যখন লিখি, তখন আর কিছু খেয়াল থাকে না

১৯৮১ সালে রিজিয়া রহমান। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
১৯৮১ সালে রিজিয়া রহমান। ছবি: নাসির আলী মামুন/ফটোজিয়াম
>রিজিয়া রহমানের এই সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল ২০১৬ সালে। দেশে তখন উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনাবশত ঘটছিল নানা ঘটনা। সেই সূত্রে এল তাঁর উপন্যাস আলবুর্জের বাজ–এর কথা, যেখানে অনেক আগেই তিনি লিখেছেন ধর্মীয় উন্মাদনার বিষয়ে, ওই উপন্যাসের প্রসঙ্গ টেনেই শুরু হলো আলাপন। পরে ধীরে ধীরে ধর্ম ও সংস্কৃতি ছুঁয়ে সে কথা ছড়িয়ে গেল তাঁর লেখার জগতেও। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বদরুন নাহার

বদরুন নাহার: আলবুর্জের বাজ যখন লেখেন, সেই সময়টার কথা মনে আছে?

রিজিয়া রহমান: লেখার প্রথম দিকে ঘরের কাজগুলো দেখতাম আর লিখতাম। শেষের দিকে বের হইনি ঘর থেকে। বুয়া আছে, রান্না করে। টেবিলে খাবার দিয়ে দিত, আমার ছেলে-বউ—ওরা নিজেরাই খেয়ে নিত। আমাকে ডেকে বিরক্ত করত না। হয়তো বিকেলে উঠলাম, ধুমধাম করে সন্ধ্যায় গোসল করে আবার লিখতে বসতাম। যখন লিখি, তখন আর কিছু খেয়াল থাকে না। এই উপন্যাসে তো আছে মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারস্যাপার। ওইখানে সবচেয়ে অসুবিধা হয়েছিল ইরাকের বাগদাদ শহরের বর্ণনা লিখতে। খুবই কষ্ট হয়েছিল। এ বই, সে বই, হেন-তেন কিছুতেই খুঁজে পাই না। খুব টেনশনে আছি। মনে মনে ভাবি বাগদাদ এ রকম হবে, ও রকম হবে। এরপর একদিন স্বপ্নে দেখি বাগদাদের রাস্তায় হাঁটছি! মানে বাগদাদ এত বেশি মাথায় ঢুকেছে যে আমি বাগদাদের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। তো পরের দিন উঠে কবি রুবী রহমানকে বললাম, ‘রুবী, আমি খুব বিপদে ছিলাম। বাগদাদ শহরকে কিছুতেই মাথায় আনতে পারছিলাম না। কালকে স্বপ্নে আমি বাগদাদ দেখেছি।’ আচ্ছা, বইটা পড়েছ কি? আলবুর্জের বাজ?

বদরুন: জি, পড়েছি।

রিজিয়া: আলবুর্জ পর্বতমালা যেটা, নর্দান মাজেন্দার। ওই জিনিসটা দেখার ইচ্ছা আমার। যেটাতে ওদের ঘাঁটি ছিল। কেমন এলাকাটা? ওখানে ঘরবাড়ি, গ্রাম আছে কি না? ইরানি টেলিভিশনে খুব ভালো ভালো সিনেমা দেখাত। আমি তা দেখতাম। হঠাৎ একদিন দেখি যে নর্দান ইরান। ইরানের যে পাহাড়ি এলাকা আছে, ওটা দেখাচ্ছে। আমি এটার জন্য পাগল হয়ে ছিলাম। আমার মাথার ভেতর কেবল ছিল ওই আলবুর্জ পবর্তমালা। বাগদাদ আর দামেস্ক। দামেস্ক আমি পেয়েছি ইবনে বতুতা ও মার্কো পোলোর বইয়ে। কিন্তু আলবুর্জ পর্বত পাচ্ছিলাম না। তো টিভিতে দেখলাম একদম রঙিন ছবি! উঁচু পর্বত যার ঢাল বেয়ে, নিচুতে গ্রিন ভ্যালি। দুম্বা চরছে, ছাগল চরছে, বাড়ি আছে।

বদরুন: আলবুর্জের বাজ–এ ভিন্ন মতবাদের কারণে যে দল গঠন, বিষয়টি কি শুধুই আপনার কল্পনা নাকি ইতিহাস থেকে নিয়েছিলেন?

