এইসব দিনকাল

ছবি:  নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

বাঘ ও ছাগলের ওই গল্পটা আপনারা নিশ্চয়ই জানেন।

এক ছাগল তৃষ্ণার্ত হয়ে নদীর দিকে গেছে। বাঘ তা দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেল। তার মূল পরিকল্পনা ছাগলটাকে খেয়ে ফেলা। এটা সে সরাসরি করতে পারছে না। চক্ষুলজ্জায় পড়েছে। কাজেই সে বলল, ‘এই বেটা, তুই পানি নোংরা করছিস কেন?’ ছাগল ভয়ার্ত গলায় বলল, ‘জনাব, আমি তো পানি নোংরা করছি না। পানি খাচ্ছি।’ বাঘ হুংকার দিয়ে উঠল, ‘আবার মুখে মুখে কথা। হারামজাদা বেয়াদব!’ এই বলেই বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ল ছাগলের ওপর।

গল্পটি বললাম, কারণ, আমরা এখন ক্রমাগত ছাগলের ওপর ঝাঁপ দিচ্ছি এবং ঝাঁপ দেওয়ার আগে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছি। কারণ, আমরা যুক্তিবাদী প্রাণী। যুক্তি ছাড়া কিছুই করি না।

স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় শিক্ষকদের এক অংশ নকল সাপ্লাইয়ে নেমে পড়েছেন। অঙ্ক কষে দিচ্ছেন, বইয়ের কোন অংশ লিখতে হবে দেখিয়ে দিচ্ছেন, এক ছাত্রের কাছ থেকে নকল এনে অন্য ছাত্রকে দিচ্ছেন। এই সব কাজ করছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। তাঁদেরও যুক্তি আছে। তাঁরা বলছেন, শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের সাহায্য করা তাঁদের কর্তব্য। তাঁরা কর্তব্য পালন করছেন। একজন তো আমাকে খুব জোরের সঙ্গে বললেন, ‘এরা গ্রামের স্কুলের ছেলেপুলে, শহরের ছাত্রদের সঙ্গে কম্পিটিশনে পারবে না। একটু–আধটু সাহায্য তো করতেই হবে।’ আমি বললাম, ‘এই যে অন্যায়টা করছেন, আপনার খারাপ লাগছে না?’

: অন্যায়? এটাকে অন্যায় বলছেন কেন? তা ছাড়া সবাই তো অন্যায় করছে। করছে না?
যুক্তিটা হচ্ছে সবাই যখন অন্যায় করছে, তিনিও করতে পারেন। ন্যায়–অন্যায়ের সীমারেখা তাঁর কাছে অস্পষ্ট হয়ে আসছে। যতীন বাবু নামে একজন অঙ্ক শিক্ষকের সঙ্গে ছোটবেলায় আমার পরিচয় ছিল। তিনি আমার ছোট ভাইকে অঙ্ক শেখাতেন। বিপ্লবী না হয়েও তিনি বাঘা যতীন নামে প্রসিদ্ধি লাভ করলেন কঠিন শিক্ষক হিসেবে। পরীক্ষার হলে তিনি উপস্থিত থাকলে কারও সাধ্য নেই এদিক–ওদিক তাকায়, নকল তো অনেক দূরের কথা। এই তিনিই কিন্তু ছাত্রীদের ব্যাপারে কিচ্ছু বলতেন না। মেয়েরা কোলের ওপর বই রেখে টুকলিফাইং করতে থাকলেও তিনি নির্বিকার। তাঁর যুক্তি হচ্ছে, পরীক্ষার জন্য মেয়েগুলোর বিয়ে আটকে থাকে। যেভাবে পারে, পাস করে বেরিয়ে যাক।

হ‌ুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
হ‌ুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম

