আধুনিক ছোটগল্পের আদি রূপ

গুহামানবেরা দিনের শেষে আগুনের চারপাশে জড়ো হয়ে যেসব গল্প বলত, সেগুলো ছিল অবিশ্বাস্য, অবাস্তব কাহিনি—এক অর্থে আষাঢ়ে গল্প। ছবি: সংগৃহীত
গুহামানবেরা দিনের শেষে আগুনের চারপাশে জড়ো হয়ে যেসব গল্প বলত, সেগুলো ছিল অবিশ্বাস্য, অবাস্তব কাহিনি—এক অর্থে আষাঢ়ে গল্প। ছবি: সংগৃহীত

বর্ষা এলেই পত্রপত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকেরা গল্পলেখকদের অনুরোধ করেন, ‘একটা আষাঢ়ে গল্প দিন।’ আমি গল্প লিখি, কোনো কোনো আষাঢ় মাসে সাহিত্য সম্পাদকদের অনুরোধে আমাকেও আষাঢ়ে গল্প লিখতে হয়েছে। কিন্তু এবার আমাকে লিখতে বলা হলো আষাঢ়ে গল্প নিয়ে একটা প্রবন্ধ। আমার জন্য এ বড় কঠিন কাজ। কারণ, আমি এযাবৎ গল্প লেখার চেষ্টা করে এসেছি, গল্প নিয়ে প্রবন্ধ লেখার জন্য যে গভীর ও বিস্তৃত পড়াশোনা প্রয়োজন, তা আমার যথেষ্ট নেই। তবে এই সুবাদে আমার একটু উপকার হলো; আমি আমার গল্প পড়ার অভিজ্ঞতার দিকে ফিরে তাকানোর সুযোগ পেলাম, সেসব নিয়ে ভাবার অবকাশ হলো।

‘আষাঢ়ে গল্প’ বেশ প্রচলিত একটি বাংলা বাগধারা, এর মানে অবিশ্বাস্য কাহিনি। অবিশ্বাস্য তা-ই, যা বাস্তবে ঘটে না এবং ঘটতে পারে না বলে সাধারণভাবে মনে করা হয়। কিন্তু অবিশ্বাস্য কাহিনির সঙ্গে আষাঢ় মাস বা বর্ষাকালের সম্পর্ক কী? কেন ‘আষাঢ়ে গল্প’ বলতে অবিশ্বাস্য কাহিনি বোঝায়? বাংলা ভাষার অভিধানগুলোতে ‘আষাঢ়ে’ শব্দটার দুই ধরনের অর্থের কথা পাওয়া যায়। একটা অর্থ ‘আষাঢ় মাস সম্বন্ধীয়’, অন্যটা হলো অদ্ভুত, অলীক, মিথ্যা, অসম্ভব। আষাঢ়ে বজ্রবৃষ্টি কোনো অদ্ভুত, অলীক, মিথ্যা বা অসম্ভব ঘটনা নয়। কিন্তু আষাঢ়ে গল্প বলতে অসম্ভব কাহিনি ছাড়া আর কিছুই বোঝায় না। কেমন করে এটা হলো, তার সুনির্দিষ্ট খোঁজ আমি পাইনি।

‘বর্ষার দিন’ শিরোনামে প্রমথ চৌধুরীর একটা প্রবন্ধ আছে। সেখানে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘আষাঢ় সম্বন্ধে বাংলাদেশে আর-একটি কিংবদন্তী আছে, যা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে এবং চিরকাল লেগেছে।

 ‘কথায় বলে “আষাঢ়ে গল্প”, কিন্তু গল্পের সঙ্গে আষাঢ়ের কি নৈসর্গিক যোগাযোগ আছে তা আমি ভেবে পাই নে। আমার বিশ্বাস গল্পের অনুকূল ঋতু হচ্ছে শীত, বর্ষা নয়। কেননা গল্প লোকে রাত্তিরেই বলে। তাই পৃথিবীর অফুরন্ত গল্পরাশি একাধিক সহস্র রজনীতেই বলা হয়েছিল। শীতকাল যে গল্প বলার ও গল্প শোনার উপযুক্ত সময় তার কারণ শীতকালে রাত বড়ো, দিন ছোটো। অপরপক্ষে আষাঢ়ের দিন-রাতের হিসেব ঠিক উল্টো; একালের দিন বড়ো, রাত ছোটো। দিনের আলোতে গল্পের আলাদিনের প্রদীপ জ্বালানো যায় না।’ 