রিজিয়া: অবশ্যই ইতিহাসের। ভিত্তিটা তো ইতিহাসের। আমার আবার বই পড়ার খুব নেশা। ইচ্ছা ছিল মার্কো পোলোর বাংলা বইটা না পড়ার, ইংরেজি বইটাই পড়তে চাই। ওটা আমার ছেলে কিনে এনেছিল। ওই বইটা পড়তে পড়তে এক জায়গায় দেখলাম মার্কো পোলো লিখেছেন, আলবুর্জ পর্বতমালায় একটা ঘাঁটি ছিল। আশপাশের গ্রাম থেকে ওই কম বয়সী—১২ থেকে ২০–এর মধ্যে যাদের বয়স—স্বাস্থ্যবান ওই ছেলেপেলেকে ধরে আনা হতো। ওদেরকে প্রশিক্ষণ দিত, হাশিশের নেশা ধরাত। এভাবে ওদের তৈরি করত।

বদরুন: সারা বিশ্বে এখন মুসলমানদের অনেকেই উগ্র পন্থার দিকে চলে যাচ্ছে...

রিজিয়া: ওটা ওসামা বিন লাদেনই শুরু করেছিল। এই উগ্রপন্থার আবির্ভাবও তো আরবে। ওসামা বিন লাদেনই এটা সামনে এনেছিল। পরে তা ছড়িয়েছে। আর এখন তো এটা একটা অদ্ভুত ফ্যান্টাসির মধ্যে চলে গেছে।

বদরুন: ধর্মীয় উগ্রবাদের যে সমস্যা, তা তো মুসলমানদের দিয়েই করানো হচ্ছে।

রিজিয়া: সারা পৃথিবীতে এখন যে জাতীয়তাবাদ বা উগ্র জাতীয়তাবাদ—এসব সেই হিটলারের সময় থেকে চলে আসছে। তারপর আন্তর্জাতিকতাবাদ এটা হলো মানুষের স্লোগান। সেটাও তো বহু বছর হয়ে গেল। এখন আবার সবাই পেছনের দিকে ফিরছে। হ্যাঁ, পৃথিবীটা আবার জাতীয়তাবাদের দিকে ফিরে যাচ্ছে। আমাদের বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র। আসলে আমরা ভাষাভিত্তিক জাতি। সেই হিসেবে আমরা নিজেদের বাঙালিরূপে ব্যাখ্যা করি। আসলে ভাষাই আমাদেরকে তৈরি করেছে। যেহেতু আমরা বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা, বিভিন্ন বর্ণের লোক মিলেই তো বাংলাদেশ।

বদরুন: আপনার বং থেকে বাংলায় এই বিষয়গুলো আছে। ইসলাম এখানে যে এল, রয়েছে সে প্রসঙ্গও।

রিজিয়া: আমার কথা হলো, নানা দেশে নানান জাতি এসেছে, নানান ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে। এখন এগুলো এত বছরে, হাজার বছরে মিশ্র সংস্কৃতি হয়ে গেছে।

বদরুন: আমরা কি সুনির্দিষ্ট কোনো সংস্কৃতিতে পৌঁছাতে পেরেছি বলে মনে করেন?

রিজিয়া: অবশ্যই পৌঁছেছি। ষাট দশক থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত। তবে এই সময়ে এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কৃতির যে ধরন–ধারণ, তা কিন্তু এবং আমদানীকৃত একটা সংস্কৃতি।

বদরুন: এখন আমরা পুরোপুরি বাঙালি সংস্কৃতিতে নেই।

রিজিয়া: সেটা হচ্ছে এই যে গ্লোবালাইজেশন বা মুক্তবাণিজ্য। এখানে আমদানি করা সংস্কৃতি, হাইব্রিড কালচার ইচ্ছে করে তৈরি করা হয়েছে, যাতে সারা পৃথিবী এক ভাষায় কথা বলে। ওয়ালটন র‌্যালি বলে গিয়েছিলেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখছি যে একদিন সারা পৃথিবী আমেরিকায় বসে ইংরেজি ভাষায় কথা বলবে।’ তখন আমেরিকা মাত্র ইংরেজদের দলছুট হয়েছে। ওরা প্রথম রেড ইন্ডিয়ানদের ভাষাকে গ্রাস করল।

এখন কথা হচ্ছে আমাদের মূল পরিচয় নিয়ে। স্পষ্ট করেই বলি, আমাদের আত্মপরিচয় আমরা ধরতে পারছিলাম না। তোমাকে একটা ঘটনা বলি, তাহলে বুঝতে পারবে। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত বার্ষিকীতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল একটা প্রবন্ধ পড়ার জন্য। বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা’। সেখানে আমি সচেতনভাবেই বলেছিলাম, আপনারা দেড় শ বা এক শ বছর ধরে যে রবীন্দ্রচর্চা করছেন, তা পরিপূর্ণভাবে একাডেমিক। তাঁর লেখা, তাঁর লেখার শৈলী, তাঁর কবিতা—এ রকম আরকি। কিন্তু বাংলাদেশের রবীন্দ্রচর্চা একেবারে অন্য রকম। তা এসেছেও ধীরে। এর কারণ হলো, ব্রিটিশ আমলে আমরা ছিলাম মুসলমান। তারপর হলো কি, সবাই বলা শুরু করল বাঙালি মুসলমান। পরে হলো পাকিস্তান। আমরা হয়ে গেলাম পূর্ব পাকিস্তানি। তখন আমরা লিখতাম, ‘উই আর ইস্ট পাকিস্তানি’। এরও পর ১৯৭১–এর যুদ্ধের পর আমরা বাঙালি হয়েছি। তো এত দেরিতে যখন বাঙালি হয়েছি, রবীন্দ্রচর্চা তো দেরিতেই শুরু হবে। আসলে আমাদের রবীন্দ্রনাথ হচ্ছে অন্য রকম। কারণ, আমরা অনেক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি।