তাঁর হৃদয়ের মহত্ত্ব নিয়েও কারও মনে কোনো সন্দেহ ছিল না।
যতীন বাবু মেয়েদের প্রতি মমতা দেখিয়ে তাদের পাস করে যাওয়ার সুযোগ দিচ্ছেন। আমরা তাঁর প্রশংসা করছি। এই যতীন বাবুই যদি তাঁর মমতার ক্ষেত্রটি আরও প্রসারিত করতেন এবং ছেলেমেয়ে সবাইকে পাস করবার সুযোগ দিতেন, তাহলে আমরা কি তাঁকে অন্য সব নকল সরবরাহকারীদের সঙ্গে এক করে দিতাম না? যতীন বাবুর মমতা কি অন্যায় করার একটি যুক্তি নয়? আসলে আমরা বোধ হয় ন্যায়–অন্যায় আলাদা করতে পারছি না। সবই জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এই কঠিন জট খোলার চেষ্টাও হচ্ছে না। ব্রিটিশ আমলে পুলিশদের ঘুষ খাওয়ার ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গেল যে পরবর্তী সময়ে পুলিশদের ব্যাপারে ঘুষ নেওয়াটাকে আমরা স্বাভাবিক ধরে নিলাম। অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে শিক্ষকদের নকল সরবরাহের ব্যাপারটাও স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমরা বলব যে একজন টিচার, সে নকল সাপ্লাই করবে না তো কে করবে?
কদিন আগে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে যাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে নরওয়ের এক ভদ্রলোক। হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছি। নরওয়ের এই ভদ্রলোক চারপাশের সবুজের খেলা দেখে মুগ্ধ ও বিস্মিত। তাঁর জন্য এর চেয়ে বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। ভালুকায় একটি স্কুলের কাছে তিনি বিশাল এক জনতা দেখলেন। ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে এই জনতা স্কুল আক্রমণ করছে। একদল পুলিশ ও আনসার সেই আক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করছে। ভদ্রলোক আঁতকে উঠে বললেন, ‘কী হচ্ছে?’

আমি উদাস গলায় বললাম, ‘তেমন কিছু হচ্ছে না। স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা হচ্ছে।’
: পুলিশের সঙ্গে কারা মারামারি করছে?
: ছাত্রদের অভিভাবকেরা।
: কেন?
: ওরাও পরীক্ষার হলে ঢুকতে চায়।
: কেন?
আমি জবাব দিলাম না। ঘুমিয়ে পড়েছি এ রকম একটা ভান করলাম। এর কী জবাব দেব? পরীক্ষা মানেই তো ১৪৪ ধারা, পুলিশ, আনসার, বিডিআর (এখন বিজিবি), লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস, ফাঁকা গুলি এবং শেষটায় সত্যিকারের গুলি।

অদূর ভবিষ্যতে কী হবে? পরীক্ষার হলের চারপাশে বাংকার তৈরি হবে, সৈনিকেরা এলএমজি নিয়ে চারপাশে বসবেন। কিছুক্ষণ পরপর দূরবর্তী স্থানগুলোতে মর্টার গোলাবর্ষণ করা হবে।
অবস্থাটা এ রকম হলো কেন? যাকেই প্রশ্ন করি, তিনিই ঠোঁট উল্টে বলেন, ‘আর্থ-সামাজিক কারণে।’ এটা বর্তমানে একটা খুব চালু বাক্য। সবাই বলছেন।
আমি ওই দিকে যেতে চাই না। মূল কারণ হিসেবে আমি অভিভাবকদের চিহ্নিত করতে চাই। অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের মধ্যে ন্যায়–অন্যায় বোধ তৈরি করতে পারেননি বা তৈরি করতে চেষ্টা করেননি। তাঁরা চান, যেকোনো ভাবেই হোক তাঁদের ছেলেপুলেদের রেজাল্টটা যেন ভালো হয়। আমি অনেককেই দেখেছি, পরীক্ষার আগে তাঁরা তাঁদের ছেলেমেয়েদের গ্রামের স্কুল–কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন, যেখানে সুযোগ–সুবিধা বেশি।
একজন সমাজকর্মী মহিলার কথা বলি। এই মহিলা রুচিবান, সংস্কৃতিমান। তাঁর লাইব্রেরিতে রবীন্দ্র রচনাবলির সেট এবং এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা আছে। ভদ্রমহিলার মেয়েটি আট নম্বরের একটি অঙ্ক ভুল করে এসেছে। ভদ্রমহিলা রেগে আগুন। থমথমে গলায় বললেন, তোর পাশে যে বসেছে সুমি, সে এই অঙ্কটা করেছে?