প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, ‘আষাঢ়ে গল্পে’র সঙ্গে আষাঢ় মাস বা বর্ষাকালের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর মতে, এখানে ‘আষাঢ়ে’ শব্দটা এসেছে ‘আজাড়ে’ থেকে। একই প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের বাঙাল দেশে লোকে “আষাঢ়ে গল্প” বলে না, বলে “আজাড়ে গল্প”। এখন এই “আজাড়ে” শব্দটি কি “আষাঢ়ে”র অপভ্রংশ? “আজাড়” শব্দের সাক্ষাৎ সংস্কৃতকোষের ভিতর পাওয়া যায় না। এর থেকে অনুমান করছি যে এটি হয় ফারসি, নয় আরবি শব্দ। আর ও-কথার মানে আমরা সবাই জানি, অন্য সূত্রে। আমরা যখন বলি “মাঠ উজাড়” করে দিলে, তখন আমরা বুঝি যে উজাড় মানে নির্মূল। সুতরাং “আজাড়ে গল্পে”র অর্থ যে অমূলক গল্প এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত নয়। এই “আজাড়” কথাটার শুদ্ধি করে নিয়ে আমরা “আষাঢ়” বানিয়েছি। এর কারণ, আরব্য-উপন্যাসের সব গল্পই “আজাড়ে গল্প”, হিন্দু জবানে “আষাঢ়ে গল্প”।’

তবে প্রমথ চৌধুরীর এই মত মেনে নেননি, এমন লোকের দেখাও আমি পেয়েছি। তাঁদের ধারণা, প্রাচীন কালে আষাঢ় মাসে একটানা কয়েক দিন ধরে বর্ষণ চলত; মাঠঘাট সব ডুবে গেলে লোকেদের ঘরে বসে গল্পগুজব করা ছাড়া আর কোনো কাজ থাকত না, ফলে তারা সেটাই করত এবং যারা গল্প বলত, তারা নিজের কল্পনাশক্তির লাগামছাড়া ব্যবহার করত, বানিয়ে তুলত অদ্ভুত, অলীক, অবিশ্বাস্য নানা কাহিনি।

আষাঢ়ের বর্ষণমুখর লম্বা দিনগুলোতে হোক আর মাঘের হাড়কাঁপানো শীতের দীর্ঘ রাতগুলোতেই হোক, মানুষ যেসব গল্প বানাত, বলত ও শুনত, সেসব গল্পের অধিকাংশই ছিল অদ্ভুত, অলীক, অবিশ্বাস্য। এর প্রমাণ সাহিত্যের ইতিহাসে যেমন আছে, তেমনি আছে নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসেও। আদিম গুহামানবেরা দিনের শেষে আগুনের চারপাশে জড়ো হয়ে যেসব গল্প বলত, সেগুলো ছিল অবিশ্বাস্য কাহিনি। সেসব গল্পের মূল আকর্ষণ ছিল সাসপেন্স বা কৌতূহলের উত্তেজনা। দৃষ্টান্ত হিসেবে, তারা হয়তো দুর্ধর্ষ শিকার-অভিযানের উত্তেজনাপূর্ণ কাহিনি বলত, তবে সেসব কাহিনিতে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার হুবহু বিবরণের চেয়ে বেশি থাকত কল্পনার অতিরঞ্জন। যাদের উদ্দেশে গল্প বলা হতো, তারা যেন ঘুমিয়ে না পড়ে, সেটাই ছিল গল্পকথকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ বাস্তব অভিজ্ঞতার সাদামাটা বিবরণ দিয়ে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। প্রয়োজন হতো অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনা: ত্রাসের চমক, হিংস্র পশুর বিরুদ্ধে প্রাণান্ত লড়াইয়ে বীরত্বের রোমাঞ্চ, প্রকৃতির নানা প্রপঞ্চের অব্যাখ্যাত রহস্য ইত্যাদি। পরবর্তীকালের নানা পর্যায়ে রূপকথা, পুরাণ, কিংবদন্তি, মহাকাব্য ইত্যাদি অবিশ্বাস্য কাহিনি সৃষ্টির পেছনেও গল্পের আদি শ্রোতার ওই সব মৌলিক প্রবৃত্তির অবদানই প্রধান।

