উপন্যাসে উচ্চতর বোধের জগৎ

আগস্ট আবছায়া মাসরুর আরেফিন প্রচ্ছদ: সেলিম আহমেদ,  প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা,  ৩২৮ পৃষ্ঠা, দাম: ৮০০ টাকা।
আগস্ট আবছায়া মাসরুর আরেফিন প্রচ্ছদ: সেলিম আহমেদ, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ৩২৮ পৃষ্ঠা, দাম: ৮০০ টাকা।

প্রকাশের পরপরই মাসরুর আরেফিনের উপন্যাস আগস্ট আবছায়াকে কেন্দ্র করে যথেষ্ট আলোচনা শুরু হয় পাঠকসমাজে। বেশ বড়সড় বই। সাধারণত এত মোটা বই পড়ার উদ্যোগ আমি নিই না। তারপরও লেখকটি মাসরুর আরেফিন বলেই, তাঁর ২০০১-এর কাব্যগ্রন্থ ঈশ্বরদী, মেয়র ও মিউলের গল্প আমাকে আলোড়িত করেছিল বলেই আমি সবিস্ময়ে বইটি হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখেছি। আমাদের সময়ে জন্ম নেওয়া এই তুখোড় ঘোড়সওয়ারের পথরেখা আমি গভীরভাবে অনুসরণ করতে চাই।

পড়তে শুরু করে আমি এর ঘুম হারাম করা ভাষার তীক্ষ্ণ, গভীর, মনোবিশ্লেষী ও প্রাণবন্ত বর্ণনার ফাঁদে আটকা পড়ে যাই। আমার মতো শুধু বাংলা সাহিত্যের একজন আটপৌরে পাঠক এ বই পড়ার পর আপাদমস্তক কেঁপে উঠেছে। বাক্যের পর বাক্যে শিহরণ তুলে এগিয়ে চলে তাঁর বর্ণনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্রে রেখে জীবন-মৃত্যু-নিয়তি-ক্ষমতাবিষয়ক নানা রাজনৈতিক ও দার্শনিক অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে পৃথিবীর আদি-অন্ত ভ্রমণ শেষে পাঠককে একটা সম্পূর্ণের—বৃহতের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় এ উপন্যাস।

উপন্যাসের নায়ক একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ও লেখক। সে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ওপরে উপন্যাস লিখবে এবং কাফকা সমগ্রের দ্বিতীয় খণ্ডের অনুবাদের কাজ তার হাতে। এগুলোর মধ্যেই সে তার জীবনের অর্থ খুঁজতে থাকে, তবে যতবারই সে অর্থ খুঁজে পায়, ততবারই বদলে দেওয়া হয় সেই অর্থ। কারা বদলে দেয় সেটা, এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই মনে হয় পুরো আগস্ট আবছায়া

উপন্যাসের শুরুতেই কাফকার গল্প ‘দ্য গ্রেট ওয়াল অব চায়না’ থেকে এক নিষ্ঠুর ঘটনার উদ্ধৃতি মুহূর্তে পাঠককে টান দিয়ে নিয়ে যায় বাস্তবের এক ভয়ংকর পৃথিবীতে, যেখানে একদিকে সংঘটিত হচ্ছে রাষ্ট্রপতির হত্যা, অন্যদিকে তার রাজন্যবর্গ নির্বিকার। ১৫ আগস্টের ভয়াবহতা এ উপন্যাসের শেষের দিকে আসবে বলে প্রস্তুতি হিসেবে কি শুরুতেই লেখক মানবসভ্যতার পরতে পরতে বিদ্যমান থাকা সহিংসতা সম্পর্কে পাঠককে এভাবে সজাগ করে তুললেন?

এরপর আসে মুম্বাই থেকে পুনে যাওয়ার পথের পাম বিচ ক্রিক রোডের গা-ছমছমে বর্ণনা। ট্যাক্সিচালক আইয়ারের মুখে আমরা শুনি ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের গল্প। এর মধ্যে হঠাৎ হেলুসিনেশন হলো উপন্যাসের কথকের, পাম বিচ রোডের এক কফিশপের সামনে আকস্মিকভাবে হাজির এক তরুণ, তার হাতে দুই শ বছরের পুরোনো দীর্ঘ ব্যারেলের এক রিভলবার। এদিকে আমরা দেখলাম ডুয়েল লড়তে গিয়ে কবি আলেকজান্ডার পুশকিনের মৃত্যু। দেখলাম আরেক ডুয়েলে কবি মিখাইল লেরমন্তভের মৃত্যু। দেখলাম বন্ধুপত্নী লুনার বাবাকে কীভাবে তারই চা-বাগানের শ্রমিকরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করল।গোটা উপন্যাস এই সব খুন, রক্ত, ক্ষমতার প্রকাশ ও অস্ত্রের ঝনঝনানির মধ্য দিয়ে এগোতে থাকে। তাহলে মাসরুর কি বলতে চাইছেন পৃথিবীর কেন্দ্রে আছে যে ধ্বংসকামী শক্তি, তা–ই দর্পভরে পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে? উপন্যাসটি সবচেয়ে ভয়াবহ যে প্রশ্নের সামনে আমাকে দাঁড় করিয়েছে তা এটাই: পৃথিবীর চালিকা শক্তি কি ক্ষমতা ও বল? ভালোবাসা তাহলে কী?

