মহাদেব সাহার কথা ও কবিতা

ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
>৫ আগস্ট কবি মহাদেব সাহার জন্মদিন। এ উপলক্ষে পদ্যে ও গদ্যে তিনি জানালেন নিজের অনুভূতির কথা।

দেখতে দেখতে একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম। এখন যদি হিসাব করি—কী পেয়েছি আর কী পাইনি, তবে হিসাবের খাতায় দেখব, কেবল অনিশ্চয়তার পথেই আমি পা বাড়িয়েছি। অনেক ক্ষেত্রে নির্বোধের মতো কাজ করেছি, বৈষয়িক অনেক অঙ্কই আমি বুঝিনি। এসব নিয়ে আজ আর কোনো খেদ নেই। সঙ্গে সঙ্গে এ–ও বলব, ওই রকম নির্বোধের মতো কাজ না করলে হয়তো আমি কবিতা লিখতেও পারতাম না।

নিজের দিকে তাকিয়ে এখন প্রায়ই মনে হয়, আমার তো কোনো কীর্তি নেই, লোকহিতৈষণা নেই, কোনো সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান—কিছুই করিনি আমি। তাহলে কী করেছি একজীবনে? কেবল কিছু পদ্যই লিখেছি। সেগুলোও হয়তোবা খারাপ পদ্য। তবে এটাও বোধ হয় সত্য, এই দেশে একসময় মানুষ যখন কবিতাবিমুখ হয়ে পড়েছিল, তখন আমিসহ আরও দু–একজনের কবিতা মানুষকে কাব্যক্ষেত্রে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল। কবিতা লিখে আমি যা পেয়েছি, খুব কম মানুষই তা পান। শত শত মানুষের ভালোবাসা তো পেয়েছিই, উপরন্তু পেয়েছি আরও অনেক কিছু। ঢাকার নিউমার্কেটের চালের দোকানদার মান্নান কাজী, তাঁর কাছে আমি শুধু ‘কবিসাহেব’ বলেই দিনের পর দিন বাকিতে আমাকে চাল দিয়ে গেছেন তিনি। চিকিৎসকের কাছে গিয়েছি, কেবল কবি হওয়ার কারণে আমার কাছ থেকে তিনি কোনো ফিস নেননি। মানুষের এই বিপুল ভালোবাসার মূল্য আমার কাছে সব পুরস্কার–পদকের চেয়েও বেশি। প্রথম কবিতার বই এই গৃহ এই সন্ন্যাস থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক বই কোথা পাই দিব্যজ্ঞান—সব মিলিয়ে ৮০টি কাব্যগ্রন্থ আমি লিখেছি। পাঁচ শতাধিক গান লিখেছি। কবিতা ও গানের মধ্যে দিয়ে বারবার মানুষের কথাই বলতে চেয়েছি। বলেছি প্রেমের কথা, ভালোবাসার কথা। তবে এই ভালোবাসাকে যদি শুধু মানব–মানবীর প্রেমের মধ্যে আটকে রাখা হয়, নিশ্চিতই তার প্রকাশকে সংকীর্ণ করে ফেলা হবে। প্রেম তো একটি সর্বজনীন অনুভূতির নাম। প্রেমের মাধ্যমে, কবিতার মাধ্যমে সেই সমগ্রকে ছুঁতে চেয়েছি আমি।

আমি এখন আমার নিজেকে জয় করতে চাই। আমার প্রতিযোগিতা আজ কেবল আমারই সঙ্গে। আমি কবিতা লেখার জন্য জন্মেছি, হয়তো খারাপ কবিতা লেখার জন্যই জন্মেছি, ভালো কবিতা অন্যরা লিখুক। আমার কাছে কবিতা হলো স্মরণযোগ্য সেই উচ্চারণ, যা মানুষের মনে ও মুখে ঘুরতে থাকে, হৃদয়ের ভেতরে গুঞ্জরিত হয়। কবিতার মধ্য দিয়ে আমি প্রেমের কথাই বলতে চাই, বলতে চাই সর্বমানবের কথা। কারণ, বিশ্বাস করি যে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’

কেউ নেই

বাঁশি বা বাদ্য, নৃত্য বা নূপুর কিছুই কানে আসে না
কত মেঘলোক, জলপথ, অন্ধকার
                               পাড়ি দিচ্ছি;

 সুন্দরীদের নাচের শব্দ শুনি না আর, নীলবর্ণ
পাখিদের চোখ দেখি না,
আমি হারিয়ে যাচ্ছি আলোতে–অন্ধকারে, ধুলায়–অরণ্যে
আমি শুধু চুম্বন করছি মাটি, আলিঙ্গন করেছি
                               জলধারা,
এভাবে আলোতে–অন্ধকারে, ধুলায়–মাটিতে কোথায়
                               মিশে যাচ্ছি জানি না,
জানি না কোন আকাশ থেকে কোন আকাশে, অন্তরিক্ষে
অস্তগামী সূর্যের আলো কুড়াতে কুড়াতে
ভিক্ষাপাত্র হাতে আমি প্রবজ্যায় চলেছি,
এ আমার কোন সন্ন্যাসব্রত, কোন দীক্ষা গ্রহণ, কাঁধে সমিধ কাষ্ঠ;

 কিন্তু কেউ ফিরে তাকাই না, কোনো মন্ত্র শুনি না
পাখিগুলি উড়তে উড়তে বৃষ্টির মধ্যে মেঘবৃষ্টি হয়ে গেল
আমি ধুলায়–মাটিতে, জলে–অন্ধকারে ডুবে যাই,
নাচঘর বন্ধ হয়ে গেল
কেউ নেই, কোথাও কেউ নেই।

আত্মভ্রম

কতবার পরাস্ত হয়েছি গোপন গন্ধের কাছে,
উত্তাল স্রোতের কাছে;
মায়ায়–মাদকে হয়েছি মোহিত
কতবার কম্পিত হয়েছি ঘ্রাণে, কোমল কটাক্ষে।

 কতবার ভেঙে গেছি নৃত্যে–নূপুরে
এলোমেলো হয়ে গেছি গোলাপে–গ্রীবায়
বৃদ্ধ হয়েছি এই গহন গুঞ্জনে,
ডুবে গেছি জোয়ারে–জ্যোৎস্নায়;

 বুঝি নাই কি আলোক কি তামাশা,
কি মায়া, রহস্য, মরীচিকা
বারবার পরাস্ত হয়েছি ভুরুর ভাষায়
আত্মভ্রমে হয়েছি দণ্ডিত।