আষাঢ়ে গল্পেও মানুষ কিছু মাত্রায় বাস্তবের অনুকরণ করে বটে, কিন্তু সেটা তার গল্প বলার উদ্দেশ্য নয়; তার উদ্দেশ্য বাস্তবের সীমা অতিক্রম করে যাওয়া। আটপৌরে বাস্তবের একঘেয়েমি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মানুষের অত্যন্ত প্রবল; দেখার ও শোনার জগতের সীমানা ছাড়িয়ে কল্পনার ঘোড়া ছুটিয়েই তার আনন্দ, যে আনন্দ সব শিল্পের মূল অভীষ্ট।

আমরা কথাসাহিত্যের একটা ছোট্ট শাখা বা শ্রেণি হিসেবে যেটাকে আষাঢ়ে গল্প বলছি, খতিয়ে দেখলে সেটাকে আধুনিক ছোটগল্পের (short story) গোড়ার জিনিস বলে শনাক্ত করা যায়। অনেকে মনে করেন, আধুনিক ছোটগল্পের শুরু উনিশ শতকের আমেরিকায়। আমেরিকান ছোটগল্পের তিন পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত ওয়াশিংটন আরভিং (১৭৮৩-১৮৫৯), ন্যাথানিয়েল হথর্ন (১৮০৪-৬৪) ও এডগার অ্যালান পো (১৮০৯-৪৯)–এর লেখা যেসব গল্প দিয়ে আধুনিক ছোটগল্পের যাত্রা শুরু বলে কেউ কেউ মনে করেন, সেগুলো ছিল অবাস্তব, উদ্ভট, রহস্যময় নানা কাহিনিতে ভরা। ওয়াশিংটন আরভিংয়ের লেখা ‘রিপ ভ্যান ইউংকল’ গল্পটির কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। আমার বিচারে এটি একটি বিশুদ্ধ ‘আষাঢ়ে গল্প’।

যদিও সাহিত্যের শ্রেণিকরণের সূক্ষ্ম বাছবিচারে এডগার অ্যালান পোকে ‘আষাঢ়ে গল্পে’র লেখক বলতে অনেকেরই বাধবে, তবু আমার বিচারে তিনি আষাঢ়ে গল্পের রাজা। তাঁর টেলস অব মিস্ট্রি অ্যান্ড ইমাজিনেশন নামের বইয়ে সংকলিত গল্পগুলো পড়লেই এই দাবির যথার্থতা মিলবে।

অ্যালান পোর জন্ম যে বছর, সেই একই বছরে ইউক্রেনে জন্মেছিলেন আধুনিক রুশ কথাসাহিত্যের জনক হিসেবে স্বীকৃত নিকোলাই গোগল (১৮০৯-৫২)। তাঁর লেখা বিশ্বখ্যাত ছোটগল্প ‘শিনেল’ (ওভারকোট/গ্রেটকোট), যার পকেট থেকে সব কথাসাহিত্যিক বেরিয়ে এসেছেন বলে মন্তব্য করেছিলেন দস্তইয়েফস্কি (উক্তিটা আসলে কার, সে বিষয়ে বিতর্ক আছে), সেটাও একটা ‘আষাঢ়ে গল্প’ই বটে। কাছাকাছি সময়ে ইংল্যান্ডে লুইস ক্যারল (১৮৩২-৯৮) গল্প তেমন লেখেননি, তবে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস অ্যালিসেস অ্যাডভেঞ্চার্স ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডও এক অসম্ভব কল্পকাহিনি। এসবেরও অনেক আগে জার্মানিতে আর্নস্ট থিওডর ভিলহেলম হফমান (১৭৬৬-১৮২২) লিখেছেন বিস্ময়কর কিছু কল্পকাহিনি (তাঁর প্রভাব পড়েছিল গোগল ও দস্তইয়েফস্কির ওপর)। ১৮১৪ সালে প্রকাশিত হফমানের বড় গল্প ‘দ্য গোল্ডেন পট: আ মডার্ন ফেয়ারি টেল’ জার্মান রোমান্টিক কথাসাহিত্যের অন্যতম সেরা নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত; আসলে এটাও আগাপাছতলা এক আষাঢ়ে গল্প।