মৃত্যু ও ক্ষমতার পাশাপাশি উপন্যাসের একটা বড় জায়গাজুড়ে রয়েছে প্রকৃতিচেতনা। মৃত্যু ও ক্ষমতার একটানা বর্ণনাকে ভারসাম্য দিতেই কি উপন্যাসে এমন আত্মাজুড়ানো প্রকৃতির বর্ণনা নিয়ে এলেন লেখক? এই সব কিছুর ভেতর দিয়ে উপন্যাসের নায়ক আবার ফুর্তি করছে দু-দুজন লিরিক্যাল নায়িকা মেহেরনাজ ও সুরভি ছেত্রীর সঙ্গে, যেমন করে থাকে রহস্য উপন্যাসের নায়কেরা। তবে এ ত্রিভুজ প্রেমের মধ্যে না আছে কোনো প্রথাগত নৈতিকতা, না কোনো সত্যিকারের প্রেম। এটাই কি তবে উত্তর–আধুনিক যুগের মানুষের ভালোবাসার রূপ? আগস্ট আবছায়া ঘটনার সঙ্গে ঘটনার, ইতিহাসের, দর্শনের, সাহিত্যের, স্মৃতির মিল খোঁজার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা একটা উচ্চতর বোধের জগৎ। ফর্মের দিক থেকে একে একটা কোলাজচিত্র বলেও মনে হতে পারে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনাটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ঘটনা হলেও মাসরুর যখন সময়ের অনেক ওপর থেকে ইতিহাসের বিস্তৃত পরিসরে ঘটনাগুলোকে দেখছেন, তখন মনে হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনাটি যেন মানব ইতিহাসের নানা ষড়যন্ত্র ও জোর করে ক্ষমতা দখলে ঠাসা চিরায়ত যুদ্ধক্ষেত্রে আরেকটি যুদ্ধ; যেন ১৯৭৫-এর আগস্টের পৃথিবী তার নিষ্ঠুরতার ইতিহাসের আরেকটি চক্রই পূরণ করেছিল সে রাতে।

আগস্ট এলেই সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার নির্মম ঘটনাটি উপন্যাসের নায়কের মধ্যে ভর করে, তাকে অস্থির করে তোলে। সে আবিষ্কার করে, মানব ইতিহাসে মোট ৯ কোটি ২৫ লাখ লোকের মৃত্যুর পেছনে আছে ১৫ আগস্ট তারিখটি। স্কটল্যান্ডের রাজা ম্যাকবেথের মৃত্যু থেকে শুরু করে জার্মান প্রেসিডেন্ট হিনডেনবার্গের নাৎসি বাহিনীকে আশীর্বাদ জানানোর তারিখও ওই ১৫ আগস্ট। ইতিহাসের একেকটি ঘটনার সঙ্গে থাকে অন্য কোনো ঘটনার গভীর সম্পর্ক। দেখা যায়, সেই একই সম্পর্ক আছে দুটি বিরাট ঘটনার মধ্যে—২০১৫ সালের ১৫ আগস্টে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ঘটা এক কাল্পনিক ও পৈশাচিক ঘটনার সঙ্গে যোগ পাওয়া যায় ১৯৭৫-এর আগস্টের, কারণ দুটিরই কুশীলব একই ষড়যন্ত্রকারী, মূলত আধিপত্যবাদী শক্তি আমেরিকা। নায়িকা মেহেরনাজকে সঙ্গে নিয়ে উপন্যাসের নায়ক সেই ঘটনার মূলে পৌঁছে আবিষ্কার করে যে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া নেপালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের সঙ্গেও যোগসূত্র আছে এ সবকিছুর। আমরা এভাবে অবাক হয়ে দেখি, ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে গেড়ে বসে এক ধ্বংসাত্মক শক্তি চালাচ্ছে সব এবং সমস্ত সৃষ্টির রহস্য যেন একটা বিরাট মহিষের মুখে গেজিয়ে ওঠা ফেনার চেয়ে বেশি কিছু নয়।

এর ভাষা প্রসঙ্গে বলি যে বাংলা ভাষার এক বিস্ময়কর উৎসারণ ঘটেছে এ উপন্যাসে এবং এ শুধু গল্প বলা নয়, গল্পের সূত্র ধরে ধরে পৃথিবীর সাহিত্য-ইতিহাস-দর্শনের পরতে পরতে ঘুরে বেড়ানো। পড়তে পড়তে কখনো পাঠক জীবনের অর্থহীনতার মধ্যেও ডুবে যেতে পারেন। কেননা, উপন্যাসের মূল সুর বিষাদের। প্রতিটি চরিত্রের পরিণতি এখানে বিষাদ দিয়েই পূর্ণ হয়ে ওঠে। সেটা কি এই জন্য যে মানুষের জীবন মূলত ট্র্যাজিক? মাসরুর বলেন, জীবন আসলে ছোট্ট একটা উজ্জ্বল উপস্থিতি, যার সামনেও অন্ধকার এবং পেছনেও অন্ধকার (জন্মের আগের ও মৃত্যুর পরের অন্ধকার অর্থে)। পরিত্রাণহীন এই অন্ধকারই তাঁর উপন্যাসের বোধ হয় প্রধান থিম।

বইটি পাঠককে ঘোরের মধ্যে রাখবে বহুদিন। পড়া শেষ করার পরেও এর চরিত্রেরা আপনার মনের নানা কোনায় ঘোরাফেরা করবে। এদের নাম আপনি জীবনে ভুলবেন না। কারণ, এ রকম কোনো চরিত্রের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে আগে আপনার কখনো দেখা হয়নি।

প্রথম উপন্যাসেই মাসরুর আরেফিন বাংলা সাহিত্যের এক নবীন মহানায়কের আসন নিয়ে নিয়েছেন।