'নিজেকে আমি কখনো ক্ষমা করি না'

আল মাহমুদ (১১ জুলাই ১৯৩৬—১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
আল মাহমুদ (১১ জুলাই ১৯৩৬—১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
মৃত্যুর পর আল মাহমুদের প্রথম জন্মদিন ছিল গতকাল। শেষ দিকে তিনি ছিলেন খুবই অসুস্থ, কথা বলতে পারতেন না বেশিক্ষণ। তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল কয়েক দফায়, ২০১৬-১৭ সালে। সে সময় আলাপনে কবি ফিরে তাকিয়েছিলেন নিজের কবিতা, জীবন, প্রেম ও দর্শনের দিকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবিদ আজম


আবিদ আজম: জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লিখতে প্রতিজ্ঞ ছিলেন আপনি। কিন্তু অসুস্থতার কারণে লেখালেখি ছেড়ে দিয়েছেন পুরোপুরি। লেখার ইচ্ছে আর জাগে না? 

আল মাহমুদ: কবিতা তো আমৃত্যু লিখতে ইচ্ছে করে। একদিন কবিতা আমাকে হাসিয়েছে, কাঁদিয়েছে। এ ছাড়া আরও নানান বিষয়-আশয় নিয়ে লেখার ইচ্ছে ছিল আমার, লিখতে পারিনি। আত্মজীবনীমূলক রচনা ছাড়াও মন্ত্রের মতো কিছু কবিতা লেখার ইচ্ছে ছিল। এই আফসোস নিয়েই হয়তো আমাকে চলে যেতে হবে। একজন বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে আমি অবশ্য পুনর্জন্মে বিশ্বাসী নই। তবু আবারও জীবন পেলে আমি কবিই হতে চাইব। আমার কবিজীবন পূর্ণ হয়নি। আরও কিছু কাজ রয়ে গেছে। 

আবিদ: শেষ বয়সে পৌঁছানোর পর দেখা যাচ্ছে, আপনার প্রায় সব লেখাই মৃত্যুগন্ধী। এর কারণ কী? মৃত্যু নিয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাই। 

মাহমুদ: ডেথ ইজ ডেথ। মৃত্যুর দুয়ার থেকে কেউ ফিরে এসে বলেনি মৃত্যু এমন। মৃত্যুই সত্য, আর সব মিথ্যা। মরণ এলে মরে যাব। একটা কথা আছে না, ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর সে কোথা কবে?’ হ্যাঁ, আমার মৃত্যু আসবে, গভীর আলোর মধ্য দিয়ে পথ হেঁটে হেঁটে চলে যাব আমি, অজানার উদ্দেশ্যে, মরণের দুয়ারে। তবে এতেই যে আমার শেষ হবে তা নয়। আশা করি আমার সাহিত্যকীর্তির মাধ্যমে হাজার বছর বেঁচে থাকব আমি। আজকাল এটা ভেবে অনেকেই বিস্মিত হন, আল মাহমুদ এখনো বেঁচে আছে! দীর্ঘায়ু হয়ে বেঁচে থাকাটা তাই আমার জন্য যেমন গৌরবের, তেমনি কিছুটা লজ্জারও। 

আবিদ: সৃষ্টির বেদনা আদতে কেমন? এ ব্যাপারে কী মনে হয় আপনার? 

মাহমুদ: সৃষ্টির বেদনা আদতে বিমূর্ত বিষয়। একটা দেশের সঙ্গে, তার প্রকৃতি, মাটি ও নদীর সঙ্গে একজন কবির রক্ত-মাংস জড়িত। দেশ যেমন থাকে, একজন কবিও তেমনি থাকেন। তাঁর অন্য কোনো ভালো-মন্দ নেই। তাঁর দেশাত্মবোধ প্রবল। কিন্তু যাকে বলে সৃজনবেদনা, সেটা তৈরি করার জন্য মানুষের মনে একটা গুপ্ত ব্যথা থাকতে হয়। আর কবিদের মধ্যে এটা থাকে সবচেয়ে বেশি। তো তোমার প্রশ্নের উত্তর জানতে সেই বেদনাকে বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যে এর মধ্যে কী আছে। 

আবিদ: সোনালি কাবিনের উৎসর্গপত্রে কাব্যসহযাত্রীদের উদ্দেশে আপনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের এককালীন বন্ধুত্ব ও সাম্প্রতিক কাব্যহিংসা অমর হোক।’ সতীর্থ কবিদের মধ্যে অনেক সময় একে-অপরের প্রতি ঈর্ষা লক্ষ করা যায়। আপনার মধ্যে কি কখনো কারও প্রতি এই ঈর্ষা কাজ করেছে? 

