প্যারিসের প্যালেই ডি টোকিওতে শুরু হয়েছে 'সিটি প্রিন্স/প্রিন্সেস'

‘সিটি প্রিন্স/প্রিন্সেস’ প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের সিনেমার ব্যানার শিল্পী মোহাম্মদ শোয়েবের আঁকা চিত্রকর্ম। ছবি: প্যালেই ডি টোকিও
‘সিটি প্রিন্স/প্রিন্সেস’ প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের সিনেমার ব্যানার শিল্পী মোহাম্মদ শোয়েবের আঁকা চিত্রকর্ম। ছবি: প্যালেই ডি টোকিও

পরস্পরের বৈশিষ্ট্যগত অমিল থাকা সত্ত্বেও সে শহরগুলো কাল্পনিক, বহুমুখী এবং জটিল। সেগুলো একই সঙ্গে সীমান্তহীন, অগোছালো, অস্থিতিশীল ও সৃজনশীল। সেই শহরগুলো অবিশ্বাস্য গবেষণাগার, যা সব সময়ই পরিবর্তশীল এবং প্রতি মুহূর্তে যেগুলো বিনির্মিত হচ্ছে। এ রকম পাঁচটি শহরের গল্প নিয়ে প্যারিসের বিখ্যাত গ্যালারি প্যালেই ডি টোকিওতে শুরু হয়েছে ‘সিটি প্রিন্স/প্রিন্সেস—ঢাকা, লাগোস, ম্যানিলা, মেক্সিকো সিটি এবং তেহরান’ শিরোনামের একটি শিল্প প্রদর্শনী। জুন মাসের ২১ তারিখে শুরু হওয়া এ প্রদর্শনীটি চলবে আগস্ট মাসের আট তারিখ পর্যন্ত।

এ প্রদর্শনীতে ঢাকা, লাগোস, ম্যানিলা, মেক্সিকো সিটি এবং তেহরানের শিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। এই মাল্টিডিসিপ্লিনারি প্রদর্শনীতে চিত্রশিল্পী ছাড়াও অংশ নিয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা, ফ্যাশন ডিজাইনার, আবিষ্কারক, ট্যাটুশিল্পী, সংগীতশিল্পীসহ প্রায় পঞ্চাশ জন মানুষ। এই শিল্পীদের প্রত্যেকের নতুন নতুন শিল্পকর্ম ও প্রকল্প এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে। এই প্রদর্শনীতে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে বাংলাদেশের বিলুপ্তপ্রায় সিনেমার ব্যানার শিল্পকে। এ মাধ্যমের প্রবীণ শিল্পী মোহাম্মদ শোয়েব এঁকেছেন ছবিটি।

ঢাকা থেকে প্রদর্শনীটিতে অংশ নিয়েছেন সিনেমার ব্যানার শিল্পী মোহাম্মদ শোয়েব, শিশির ভট্টাচার্য, বৃত্ত আর্টস ট্রাস্ট, আশফিকা রহমান, মাহবুবুর রহমান এবং রীতু সাত্তার। প্রদর্শনীটির কিউরেটর হুগো ভিটরানি, সহযোগী কিউরেটর ফেবিয়ান ডেনেজি, সিনোগ্রাফার অলিভিয়ার গেইথলস।

‘এই প্রদর্শনীর জন্য ঢাকাকে বেছে নেওয়ার কারণ কী?’ প্রথম আলোর এমন একটি প্রশ্নের উত্তরে প্রদর্শনীটির সহযোগী কিউরেটর ফেবিয়ান ডেনেজি জানান, “আমরা আসলে দেখতে চেয়েছি ‘ঢাকা আর্ট সামিট’ ছাড়া ঢাকায় আর কী কী ঘটে। এ শহর সুকৌশলে যা বলছে তার শক্তিটা কোথায়? ঢাকাকে বেছে নেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে এটি তুলে ধরা যে, ইউরোপ এবং ইউরোপের বাইরের শিল্পের মধ্যে তেমন কোনো বিরোধিতা নেই।”

‘সিটি প্রিন্স/প্রিন্সেস’ প্রদর্শনীটির সহযোগী কিউরেটর ফেবিয়ান ডেনেজির সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ই-মেইলে যোগাযোগ করে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।

‘সিটি প্রিন্স/প্রিন্সেস’ প্রদর্শনীর একাংশ। ছবি: প্যালেই ডি টোকিও
‘সিটি প্রিন্স/প্রিন্সেস’ প্রদর্শনীর একাংশ। ছবি: প্যালেই ডি টোকিও