: হ্যাঁ মা, করেছে।
: তুই চট করে ওর কাছে অঙ্কটা দেখে নিতে পারলি না? ইশ, আটটা নম্বর চলে গেল। তুই এত গাধা কেন?
সমস্যাটা এইখানে। সৎ, সরল ছেলেমেয়েগুলোকে আমরা বলছি গাধা। ওদের সামনে আমরা কোনো আদর্শ তুলে ধরতে পারছি না। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর বসার ঘরে এককালে মহাপুরুষদের ছবি বাঁধানো থাকত। বাবা-মায়েরা একটা আদর্শ ছেলেমেয়েদের সামনে তুলে ধরতে চাইতেন। আজকাল আমি কোনো বাসার দেয়ালে মহাপুরুষদের ছবি দেখি না। এটা নাকি অনাধুনিক।
এই যুগের বাবা-মায়েরা কি ছেলেমেয়েদের অনেক বেশি ভালোবাসেন? তাদের মঙ্গলচিন্তায় তাঁরা এতই মশগুল থাকেন যে ন্যায়–অন্যায় বোধ লোপ পায়। আমার খালাতো বোন মিশা এবার ম্যাট্রিক দিচ্ছে। খালা সেই উপলক্ষে নফল রোজা করছেন। পরীক্ষা চলাকালীন পনেরোজনের একটা বিশাল দল পরীক্ষা কেন্দ্রে বসে আছে। কারও হাতে ডাব, কারও হাতে ফ্যানটার বোতল, কমলা। খালু সাহেব অনেক ঝামেলা করে একজন ইনভিজিলেটর ‘ম্যানেজ’ করেছেন, যে অঙ্কগুলো হয়েছে কি না দেখে দেবে। প্রয়োজনে অন্য সাহায্যও করবে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমার খালু একজন সৎ, ধার্মিক মানুষ।
ভূত চলে গেছে সরিষায়। ওই ভূত তাড়ানোর মন্ত্র একক কোনো ব্যক্তি কিংবা দুই নেত্রী কিংবা পনেরো দল, বাইশ দলের হাতে নেই। ওই মন্ত্র আমাদের সবার কাছে। ওই মন্ত্র আমাদের সবার পাঠ করতে হবে।

সংগ্রহ ও ভূমিকা: হাসান হাফিজ
এইসব দিনরাত্রি নামে হ‌ুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত টেলিভিশন ধারাবাহিকের কথা অনেকের স্মৃতিতে আজও ভাস্বর। বিটিভিতে দীর্ঘ সময় ধরে প্রচারিত হয়েছিল অসম্ভব জনপ্রিয় এই সিরিজ নাটক। গত শতকের আশির দশকের শেষ দিকের কথা। তখন সাপ্তাহিক ঢাকা পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লিখতেন হ‌ুমায়ূন আহমেদ। তিনি সে সময় দিনে দিনে জনপ্রিয় হচ্ছেন। তো তাঁর সেই কলামের নাম ছিল ‘এইসব দিনকাল’। সেদিনের সেই সাপ্তাহিক ঢাকা এখন দৈনিক। ২০০৩ সালে দৈনিক হিসেবে ওই পত্রিকার যাত্রারম্ভ। সাপ্তাহিক হিসেবে জন্ম হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। এই পত্রিকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ইউনূসের সৌজন্যে পাওয়া গেছে হ‌ুমায়ূনের এই দুর্লভ রচনাটি। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১ এপ্রিল ১৯৮৮, সাপ্তাহিক ঢাকার ১১ বর্ষ ১০ সংখ্যায়। লেখাটি এখন অবধি অগ্রন্থিত। এখানে হ‌ুমায়ূন সোচ্চার হয়েছিলেন নকলের বিষয়ে। সোচ্চার ছিলেন ছেলেমেয়েদের ন্যায়–অন্যায় বোধ নিয়ে। ন্যায়–অন্যায় বোধ প্রসঙ্গে এখনো প্রায় একই রকম বাস্তবতা বর্তমান বলে লেখকের এই রচনা এ প্রজন্মের মানুষকেও স্পর্শ করতে সক্ষম। অগ্রন্থিত এ লেখা ছাপার সময় সমকালীন বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।