মাহমুদ: বন্ধু হিসেবে আমার এখনো সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে শহীদ কাদরীকে। সত্যি বলতে, আমি নিজে কখনো কারও প্রতি কোনো ঈর্ষা বোধ করিনি। আমার সঙ্গে কারও কোনো প্রতিযোগিতার ব্যাপার ছিল না। আমার সময়ে সামনে কেবল একজন বড়মাপের কবি ছিলেন—তিনি শামসুর রাহমান। তাঁর সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল, বন্ধুত্বও বলা যায়। তাঁর মৃত্যুর কয়েক দিন আগেও আমার বাসায় এসেছিলেন তিনি। তাঁর পছন্দমতো চা খেয়ে বিদায় নিয়েছিলেন। অগ্রজের সম্মান সব সময়ই আমি তাঁকে দিয়েছি। তবে কবিদের ঈর্ষার কথাটায় আমি বিশ্বাস করি। কেননা, ব্যক্তিগতভাবে সারা জীবন আমি অনেক ঈর্ষাকাতর বন্ধুদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ফজল শাহাবুদ্দীনসহ আমার পঞ্চাশের বন্ধুরা আমাকে ঈর্ষা করত কি করত না, সেটা এখন আর আমার না বলাই ভালো। শুরুতে ঢাকায় আসার পর তো কেউ দাঁড়ানোর জায়গাই দিতে চায়নি। তাঁদের অনেকের কারণে আমাকে অনেক মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছে। এরপরও সর্বদা আমি বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করতে চেয়েছি। যদিও আমিই সব সময় বলে এসেছি যে আধুনিক কবিদের কোনো বন্ধু হয় না। 

আবিদ: আপনার কবিতায় প্রেম একটি বড় উপাদান হিসেবে প্রতিভাত হয়। কবিরা কি আদতে আজন্ম প্রেমিক? 

মাহমুদ: প্রেম আমার কাছে কবিজীবনের এক অপরিহার্য সম্পদ। প্রেমিক একটা ভাব আমার মধ্যে আছে বলেই এই কাজটা সহজে করতে পারি আমি। নারীর দেহের দোলাচালটা আমার মধ্যে অহরহ ঢেউ খেলে যায়। আমি লিখতে পারি। এই যে এখন বয়স হয়েছে, কিন্তু মনের প্রেম কি বুড়ো হয়! কিন্তু আমার প্রেম এখন মানব-মানবীকে অতিক্রম করে অসীমতার ঊর্ধ্বালোকের দিকে নিয়ে যেতে সচেষ্ট। 

আবিদ: জীবনের এ পর্যায়ে এসে ব্যক্তি–মানুষ হিসেবে নিজেকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? 

মাহমুদ: আই উইশ টু বি আ পয়েট অ্যান্ড থিংকার, নট আদারস। মানুষ হিসেবে অবশ্য কবি আল মাহমুদকে আমি পাত্তা দিই না। নিজেকে আমি কখনো ক্ষমা করি না, আমি সব সময় উচ্চকণ্ঠ থাকি। মানুষ হিসেবে আমার ন্যায়-অন্যায় দুটোই থাকতে পারে। আমি নিজেকে বিচার করতে জানি। মাঝেমধ্যে ভাবি, আমার নানাবিধ রচনার এই পাহাড় কখন যেন নিজের শরীরের ওপর ভেঙে পড়ে ভূমিকম্পের মতো। জীবন নিয়ে আমি অবশ্য তৃপ্ত, নৈরাশ্যবাদী নই। যেটুকু পাওয়ার সেটুকুই পেয়েছি; যা প্রাপ্র্য ছিল না পাইনি—এই তো! 

আবিদ: নিজের একটি গদ্যে একবার আপনি লিখেছিলেন, আপনার কোনো আদর্শ নেই, আপনি ফিকশন দ্বারা চালিত হন। নিজের জীবনদর্শন সম্পর্কে কী বলবেন? 

