বাবার বইয়ের মধ্যে একটা মায়া আছে

হ‌ুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে অনেকবারই কেঁদেছেন শীলা আহমেদ। ছবি: কবির হোসেন
হ‌ুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে অনেকবারই কেঁদেছেন শীলা আহমেদ। ছবি: কবির হোসেন

হ‌ুমায়ূন আহমেদের লেখার পদ্ধতিটি কেমন ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন জনপ্রিয় এ কথাসাহিত্যিকের মেয়ে শীলা আহমেদ। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর লেখালেখি ও সাহিত্যজগৎ নিয়ে প্রথমবারের মতো কথা বললেন তিনি। সঙ্গে জানালেন বাবাকে নিয়ে নিজের অনুভবের কথাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ।

আলতাফ শাহনেওয়াজ: হ‌ুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন লেখার সূত্রে আমরা জানি যে কোনো লেখা শেষ হলেই তিনি আপনাকে সেটি পড়তে দিতেন, মতামত জানতে চাইতেন। এমনকি আপনি কোনো সংশোধনী দিলেও তিনি সেটি ভেবে দেখতেন। সেই সময়ের কথা মনে আছে?
শীলা আহমেদ: আমাদের ভাইবোনদের ভেতরে বাবা আমাকে খুব বেশি আদর করতেন। আমি ছিলাম সবচেয়ে দুষ্টু আর অবাধ্য। বাবা তাই হয়তো আমাকে বেশি আদর করতেন। বিদেশ থেকে আমার জন্য কোনো না কোনো স্পেশাল গিফট আনতেন, তাঁর অন্য সন্তানেরা এতে দুঃখ পাবে কি না, এটাও ভাবতেন না।
বাবা কোনো লেখা শেষ করার পর মাসহ আমাদের তিন বোনকে তা পড়তে হতো। এটা ছিল আমাদের বাড়ির নিয়ম। লেখালেখির সমালোচনা শুনলে তিনি অবশ্য রেগে যেতেন। তবে মুখে যা-ই বলতেন না কেন, আমাদের কথা শুনে তিনি অনেক সময় তাঁর লেখার ছোটখাটো কিছু দিক বদলাতেন। প্রয়োজনে সেটা নতুন করে সাজিয়ে লিখতেন।
আমরা তো জ্ঞানী-গুণী মানুষ ছিলাম না। ছিলাম স্কুলে পড়া বাচ্চা মেয়ে—সাধারণ পাঠক। এমন সাধারণ পাঠকের কাছে লেখাটা কেমন লাগে, বাবা সেটাই বুঝতে চাইতেন। লেখা হয়ে গেলেই আমাদের সেটা পড়তে দিতেন, আর আমাদের সামনে গম্ভীর মুখে পায়চারি করতেন। বারবার তাকাতেন আমাদের মুখের দিকে, পড়ে কেমন লাগছে, তা বোঝার চেষ্টা করতেন। যেমন লেখাটা যদি দুঃখের হয়, তবে সেটা পড়ে আমরা কাঁদছি কি না, তা খেয়াল করতেন। ধরেন, কোনো দুঃখের কাহিনি পড়লাম, পড়ার পর চোখে পানি এল না। তখন তিনি খুব রেগে যেতেন—দুঃখের কাহিনি পড়ার পরও আমার চোখে পানি আসছে না কেন? যেন আমি একটা বড় অপরাধ করে ফেলেছি!

আলতাফ: বাবার লেখালেখির প্রক্রিয়াটি নিশ্চয় আপনার চোখে ভাসে। লেখালেখির সময় কী করতেন তিনি?
শীলা: লেখার আগে পায়চারি করতে করতে চিন্তা করতেন। প্রচুর সিগারেট খেতেন। লেখার মাঝখানে উঠে হাঁটতেন। আর পাঁচ মিনিট পর পর চা চাইতেন। লেখা যখন শুরু করতেন, একমনে গড় গড় করে লিখে যেতেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিনি নীরব বাসায় লিখতে পারতেন না। ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা, চিৎকার–চেঁচামেচি—এসবের মধ্যে তিনি লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
অনেক সময় সারা রাত জেগে একটা পুরো উপন্যাস লিখে ফেলতেন। লেখা শেষ হলে, সেটা কখনোই আর পড়তেন না। আমাদের পড়তে দিতেন।

আলতাফ: লিখতে লিখতে কখনো কি আটকে যেতেন? আটকে গেলে কী করতেন?
শীলা: শুনেছি, আগে যে সময় তাঁর লেখা আটকে যেত, প্রচণ্ড রেগে থাকতেন, যাকেই সামনে পেতেন, তাকেই ধমকাতেন। কিন্তু আমি নিজে তাঁকে আটকে যেতে দেখিনি, তবে জোছনা ও জননীর গল্প লেখার সময় দেখেছি তিনি অনেক দিন চেষ্টা করেও শুরু করতে পারছিলেন না। কিন্তু শুরু করার পর একটানে লিখে গেছেন।

