'আমাদের মৃতদেহে প্রাণ দান করিলেন'

মধ্য বয়সে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ (৮ অক্টোবর ১৮৬২—৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)। ছবি: সংগৃহীত
মধ্য বয়সে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ (৮ অক্টোবর ১৮৬২—৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)। ছবি: সংগৃহীত

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ যখন চোখ খুললেন, দেখলেন আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান মেয়েগুলোর চোখে জলের ধারা! তিনি বিস্মিত হলেন। বুঝলেন, এদের সম্পর্কে তিনি যা ভেবেছেন, তা ঠিক নয়। এরা ভারতীয় সংগীতকে ফ্যাশন মনে করে একটু ছুঁয়ে দেখতে আসেনি, সত্যিই এরা সংগীতের সমঝদার। মনপ্রাণ দিয়ে বাজাতে শুরু করলেন আবার। পূর্ব-পশ্চিমের এই মিলন আলাউদ্দিন খাঁর মন ভরিয়ে দিল।

এই গল্পটা বলব একদম শেষে।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সম্পর্কে একটা প্রশ্ন জাগে মনে—কীভাবে একটা মানুষ এত বেশি সাদাসিধে হতে পারেন?

গানের নেশায় কীভাবে তিনি স্কুল পালালেন, বাড়ি ছাড়লেন দুবার, সে কথা অনেকেই জানেন। অনেকেই জানেন, ছাত্রদের কতটা ভালো বাসতেন তিনি। আবার রেগে গেলে এই ওস্তাদ হাতের কাছে যা পেতেন, তা দিয়ে মারতেন ওই শিক্ষার্থীদেরকেই। তিনি গাইতেন, বাজাতেন। বাগানচর্চা করা ছিল তাঁর শখ। মাইহারের রুক্ষ জমিতে বাগান তৈরি করা সহজ কাজ ছিল না। নিজেই করতেন, কালু নামে এক আদিবাসী ছোকরা ছিল সহযোগী। কখনো কালু বাগানে ঠিকমতো পানি না দিলে কালুকে তো বকতেনই, জমিজমা, গাছও রেহাই পেত না তাঁর বকাবকি থেকে।

বাজারে যেতেন মনস্থির করে—ঠকবেন না। দরদাম করে, চেঁচামেচি করে দু-এক পয়সা দাম কমানোর জন্য বাজারে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিতেন, সবজিওয়ালা আর মাছওয়ালাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতেন। সেই তিনিই আবার বাড়ি ফিরে সারিবদ্ধ ভিখারিদের মুঠো মুঠো চাল দিতেন, পয়সা দিতেন। অর্থের প্রতি কোনো ধরনের লোভ ছিল না তাঁর। অনেক বড় বড় দরবার থেকে (হায়দরাবাদ, কাশ্মীর) মোটা টাকার চাকরির আমন্ত্রণ পেয়েছেন। মাইহারের সামান্য টাকার চাকরি ছেড়ে সেসব জায়গায় যাননি তিনি।

কেউ কি বিশ্বাস করবে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ২০০ রকম বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন? তাঁরই হাতে জন্ম নিয়েছে বেশ কিছু অসাধারণ বাদ্যযন্ত্র। বড় সরোদের কথাই ধরা যাক। তাঁরই নির্দেশনায় এই সরোদ বানিয়েছিলেন তাঁর ছোট ভাই ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। বানিয়েছিলেন ছেলে আলী আকবর খানের জন্য। এই বড় সরোদের বৈশিষ্ট্যটাও তো জেনে নেওয়া দরকার। আগে আলাপের জন্য ব্যবহার হতো সুরশৃঙ্গার, জোড়ের জন্য রবাব আর গৎ-এর জন্য সরোদ। বড় সরোদে এই তিন অঙ্গেরই পূর্ণ প্রকাশ করা যেত। এ ছাড়া আলাউদ্দিন খাঁর সৃষ্ট বাদ্যযন্ত্রগুলোর মধ্যে আছে চন্দ্রসারঙ্গ, নলতরঙ্গ, বড় সারঙ্গ, সেতার-ব্যাঞ্জো ইত্যাদি।

নতুন নতুন রাগরাগিণী সৃষ্টি করেছেন অনেক। এর মধ্যে রয়েছে হেমন্ত, হেম-বেহাগ, মদন-মঞ্জরী, মঝ খাম্বাজ, শুভাবতী, দুর্গেশ্বরী, প্রভাকরী, হেমন্ত-ভৈরব ইত্যাদি।