মাহমুদ: ওখানে যেটা লিখেছি তা সাহিত্যের আল মাহমুদ প্রসঙ্গে। প্রকৃতপক্ষে সমাজতন্ত্র বা পৃথিবীর কোনো আদর্শবাদের প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। একসময় খুব স্বাভাবিক পড়াশোনার মধ্য দিয়ে মার্ক্সবাদের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলাম। এই দর্শনের সঙ্গে আমার একধরনের সম্পৃক্ততাও ঘটে গিয়েছিল। তবে অন্য অনেক পড়াশোনা আমাকে এর থেকে সরে আসার প্ররোচনা দিয়েছে। একজন পূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসী মানুষে পরিণত করেছে। বলতে পারো, আমি পড়তে পড়তে বদলাই আর লিখেতে লিখতে বিবর্তিত হই। এখানে একটা কথা থেকে যায়, মানুষের বিশ্বাস। ধর্ম মানুষকে একটা চিরন্তন আশ্রয়ের আশ্বাস দেয়। এ আশ্বাসের বলেই মানুষ পরকালে বিশ্বাস করে। মৃত্যু–পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করে। আমি মনে করি, এই পার্থিব জীবনই শেষ নয়, মৃত্যুর পরও আমার একটা জীবন শুরু হবে। তবে প্রকৃত সাম্যবাদে বিশ্বাসীদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। ব্যক্তিজীবনে আমি একসময় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলাম। পরে আমার বিশ্বাসের কাছে ফিরে এসেছি। 

আবিদ: একটি কথা প্রায়ই বলেন আপনি—‘কবিদের কাজ হলো স্বপ্ন সৃষ্টি করা’—বিষয়টি একটু বুঝিয়ে বলবেন? 

মাহমুদ: আমরা যদি স্বপ্ন সৃষ্টি করতে না পারি তবে হতাশা নেমে আসবে, বিপর্যয় চেপে বসবে। দেশের ওপর দিয়ে হয়তো একটা দুর্যোগের ঘনঘটা বয়ে যাচ্ছে। তবুও বলতে চাই, আমরা আর অশান্তি-সংঘাত, যুদ্ধ চাই না। কবির কাজ কী? তাঁরা সব সময় মানুষকে স্বপ্ন দেখাবেন, মানুষের মধ্যে আশা জাগাবেন। সারা জীবন মানুষকে আমি স্বপ্ন দেখিয়েছি, ভালোবাসার কথা বলেছি। ভুলের ঊর্ধ্বে না থাকলেও সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে চেয়েছি। 

কোনো কবিই উপদেশ গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন। আমরা সৃষ্টি চাই, সৃষ্টির আনন্দ চাই। কবিরা কখনো পরাজয় মানেন না। কবি হলেন সমাজের মূল স্রোতের লোক। তাঁরাই মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন। তাই বলে এ কথার মাধ্যমে গদ্যকে আমি অস্বীকার করছি না। আমার গদ্য-পদ্য দুটোই ছন্দোবদ্ধ। ছন্দ ছাড়া গদ্য কিংবা পদ্য হয় না। আমাদের সামনে আশা না থাকলে কোনোভাবেই আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারব না। এ ক্ষেত্রে কবিদের বলব, সময়কে ধারণ করবেন ঠিকই, তা হতে হবে অবশ্যই চোখ–কান খোলা রেখে। 

আবিদ: জীবনব্যাপী প্রেমে-অপ্রেমে জড়িয়ে থেকে এই বয়সে পৌঁছে বিশেষ কোনো অনুতাপ অনুভব করেন কি? 

মাহমুদ: করি। হয়তো কখনো আমি ভাবি, ওই কাজটা কেন করেছিলাম, তাকে কেন ব্যথা দিয়েছিলাম। কারও কাজ ও চেহারা মনের মণিকোঠায় ভেসে ওঠে, আর মনে হয়, আহ, আমি তাকে অযথাই কষ্ট দিয়েছিলাম। এখানে নারী-পুরুষ—উভয়ই থাকতে পারে, যাদের আমি একটা সময় ঠকিয়েছিলাম বলে মনে হচ্ছে। না, এখন কারও নাম বলতে চাই না। প্রেম ব্যাপারটাকে জানতে হলে মানব সম্পর্কে জানতে হয়। পুরুষকে নারী সম্পর্কে, নারীকে পুরুষ সম্পর্কে খুব ভালো করে অবহিত হতে হয়, জানতে হয়। এটা ঘটলেই তৈরি হয় সম্পর্ক, যেটা আমার হয়েছে। 

আবিদ: আপনার সাহিত্যে, বিশষ করে ফিকশনে ব্যক্তিচরিত্র হিসেবে আল মাহমুদ কতটা হাজির? 

মাহমুদ: আমার সাহিত্য আদতে আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পৃথক পৃথক নির্যাস। পড়ে দেখো, আমার লেখার সবখানেই আমি আছি। যেভাবে বেড়ে উঠি—তাতে আমি সব লিখেছি। আমার কাবিলের বোন পড়ে দেখো। এই উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে মুক্তিযুদ্ধ। বইটা তেমন পঠিত হয়নি। আমার বিশ্বাস, একটা সময় মানুষ সেটা পড়বে। অবশ্যই পড়বে।