আলতাফ: বাবা নয়, আপনার বিবেচনায় লেখক হ‌ুমায়ূন আহমেদের ভালো দিক কোনটি?
শীলা: আমি সাধারণ পাঠক, বিশেষজ্ঞ নই। তাই বাবার সাহিত্যের ভালো দিকের কথা বলতে পারব না। তবে হ্যাঁ, পাঠক হিসেবে বাবার বই অন্য লেখকদের চেয়ে আমার কাছে আলাদা লাগে। মনে হয়, বাবার বইয়ের মধ্যে একটা মায়া আছে, পড়া শেষে একটা হাহাকার লাগে, চরিত্রগুলোর প্রতি একধরনের মায়া তৈরি হয়। এ রকম না যে তারা খুব ভালো বা তারা প্রত্যেকে পবিত্র। কিন্তু তারা যেমনই হোক, বই পড়া শেষে ওই চরিত্রগুলোর জন্য অদ্ভুত মায়ার সৃষ্টি হয়। এটা আমি আলাদাভাবে বাবার বইয়ে খুঁজে পাই। আগে ভাবতাম, আমি তাঁর মেয়ে বলেই হয়তো এভাবে চিন্তা করি। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। না হলে মানুষ তাঁর বই এত পছন্দ করবে কেন? তারাও নিশ্চয় বাবার তৈরি ওই চরিত্রগুলোর মায়াতে আটকে যায়।

আলতাফ: পাঠক হিসেবে লেখক হ‌ুমায়ূন আহমেদের লেখার কোনো ত্রুটি কি চোখে পড়ে?
শীলা: পড়ে। সেটা হলো একটা সময়ের পর থেকে তাঁর লেখাতে পুনরাবৃত্তি। বইমেলার সময় তাঁকে প্রকাশকদের অনেক চাপের মধ্যে লিখতে হতো। বই বের হবে, তাই তাঁকে অল্প সময়ের মধ্যে অনেকগুলো বই লিখে শেষ করতে হবে। এই চাপ মাথায় নিয়ে লিখতেন বলে বাবার শেষের দিকের বইগুলোতে লেখকসুলভ যত্নের অনেক অভাব আছে। তাঁর প্রথম দিকের বইগুলো আর পরে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার সময়কার বইগুলোর মধ্যে পার্থক্যটা টের পাওয়া যায়।

আলতাফ: আপনার বাবা তো কবিতার ভক্ত ছিলেন। যদ্দুর জানি, প্রচুর কবিতা পড়তেন...
শীলা: হ্যাঁ, প্রচুর কবিতা পড়তেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল আর জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়তেন। কতশত কবিতা যে মুখস্থ বলতে পারতেন! তাঁর আবৃত্তি খুবই খারাপ ছিল। কিন্তু তাঁর খুব শখ ছিল কবিতা আবৃত্তির। আমাদের দিয়ে নিজের কবিতা আবৃত্তি রেকর্ড করাতেন। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা আবৃত্তি করার সময় নজরুলের মতো করে সাজতেন। আমি আর আমার ছোট বোন বিপাশা তাঁকে সাজাতাম।

আলতাফ: হ‌ুমায়ূন আহমেদ প্রতিনিয়ত জনপ্রিয় থেকে যে জনপ্রিয়তম হয়ে উঠলেন, সে সময় তাঁর মধ্যে কি কোনো অহমিকা এসেছিল, কী মনে হয় আপনার?
শীলা: অবশ্যই এসেছিল। তবে সেটা অনেক পরে। সম্ভবত তাঁর বন্ধুমহল পরিবর্তন হওয়ার পরে। ছয়-সাত বছর বয়স থেকেই দেখে আসছি যে বাবা খুব জনপ্রিয়। কিন্তু তাঁর জীবনযাত্রা খুব সাধারণ ছিল। তিনি সব সময় আমাদের বলতেন অহংকার না করতে। বলতেন, আমার মেয়ে হিসেবে কখনো কোনো সুবিধা নেবে না। বাবার সঙ্গে নাটকের শুটিংয়ের সময়ে বাবা আমার জন্য আলাদা কিছু করতেন না। সবাই যখন খাচ্ছে, তখন যদি আমি খাবার নিই তবে খাবার পাব, না হলে নয়। সব সময় বলতেন, তোমার প্রধান পরিচয় যেন হ‌ুমায়ূন আহমেদের মেয়ে না হয়।
তবে বাবা শেষের দিকে আর এমন ছিলেন না। বাবার প্রথম দিকে যে বন্ধুরা ছিলেন, তাঁরা তাঁর সমালোচনা করতেন, নানা বিষয়ে তর্ক করতেন। কিন্তু পরের দিকে যাঁরা তাঁর বন্ধু হলেন, তাঁদের বেশির ভাগের মনোভাব এমন ছিল, ‘স্যার, আপনি যা করবেন সেটাই ঠিক।’ তাই তখন বাবাকে তাঁর কাজ বা জীবনযাপন নিয়ে কিছু বললে তিনি বলতেন, ‘তোমরাই শুধু এমন বলছ। আর সবাই তো বলছে এটা ঠিক আছে।’ তো বাবার মধ্যে এই পরিবর্তনটুকু এসেছিল।