প্রথম আলো: প্রদর্শনীটির মূল উদ্দেশ্য কী?
ফেবিয়ান ডেনেজি: ‘সিটি প্রিন্স/প্রিন্সেস’ আসলে শিল্প সম্পর্কে প্যালেই ডি টোকিওর ভিশনকে প্রসারিত করতে চায় এবং প্যারিস বা ইউরোপে সুপরিচিত নয়, এমন শিল্পীদের এই অঞ্চলে পরিচিত করাতে চায়। এর মূল লক্ষ্য ছিল বয়স ও মাধ্যম নির্বিশেষে নতুন শিল্পীদের আবিষ্কার করা এবং তাদেরকে তাদের ঐক্যের জায়গাটি দেখিয়ে দেওয়া।

প্রথম আলো: এই প্রদর্শনীর জন্য ঢাকাকে বেছে নেওয়ার কারণ কী?
ফেবিয়ান ডেনেজি: ২০১২ সাল থেকে প্রতি দুই বছর পরপর অনুষ্ঠিত হওয়া ঢাকা আর্ট সামিট দক্ষিণ এশিয়ার শিল্পকে উপস্থাপন করে চলেছে। এই আর্ট সামিট বৈশ্বিক শিল্পের জগতে বাঙালি শিল্পীদের পরিচিত করার সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়েছে। আমরা আসলে দেখতে চেয়েছি ‘ঢাকা আর্ট সামিট’ ছাড়া ঢাকায় আর কী কী ঘটে। এ শহর সুকৌশলে যা বলছে তার শক্তিটা কোথায়? ঢাকাকে বেছে নেওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে এটি তুলে ধরা যে, ইউরোপ এবং ইউরোপের বাইরের শিল্পের মধ্যে তেমন কোনো বিরোধিতা নেই।
২০০৩ সালে বৃত্ত আর্ট ট্রাস্ট ফার্নান্দো পালমা রদ্রিগেজকে সেদেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। গত বছর নিউইয়র্কে MOMA PS 1-এ তার প্রদর্শনী ছিল এবং তিনি নিজেও সিটি প্রিন্স/ প্রিন্সেসের একজন শিল্পী। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, শিল্পীদের কাজের জায়গার ধারণাই আমাদের কাছে প্রথম বিবেচিত হয়েছে।

প্রথম আলো: ঠিক কেন এবং কোন পরিপ্রেক্ষিত থেকে সিনেমার ব্যানার পেইন্টিংকে আপনারা ঢাকা আর্ট স্টাইলের প্রতিনিধিত্বশীল মনে করছেন?
ফেবিয়ান ডেনেজি: প্রথমত আমরা এটা স্পষ্ট করতে চাই যে, ঢাকাই শিল্পের ধরনকে আমরা শুধু একটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করছি না। আপনি যদি শিল্প বিষয়টি বুঝতে শুরু করেন তাহলে দেখবেন, শিল্পীরা কীভাবে শিল্প সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিল্পভাষা নির্মাণ করছে। এ জন্যই যেসব শিল্পীকে আমরা বেছে নিয়েছি, তারা আসলে ঢাকার প্রতিনিধিত্ব করছেন না। সিটি প্রিন্স/প্রিন্সেস কোনো শিল্পীকে ভৌগোলিক দিক দিয়ে বিচার করে না বা আঞ্চলিকতার পরিচয়ে তাদের একত্রিতও করে না। এডওয়ার্ড গ্লিসেন্টের অভিজ্ঞতায় আমরা একটি কল্পিত জগৎ তৈরি করেছি, যেখানে প্রত্যেক শিল্পী তার জাতীয়তার পরিচয়ের বাইরে এসে কথা বলতে পারেন। সিনেমার ব্যানারকে আমরা শুধু এর নিজস্ব স্টাইলের জন্যই বেছে নিয়েছি। এর অবয়ব ও রংগুলো ভীষণ শক্তিশালী। এবং আমরা এই পাঁচটি শহরকে এক করে এই প্রদর্শনীতে একটি সিনেমা থিয়েটারও বানাতে চেয়েছি।

প্রথম আলো: আপনারা কি মনে করেন বিশ্বের শিল্প ইতিহাসে সিনেমা ব্যানার পেইন্টিংয়ের গুরুত্ব আছে?
ফেবিয়ান ডেনেজি: অবশ্যই সেটি আছে। বেশ আগে থেকেই আর্টের জগতে উচ্চমার্গীয় বা নিম্নবর্গীয় শিল্প বলে আর কিছু নেই। সুতরাং ট্যাটু, গ্রাফিতি বা কমিকের মতোই সিনেমা ব্যানার পেইন্টিংও বিশ্ব শিল্প ইতিহাসেরই অংশ।