অবিশ্বাস্য কল্পকাহিনি বা আষাঢ়ে গল্পের খোঁজে বাংলা সাহিত্যের দিকে তাকালে প্রথমেই মনে আসে ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৪৭-১৯১৯) কথা। তাঁর ‘লুল্লু’ ও ‘ডমরুচরিত’ অবিস্মরণীয় উদ্ভট রসের গল্প। তিনি যখন এসব গল্প লিখছিলেন, সে সময় তাঁর সমসাময়িক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে বাংলা উপন্যাসের গোড়াপত্তন ঘটছিল। বঙ্কিম প্রথমে ঐতিহাসিক রোমান্স ও পরের দিকে সামাজিক বাস্তবতাভিত্তিক উপন্যাস লিখে বাঙালি পাঠকসমাজে সমাদৃত হয়েছিলেন। কিন্তু ত্রৈলোক্যনাথ সে পথে পা বাড়াননি; তিনি ভূতপ্রেত, কাল্পনিক জীবজন্তু ও মানুষকে নিয়ে বাস্তব-অবাস্তবের মিশ্রণে এক-একটা অদ্ভুত কল্পজগৎ নির্মাণ করেছেন, যা শুধু উদ্ভট-অসম্ভব ঘটনায় ঠাসা নয়, সুতীব্র শ্লেষ আর ব্যঙ্গবিদ্রূপেও ভরা। এদিক থেকে এডগার অ্যালান পো ও নিকোলাই গোগলের সঙ্গে ত্রৈলোক্যনাথের পার্থক্য বিরাট। বাংলা আষাঢ়ে গল্পের এই বিশেষ মেজাজ ও ভঙ্গি ত্রৈলোক্যনাথেরই অবদান। অনেক সাহিত্যসমালোচক তাঁকে নিছক উদ্ভট হাস্যরসের গল্পলেখক হিসেবে মানতে নারাজ; তাঁরা তাঁকে তাঁর সময়ের সমাজবাস্তবতার নেতিবাচক দিকগুলোর কঠোর সমালোচক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তিনি তাঁর গল্পগুলোর বিভিন্ন চরিত্রের মুখ দিয়ে হিন্দুধর্মের জাতপ্রথা, সতীদাহ, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে তীব্র শ্লেষ-ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে ভরা কথাবার্তা বলিয়েছেন। যেমন তাঁর গল্পে যম চিত্রগুপ্তকে বলে, ‘পৃথিবীতে গিয়া মানুষ কি কাজ করিয়াছে, কি কাজ না করিয়াছে, তাহার আমি বিচার করি না। মানুষ কি খাইয়াছে, কি না খাইয়াছে, তাহার আমি বিচার করি। ব্রহ্মহত্যা, গো-হত্যা, স্ত্রীহত্যা করিলে এখন মানুষের পাপ হয় না, অশাস্ত্রীয় খাদ্য খাইলে মানুষের পাপ হয়।’

