ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সুইসাইড নোট ও দৈত্য

দৈত্যের সঙ্গে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। অলংকরণ: আরাফাত করিম
দৈত্যের সঙ্গে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। অলংকরণ: আরাফাত করিম

দৈত্য! ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ (৮ অক্টোবর ১৮৬২-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২) শিল্পী মানুষ। খুব বেশি হলে তাঁর কাছে বাদ্যযন্ত্র থাকতে পারে। তাই বলে দৈত্য! হ্যাঁ, তেমনটাই তিনি বলে গেছেন শান্তিনিকেতনে। ১৯৫২ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে ‘দিনেন্দ্র অধ্যাপক’ পদে দুই মাসের জন্য শান্তিনিকেতনে নিয়ে এসেছিল ছাত্রদের সংগীত শিক্ষার জন্য। সে সময় বিভিন্ন আড্ডায় তিনি ছাত্রদের বিভিন্ন গল্প শোনাতেন। সেই সব গল্পকে অনুলিখন করে শুভময় ঘোষ একখানি বই প্রকাশ করেছিলেন। নাম ‘আমার কথা’। সেই বইয়ে আলাউদ্দিন খাঁর দৈত্যের প্রসঙ্গটি রয়েছে। আর সুইসাইড নোট? আরে শিল্পীরা কত তুচ্ছ কারণেই না আত্মহত্যা করে থাকেন। তবে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ আত্মহত্যার কথা ভেবেছিলেন সংগীত শিখতে না পেরে।

দৈত্য আর সুইসাইড নোট প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলে রাখি, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর জীবনে ‘রামপুর’ নামের জায়গাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই রামপুর বর্তমানে ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি জেলা। আদতে এটি ছিল ব্রিটিশ আমলের একটি ‘প্রিন্সলি স্টেট’। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সময় এই স্টেটের নবাব ছিলেন হামিদ আলী খান বাহাদুর। নবাব স্বয়ং ছিলেন সংগীতের সমঝদার এবং শিল্পী। তাঁর ওস্তাদ ছিলেন উজীর খাঁ। উজীর খাঁ ছিলেন রামপুর ঘরানার বিখ্যাত সংগীত সাধক। তাঁর কাছে আলাউদ্দিন খাঁ তালিম নিয়েছিলেন সংগীতের। তারও আগে মুক্তাগাছার জমিদার বাড়িতে যে ওস্তাদের সঙ্গে আলাউদ্দিন খাঁর দেখা হয়েছিল, মূলত যাঁর হাত ধরে তিনি উত্তর প্রদেশের পথে পা বাড়ান, তিনিও রামপুরের মানুষ-ওস্তাদ আহমদ আলী। এই রামপুরেই সংগীত শিক্ষা করে তিনি মাইহার রাজ্যের সভা গায়ক এবং সে রাজ্যের নবাবের সংগীত গুরু হয়েছিলেন। আর এখানেই সংগীত শেখার সময় তাঁর কাছে ছিল দুটি দৈত্য!

ওস্তাদ আহমদ আলীর মায়ের পরামর্শে আলাউদ্দিন খাঁ সংগীত শিখতে গেলেন ওস্তাদ উজীর খাঁর কাছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ঘুরেও তাঁর দেখা পাচ্ছিলেন না তিনি। বারবার উজীর খাঁর বাড়ির দারোয়ান ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন আলাউদ্দিন খাঁকে। এ ঘটনায় তিনি হতাশ হয়ে গেলেন। আর এই হতাশার কারণে তিনি আত্মহত্যা করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। আত্মহত্যা করার জন্য তিনি কিনলেন দুই তোলা আফিম। ঠিক করলেন, এই আফিম খেয়েই তিনি আত্মহত্যা করবেন। ‘সংগীত শিখতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মরে যেতে হবে’ এই ভেবে আলাউদ্দিন খাঁ খুবই বিমর্ষ হয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন ভীষণ ধর্মপ্রাণ মানুষ। নামাজ পড়তেন নিয়মিত। সেদিনই তিনি ফজরের নামাজ আদায় করতে গেছেন মসজিদে। উদাসী আর বিষণ্ন দেখে মসজিদের এক মৌলভি তাঁকে বিষণ্নতার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। মসজিদে মিথ্যা বলা পাপ ভেবে আলাউদ্দিন খাঁ মৌলভিকে জানালেন যে তিনি গানবাজনা শিখতে পারছেন না। কোনো ওস্তাদ তাঁকে সংগীত শেখাচ্ছেন না। এ কারণে তিনি আত্মহত্যা করবেন বলে ঠিক করেছেন। মৌলভি তাঁকে অনেক বুঝিয়ে নবাবকে দেওয়ার জন্য একখানি চিরকুট লিখে দিলেন। তিনি লিখলেন, ‘আমার নিবাস ত্রিপুরা। আমি সরোদ শিখিতে এত দূর আসিয়াছি। আপনার প্রাসাদের উজীর খাঁ, তাঁর কাছে বাজনা শিখিতে চাহি। তাহা না হইলে আমি আফিম খাইয়া প্রাণ ত্যাগ করিব।’ এই সুইসাইড নোট পকেটে নিয়ে তিনি চলে গেলেন রামপুরের নবাব হামিদ আলী খান বাহাদুরের প্রাসাদে। এই নবাবের রাজসভাতেই ওস্তাদ উজীর খাঁ প্রধান সভাশিল্পী ছিলেন এবং স্বয়ং নবাব তাঁর কাছে সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করতেন। ওস্তাদ উজীর খাঁ শুধু সংগীতশিল্পীই ছিলেন না, একজন কবি ও নাট্যকারও ছিলেন। সে সময় তাঁর নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছিল রামপুরে।

