদিন পালনের দায় থেকে আমি মুক্ত ও স্বাধীন।

আবার অন্যদের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যাওয়ার অনুরোধ এড়ানোর জন্যও আমার এইরূপ অবস্থান সহায়ক হয়েছে। এই সঠিক সিদ্ধান্তটি একটু বিলম্বে হলেও গ্রহণ করতে পারার জন্য আমি খুব খুশি। ভাগ্যিস এই চিন্তাটা আমার মাথায় এসেছিল। থ্যাংকস টু মাই হেড।

আলতাফ: এখন চলছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। এই খেলা নিয়ে আপনার উৎসাহ তো সুবিদিত। প্রথম আলোতে নিয়মিত কলামও লিখছেন। কবিতা ও ক্রিকেটকে আপনি কীভাবে দেখেন?

গুণ: কবিতা ও ক্রিকেট—দুটোই আমার প্রিয়। ৫৭ বছর ধরে আমি ক্রিকেট শুনছি, দেখছি এবং ক্রিকেট নিয়ে লিখছি। কবিতার পেছনে যত সময় আমি দিয়েছি, ক্রিকেটের পেছনে তার চেয়ে বেশি বৈ কম দিইনি। আমার রচনাবলি যে অনেকের চেয়ে কম হয়েছে, তার কারণ এই নয় যে, আমার লেখার বিষয় ও ভাবের অভাব ছিল। তার কারণ এ-ও যে, আমি যতটা কবিতামগ্ন, শিল্পমগ্ন, তার চেয়েও বেশি ক্রীড়ামগ্ন। উত্তেজনা ছাড়া আমি চলতে পারি না। ক্রিকেট, ফুটবল এবং অলিম্পিকের বিভিন্ন খেলা আমাকে সেই নির্দোষ উত্তেজনার জোগান দেয়। আর কবিতাও তো উত্তেজনার ফসলই বটে।

আলতাফ: ৭৫ বছরের দীর্ঘ জীবন আপনার। জীবন নিয়ে আপনার উপলব্ধি কী?

গুণ: ভালো। আমি যে এ রকম দীর্ঘ জীবন লাভ করলাম, সে জন্য স্রষ্টার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার পিতা-মাতার কাছে কৃতজ্ঞ। আমি কৃতজ্ঞ আমার ডাক্তারদের কাছে, যাঁরা নানা সময়ে ও নানা দেশে সুচিকিৎসা দিয়ে আমাকে সুস্থ করে তুলেছেন।