বাংলা ভাষায় অতিবাস্তব বা উদ্ভট গল্প অনেকেই লিখেছেন, তবে তাঁদের অধিকাংশই লিখেছেন প্রধানত বাস্তবধর্মী গল্প-উপন্যাস। রাজশেখর বসু (পরশুরাম), শিবরাম চক্রবর্তী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়সহ আরও অনেকের নাম এই তালিকায় আসবে। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ‘একটা আষাঢ়ে গল্প’ আছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও বাদ পড়েন না। কিন্তু ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ই সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম, যাঁর সমগ্র সাহিত্যভান্ডার উদ্ভট কল্পকাহিনিতে ভরা।

এডগার অ্যালান পো, নিকোলাই গোগল ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়: অবাস্তব আষাঢ়ে গল্প লিখেছেন তিন লেখকই
এডগার অ্যালান পো, নিকোলাই গোগল ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়: অবাস্তব আষাঢ়ে গল্প লিখেছেন তিন লেখকই

বাংলাদেশে আমার জানামতে পরিকল্পিতভাবে কিছু আষাঢ়ে গল্প লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। উদ্ভট গল্প নামে তাঁর একটা গল্পসংকলন আছে; এ বইয়ের সব গল্পই বিশুদ্ধ আষাঢ়ে গল্প। তাঁর এসব গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য রহস্য; এগুলোতে এমন নানা ঘটনা ঘটে, যেগুলোর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যাখ্যাতীত ঘটনা সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের অনেক গল্পেও পাওয়া যায়। আনিসুল হক অবিশ্বাস্য গল্প লেখায় ওস্তাদ। এমনকি হাসান আজিজুল হকের দু-একটি গল্পেও অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্যের দেখা মেলে।

এভাবে দেখতে গেলে আধুনিক কথাসাহিত্যের প্রবল দুটি ধারা পরাবাস্তববাদ (সুররিয়ালিজম) ও জাদুবাস্তববাদ (ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম) আষাঢ়ে গল্পের মধ্যে পড়ে যায় এবং ফ্রানৎস কাফকা ও গাব্রিয়েল গার্সিয়াকে বলতে হয় আষাঢ়ে গল্পের দুই সেরা দিকপাল। কারণ, কাফকার মেটামরফোসিস-এর মতো উদ্ভট অবাস্তব গল্প আর হয় না; আর মার্কেসের উদ্ভট গল্পগুলো এবং এক শ বছরের নিঃসঙ্গতা উপন্যাসের অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলোর জাদুময়তার কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু অ্যালান পো, গোগল কিংবা ত্রৈলোক্যনাথের সঙ্গে এঁদের পার্থক্য বিরাট। মিখাইল বুলগাকভ, গুন্টার গ্রাস, সালমান রুশদি, লাতিন আমেরিকার ডজনখানেক গল্পকার-ঔপন্যাসিকসহ অজস্র আধুনিক-সমকালীন কথাশিল্পীর নাম বলা যায়, যাঁদের শৈলী হয় পরাবাস্তববাদ নয় জাদুবাস্তববাদ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। কিংবা টেকনিক, স্টাইল বা শৈলীর নির্দিষ্ট নামকরণ না করেও বলা যায়, আধুনিক ছোটগল্পের আদি রূপ সেই আষাঢ়ে গল্প, যার কথা এ লেখার শুরুতে বলেছি। সব শিল্পের ইতিহাস আসলে তার রূপের, ঢঙের, শৈলীর বিবর্তনের ইতিহাস। এটা শিল্পীর নতুন নতুন শৈলী সন্ধানের স্বাভাবিক ঝোঁকের অনিবার্য ধারা।

অবশ্য আদি আষাঢ়ে গল্পের সঙ্গে আধুনিক যুগের বিভিন্ন শৈলীর গল্পের পার্থক্য শুধুই গল্পকথনের শৈলীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। আদিতে গল্পের আধেয়তে প্রবল ছিল সাসপেন্স, আর আধুনিক যুগে প্রবল হয়ে উঠেছে ব্যক্তির উদ্বেগ, বিচ্ছিন্নতাবোধ, আক্ষেপ, শ্লেষ, অস্তিত্ববাদী সংকট ইত্যাদি।