এবার শুরুর সেই গল্পটা বলি। ১৯৩৫ সালে কিংবদন্তি নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর তাঁর নাচের দল নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণে যাবেন। তিনি চাইলেন আলাউদ্দিন খাঁ যেন তাঁদের সঙ্গে যান। সেই দলে ছিলেন রবিশঙ্কর, সিমকি, জহুরা বেগম, ম্যানেজার গ্রাটাসহ আরও আট-দশজন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ গেলেন, কী কী সমস্যায় পড়লেন শুরুতেই জাহাজে, তা নিয়ে তিনি নিজেই লিখে গেছেন। যেমন কাঁটা আর ছুরি দিয়ে খাওয়ার বিপদ, ইউরোপের মসলাবিহীন সেদ্ধ খাবারে বীতশ্রদ্ধার পাশাপাশি মুড়ি আর দুধ-দইয়ের প্রতি অনুগত থাকা—এসব নানা কাহিনি জানা যায় তাঁর জবানিতেই। পণ্ডিত রবিশঙ্করের লেখায় পাব, কীভাবে একবার প্যারিসের নাইট ক্লাবে গিয়ে অস্বস্তিতে পড়েছিলেন তিনি। ইউরোপের বিভিন্ন শহরে (বিশেষ করে বুদাপেস্টে) সংগীত আলোচনা খুবই উপভোগ করেছিলেন ওস্তাদ। ইউরোপ সম্পর্কে আলাউদ্দিন খাঁ লিখেছেন, ‘ইউরোপে অনেক কিছু দেখলাম। তখন জার্মেনীতে হিটলার, ইটালিতে মুসোলিনী। চারিদিকে যুদ্ধের হুমকি। আমি রাজনীতি বুঝি না। কিন্তু আরব প্যালেস্টাইন থেকে শুরু করে ইউরোপের সর্বত্র দেখলাম আধুনিক সভ্যতার পরিচয়। আমাদের দেশ তখন দারিদ্র্যে, অশিক্ষায় কত পিছিয়ে ছিল। হিন্দু-মুসলমানে ঝগড়া, ব্রাহ্মণ-শূদ্রে ছোঁয়াছুঁয়ির মানা, এমন অন্ধতা। আর পশ্চিম তখন সভ্যতায়, শিক্ষায়, জ্ঞানে কত এগিয়ে গেছে। কে বলে ইউরোপ যন্ত্রসভ্যতার দাস, জড়বাদী। তাদের জ্ঞানবিজ্ঞানের সাহায্যে মানুষের আধ্যাত্মিক শক্তিও তারা বাড়িয়ে তুলেছে। সেখানে মানুষের মতো বাঁচতে শিখেছে আর আমরা নির্জীব তামসিকতায় আচ্ছন্ন।’

আমাদের এ দিকটা কি এখনো ওস্তাদজির বর্ণনার চেয়ে এতটুকু এগিয়েছে?

সে যাক। পৃথিবীর বহু শহরেই উদয়শঙ্করের দলের সঙ্গে ঘুরেছেন আলাউদ্দিন খাঁ। প্যারিসের কথা বলছিলেন তিনি। সরোদ শোনার জন্য একদল আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান মেয়ে এল তাঁর হোটেলে। আলাউদ্দিন খাঁ ভাবলেন, এরা তো হুজুগে। প্রাচ্যের সংগীত শোনা এদের জন্য ফ্যাশন। তাই একটু গপ্পো করা, একটু শোনা—এই হয়তো উদ্দেশ্য এদের। ফলে বিরক্তি বুকে নিয়ে বাজাতে শুরু করলেন তিনি। বেলা তখন ৩টা। ওস্তাদজি তাকালেন ওদের দিকে। দেখলেন, ওরা খুব মন দিয়ে শুনছে। সুরের ভেতরে ঢুকতে চাইছে। তাতে মন ভরে গেল আলাউদ্দিন খাঁর। এবার তন্ময় হয়ে তিনি বাজালেন ৩ ঘণ্টা। ৬টার সময় চোখ খুলে দেখলেন, মেয়েদের চোখে জলের বন্যা। প্রত্যেকেই কাঁদছে। বাজানো থামতেই খানিকের স্তব্ধতা কাটিয়ে ওরা ছুটে এলেন আলাউদ্দিন খাঁর কাছে। জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে, কপালে চুমু খেতে লাগলেন।

এ কথাই তিনি লিখেছেন চিঠিতে, আয়েত আলী খাঁর কাছে। চিঠির অংশটা এ রকম, ‘মে মাসের পাঁচ তারিখে প্যারিস ও আমেরিকার কয়েকটি মেয়ে দিন তিনটার সময় বাজনা শুনিতে আসিয়াছিল হোটেলে। তাহারা এখানকার নর্তকী ও গায়িকা। প্রথমে আমি ভাবিয়াছিলাম তাহারা কি আমার বাজনা পছন্দ করিবে? আমি অবহেলার ভাব লইয়া “মুলতানী” বাজাইতে আরম্ভ করি। বিলম্বিতের পাঁচ-সাতখানি তান বাজাইবার পর তাহাদের দিকে চাহিয়া দেখি সকলের চোখ হইতে জল পড়িতেছে। তখনই আমার চৈতন্য হইল, আমি কি অন্যায় করিতেছি, তারপর মন দৃঢ় করিয়া এক ঘণ্টা মুলতানী শুনাইলাম। যতক্ষণ বাজাইয়াছিলাম, ততক্ষণ তাঁদের চোখে জল পড়া বন্ধ হয় নাই। তারপর ভিমপলাশ্রী ও পিলু বাজাইয়া প্রায় তিন ঘণ্টা পর বাজনা শেষ করি। তাহাদের কান্না তখনো বন্ধ হয় নাই। বুঝিলাম তাহারাই সত্যিকারের সমঝদার—সংগীতের পরম ভক্ত। যাইবার সময় গুরুজনদের যেইভাবে ভক্তি করে সেইরূপ করিয়া বলিয়া গেল, “আমাদের মৃতদেহে প্রাণ দান করিলেন।”’

 ১৮৬২ সালে জন্ম নেওয়া এবং ১৯৭২ সালে মৃত্যুবরণ করা এই ওস্তাদের ব্যক্তিজীবন ও সংগীতজীবনের নানা দিকে এখনো ঠিকভাবে আলো ফেলা হয়নি। হলে দেখা যেত, তিনি ছিলেন তেমন মানুষ, যেমনটা হওয়া উচিত ছিল মানুষের।

সূত্র: মোবারক হোসেন খান সম্পাদিত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও রবিশঙ্করের রাগ অনুরাগ