বাবা হ‌ুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে মেয়ে শীলা আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
বাবা হ‌ুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে মেয়ে শীলা আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত


আলতাফ: আপনার বাবার সবচেয়ে ভালো গুণ কী ছিল?
শীলা: বাবা মানুষের গুণ বা প্রতিভাকে মূল্যায়ন করতেন। লেখক, কবি, চিত্রকর—আপনি যদি সৃষ্টিশীল মানুষ হন, বাবা আপনাকে মন থেকে প্রশংসা করবেন। এটা বাংলাদেশে খুব বিরল। বাংলাদেশের মানুষ তো অন্যের প্রশংসা করতে পারে না, বরং অন্যের খারাপ দিক নিয়ে কথা বলে। আমার বাবা সে রকম ছিলেন না।
আরেকটা জিনিস ছিল তাঁর, প্রচুর পড়তেন। কত কিছু যে তিনি পড়তেন তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই।

আলতাফ: তাঁর একটি খারাপ দিকের কথা জানতে চাইলে কী বলবেন?
শীলা: বাবা আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন। আমাদের বাসায় সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল বাবার লেখালেখি। তিনি যে লিখছেন, এর চেয়ে বড় কোনো ঘটনা ঘটতে পারে না আমাদের বাসায়। সেটাকে কেন্দ্র করে সংসারের সব হচ্ছে। আমি পাস করছি না ফেল করছি, আমার মা কী করছে, সবাই সুস্থ আছে কি না—এগুলো বাবার কাছে কোনো মুখ্য বিষয় না। বাবা কখনো আমাদের বইপত্র উল্টে দেখে বলতেন না যে আচ্ছা, ও তো খারাপ করেছে, ওকে ভালো করানোর জন্য আমাকে পড়াতে হবে। বাবা আমাদের কারও জন্মদিন, ক্লাস, বয়স মনে রাখতেন না।
আমার মায়ের জীবনেরও সবকিছু চলত বাবার লেখাকে কেন্দ্র করে। বাবা কী লিখছেন, তাঁর লেখায় কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না—এসবই ছিল তাঁর প্রধান ভাবনা। বাবার খুব প্রিয় বিষয় ছিল তিনি যখন লিখবেন, সে সময় মা তাঁর পাশে বসে থাকবেন। আর খানিকক্ষণ পর পর তাঁকে চা বানিয়ে খাওয়াবেন।

আলতাফ: বাবার লেখা আপনার প্রিয় উপন্যাসের নাম জানতে চাই।
শীলা: সেটা তো বলে শেষ করা যাবে না। বাবার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিগুলোর প্রায় সব কটিই আমার প্রিয়। ফিহা সমীকরণ, তোমাদের জন্য ভালোবাসা ভীষণ ভালো লেগেছিল। এ ছাড়া আমার আছে জল, আগুনের পরশমণি, নবনী—আরও অনেক আছে, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

আলতাফ: হ‌ুমায়ূন আহমেদের কোন গুণটি নিজের ভেতরে পেতে চান আপনি?
শীলা: ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছ থেকে শুনে এসেছি যে বাবার যত খারাপ দিক, সেগুলো সবই আমি পেয়েছি। এতে অবশ্য আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার বাবার ভালো একটা গুণ ছিল—ধৈর্য। তিনি কোনো কাজ করবেন ঠিক করলে ধৈর্য ধরে সেটা শেষ করতেন। তাঁর জন্য যা করা দরকার, তাই-ই করতেন। আমি বাবার এই গুণটা পছন্দ করি।

আলতাফ: বাবার কোন স্মৃতি বেশি মনে পড়ে আপনার?
শীলা: বাবার মুখ আমার বেশি মনে পড়ে না, মনে পড়ে তাঁর কফিনটা। বাবা মারা যাওয়ার পর বিমান থেকে তাঁর কফিনটা নামানো হচ্ছিল। সেই দৃশ্যটাই বারবার মনে পড়ে।
আমাদের ঘিরে তখন অসংখ্য লোক, শত শত ক্যামেরা, কফিন বহন করার জন্য গাঁদা ফুল দিয়ে সাজানো লাশের গাড়ি। চারপাশ থেকে ছবি তোলা হচ্ছে। বাবার মৃতদেহ যে বিমানে এসেছে, একই বিমানে আরেকটা কফিন সেদিন এসেছিল। একটা মেয়ে আর হয়তো তার মা এসেছিল মৃতদেহ নিতে। মেয়েটা ঘৃণার চোখে তাকাচ্ছিল আমার দিকে। তার হয়তো মনে হচ্ছিল, আমার বাবা মারা গেছে বলে চারদিকে এত আয়োজন, অথচ সে-ও তো একজন প্রিয়জন হারিয়েছে, তার জন্য তো কোনো আয়োজন নেই। আমার মনে হচ্ছিল তাকে গিয়ে বলি, গাঁদা ফুল, ক্যামেরা, মানুষের ভিড়—এসবের কোনো মূল্যই নেই আমার কাছে। বলি, প্রিয়জন হারানোর বেদনা তোমার আর আমার ভেতর একদম একই রকম।