প্রথম আলো: যে বড় পরিসরের সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং এ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছে তাতে যথাশিল্প এবং শিল্পী মোহাম্মদ শোয়েবের ভূমিকা কী?
ফেবিয়ান ডেনেজি: আমরা শাওন আকন্দ ও যথাশিল্পের হাত ধরে মোহাম্মদ শোয়েবের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। এরা এই গুরুত্বপূর্ণ আর্ট ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য চমৎকার কাজ করে চলেছেন। আমরা এই প্রদর্শনীটির জন্য একটি বড় পোস্টার ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম—মোহাম্মদ শোয়েব ও তার সহকারীরা সেটি তৈরি করার প্রস্তাবে সম্মত হয়েছিলেন। প্রদর্শনীর শেষে এই পোস্টারটি এটা বোঝাতে পারবে যে, সিটি প্রিন্স/প্রিন্সেসের পথচলা আসলে একটি সিনেমার মতো। এই প্রদর্শনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেককেই আপনারা পোস্টারটিতে খুঁজে পাবেন।

প্রথম আলো: মোহাম্মদ শোয়েব ও যথাশিল্পের এই বড় পরিসরের কাজটিসহ এই প্রদর্শনী থেকে আপনাদের প্রত্যাশা কী?
ফেবিয়ান ডেনেজি: আমরা আশা করি, এই প্রদর্শনী থেকে দর্শক মোহাম্মদ শোয়েবের কাজকে চিনতে পারবে এবং তার কাজের গুরুত্ব বুঝতে পারবে। আন্তর্জাতিক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা তার কাজকে সবার সামনে তুলে ধরব এবং আমরা চাইব যে ভবিষ্যতে জাদুঘরগুলোতে তাঁর প্রদর্শনী ঠাঁই পাক।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে কিছু বলুন।
ফেবিয়ান ডেনেজি: ঢাকা থেকে আরও অংশ নিচ্ছেন বৃত্ত আর্টস ট্রাস্ট, শিশির ভট্টাচার্য, আশফিকা রহমান, মাহবুবুর রহমান এবং রীতু সাত্তার। ঢাকার বৃত্ত আর্টস ট্রাস্ট শিল্পীদের পরিচালিত সবচেয়ে পুরোনো সংস্থা। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি সিটি প্রিন্স/প্রিন্সেসের জন্য রিকশা পেইন্টিংয়ের সংরক্ষণের ওপর শিল্পী ও কারিগরদের নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিল। শিশির ভট্টাচার্য এই বৃত্তেরই একজন— তিনি প্যালেই ডি টোকিওতে কালো রেখার অনেকগুলো ফিগার দিয়ে একটি ম্যুরাল তৈরি করেছিলেন, যা ছিল এখানকার সবচেয়ে বড় কাজ। ফিগারগুলো পরপর মিলেমিশে পর্যায়ক্রমে শিশুসুলভ, খ্যাপাটে, হিংস্র ও স্বপ্নময় ভাবের একটি পুরো সেটের সৃষ্টি করত। আশফিকা রহমানের কাজের নাম ‘দ্য লাস্ট অডিয়েন্স’। এতে তিনি পুরান ঢাকার একটি সিনেমা হলের ভেতরের আবছায়া জগৎ দেখাচ্ছেন। অন্যদিকে মাহবুবুর রহমানের ‘টাইম ইন লিম্বো’ ঢাকা শহরের রাস্তায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে একটি ত্রিমাত্রিক প্রামাণ্যচিত্র। আশফিকা রহমানের ‘দ্য লস্ট টিউন’ নামের আরও একটি কাজ আছে এখানে। এটি মূলত হারমোনিয়াম বাদকদের একটি সংগীতায়োজন, যেখানে বিষাদের সুরের আবহ তৈরি হয়। যা একই সঙ্গে ধ্যানমগ্ন ও শুনতে না পারার মতো তীক্ষ্ণ বেদনার সৃষ্টি করে। এই আয়োজনটি আসলে বর্তমানের বাংলাদেশকেই পরোক্ষভাবে প্রশ্ন করছে। এই প্রত্যেকটা কাজ বাংলাদেশি সমাজের চিত্র তুলে ধরছে এবং একই সঙ্গে এগুলো প্রত্যেকটি শিল্পীদের একক সত্তার পরিচয়ও বহন করছে।