আলাউদ্দিন খাঁ যখন নবাবের প্রাসাদে হাজির হলেন তখন নবাব ওস্তাদ উজীর খাঁর নাটক দেখতে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছিলেন। সিপাই-লস্করদের ফাঁকি দিয়ে আলাউদ্দিন খাঁ নবাবের মোটর গাড়ির সামনে দুই হাত মেলে দাঁড়িয়ে পথ আটকালেন। নবাবের লোকজন এ দৃশ্য দেখে তাঁকে ধরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নবাব জানতে চাইলেন, আলাউদ্দিন খাঁ কী চান। এবার নবাবের সামনে তিনি তাঁর আরজি পেশ করলেন। চিরকুট দিলেন নবাবের প্রাইভেট সেক্রেটারির হাতে। তিনি নবাবকে পড়ে শোনালেন। চিরকুটের কথা শোনার পর নবাব আলাউদ্দিন খাঁর কাছ থেকে আফিমের গুলি চাইলেন। সেদিন নবাব আলাউদ্দিন খাঁকে নিজের গাড়িতে করে নাটক দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে নবাবের মধ্যস্থতায় ওস্তাদ উজীর খাঁর শিষ্য হতে পেরেছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ (৮ অক্টোবর ১৮৬২-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)। সৌজন্যে: ‘আমার কথা’, শুভময় ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা, ১৩৯৬ বঙ্গাব্দ।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ (৮ অক্টোবর ১৮৬২-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭২)। সৌজন্যে: ‘আমার কথা’, শুভময় ঘোষ, আনন্দ পাবলিশার্স লিমিটেড, কলকাতা, ১৩৯৬ বঙ্গাব্দ।

উজীর খাঁর কাছে যাতায়াত চলছে। থাকেন তাঁর বাড়ির উল্টো দিকের একটা বাড়িতে। সারা দিন গুরুর বাড়িতে গুরু সেবা করেন, ফাইফরমাশ খাটেন। রাত চারটা থেকে রেওয়াজ শুরু করেন। ভোরে নামাজ শেষ করে নিজে বানিয়ে চা খান, রুটি খান। এমনি একদিন ভোরে উঠে চা-রুটি খাওয়া শেষ করে আলাউদ্দিন খাঁ ভৈরবী রাগ বাজাচ্ছিলেন। এ সময় ইয়া বড় দাড়িওয়ালা এক লোক তাঁর কাছে এলেন। আলাউদ্দিন খাঁ তখন তন্ময় হয়ে বাজিয়ে চলেছেন ভৈরবী। প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তিনি চোখ মেলে তাকালেন। লোকটি বললেন যে তিনি এখানে বেশ কয়েক দিন থেকে ঘোরাঘুরি করছেন আর তার বাজনা শুনছেন। তিনি এক কাপ চা খেতে চাইলেন। আলাউদ্দিন খাঁ চা বানালেন এবং দুজনে খেলেন। তারপর সেই লোকটি তাঁর ঝোলা থেকে কালো ‘কটোরা’ বের করে আগুনে পুড়িয়ে সোনা বানিয়ে আলাউদ্দিন খাঁর হাতে দিয়ে সেটা ভাঙিয়ে টাকা আনতে বললেন। খাঁ সাহেব ইতস্তত করে সেই সোনা নিয়ে তাঁর পরিচিত একজনের কাছ থেকে ভাঙিয়ে আনলেন। দাড়িওয়ালা লোকটি সাত দিন শুধু চা খেতেন আর আট দিনের দিন খেতেন একটা রুটি।

বেশ কয়েক দিন থেকে দাড়িওয়ালা লোকটি চলে যেতে চাইলেন। যাওয়ার আগে সাত দিন তিনি তমসা নদীর পানিতে গলা পর্যন্ত ডুবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর নদী থেকে উঠে এসে একটা মাদুলি তৈরি করে দিলেন আলাউদ্দিন খাঁর হাতে। আর বললেন যে তিনি চলে যাওয়ার পর কোনো এক শনিবার ধুনো দিয়ে মাদুলি হাতে বাঁধতে হবে। আলাউদ্দিন তাই করলেন। পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলেন তাঁর পাশে শুয়ে আছে দুটো দৈত্য! পরীক্ষা করার জন্য তিনি মাদুলিটা খুলে ফেললেন হাত থেকে। ভ্যানিস! দৈত্য দুটি নেই। আবার হাতে বাঁধলেন মাদুলি। দ্বিতীয় দিনেও একই ব্যাপার। তৃতীয় দিন একই ঘটনা ঘটার পর আলাউদ্দিন খাঁ হাতের মাদুলিটি ছুড়ে ফেলে দিলেন তমসা নদীর পানিতে। মাদুলি নদীতে ফেলে দিয়ে তিনি ওস্তাদ উজীর খাঁকে খুলে বললেন সব। শুনে উজীর খাঁ ‘কেন জাদুঘরটি নদীতে ভাসিয়ে দিলে’ বলে মহাবিরক্ত হলেন।

এরপর প্রায় ৩০ বছর তিনি ওস্তাদ উজীর খাঁর কাছে সংগীত শিক্ষা করেছেন। তারপর হয়েছেন মাইহার স্টেটের সভা গায়ক এবং সেই এস্টেটের নবাবের সংগীত শিক্ষক। কিন্তু তিনি সেই দৈত্যের কথা ভুলতে পারেননি।