বদরুন: আপনার বং থেকে বাংলা আলবুজের্র বার্জ—এই দুই উপন্যাসের স্থান ও কাল ভিন্ন হলেও দুটোতেই মুসলমানের ইতিহাস আছে। আবার শওকত আলীর উপন্যাস প্রদোষে প্রাকৃতজন–এ–ও ইতিহাস আছে। বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

রিজিয়া: না। বাংলাদেশে মুসলমানরা এভাবে আসেনি। এখানে ইসলাম ধর্মটাই এসেছে অন্যভাবে। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজি কিন্তু এসেছে পশ্চিম বাংলা পর্যন্ত, পূর্ববঙ্গে সে আসেনি। তার আগে কিছু পাঠান এসেছিল, দক্ষিণ ভারত থেকে আর কিছু মোঙ্গল এসেছিল, কিন্তু থাকেনি। শায়েস্তা খান এসে দলবল নিয়ে চলে গেছে। তখন যত সুবাদারই এসেছে, তারা থাকেনি। এই দেশকে তারা পছন্দ করেনি, ভালোও বাসেনি। তারা প্রচুর আয়-ব্যয়, টাকাপয়সা কামাই করে চলে গেছে।

বদরুন: আপনার বং থেকে বাংলা ও শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন—এই দুই উপন্যাসের বিষয়বস্তু ইতিহাস। দুটিতেই কাছাকাছি সময়ের একটা আঁচ আমরা পাই...।

রিজিয়া: না, আমার উপন্যাসের মধ্যে অনেক অধ্যায় আছে। প্রথম যে মানবগোষ্ঠী, সেটাকে আমি নিয়েছি। তারপর আমি একটা পিরিয়ড নিয়েছি, কিন্তু প্রদোষে প্রাকৃতজন–এ শওকত আলী নিয়েছেন চর্যাপদের সময়টা। যে চর্যাপদের সময়টা আমার বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়ে এসেছে, উনি সেটা নিয়েই তাঁর উপন্যাস লিখেছেন। ওটা শশাঙ্কর সময়। শশাঙ্কর পরে বল্লাল সেন—ওই সময়। উনি আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি তো বং থেকে বাংলা লিখেছেন, আমি লিখতে চাচ্ছি চর্যাপদের সময় নিয়ে। চর্যার সময় নিয়ে সেলিনাও (সেলিনা হোসেন) লিখেছে।

বদরুন: নীল ময়ূরের যৌবন।

রিজিয়া: হ্যাঁ। তো, শওকত আলী আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি সংলাপগুলো কীভাবে দিয়েছেন? আমি তাঁকে বললাম, ওই ভাষা তো আমি অত ভালো জানি না। আর ওই বাংলায় লিখলে পাঠক একটুও পড়বে না—এসব ভেবে আমি চলতি বাংলা ভাষায় সংলাপ লিখেছি। উনি বললেন, ভাষা নিয়ে আমি খুব সমস্যায় ছিলাম। এরপর আমি বললাম, আপনি লিখুন।

 বদরুন: আঞ্চলিক ভাষায় লেখার প্রসঙ্গে অনেকেই বলেন, এতে পাঠকের পড়তে সমস্যা হয়। কিন্তু চলতি বাংলায় লেখা হয়েও যদি কিছু কিছু সংলাপে সংমিশ্রণ ঘটে, তাহলে কী ঘটে?

রিজিয়া: আমি যেটা করেছি, আবহাওয়াটা আনার জন্য ওটা ব্যবহার করেছি। যেমন ধরো, আলবুর্জের বাজ। এখানে বহু ফারসি, তুর্কি ও আরবি শব্দ আমি ব্যবহার করেছি। যেগুলো জানি আর যেগুলো আমাদের জানা নেই, এমন কিছু তুর্কি শব্দ ফুটনোট দিয়ে তারপর দিয়েছি। তারপর শায়েস্তা খানের সময়কে যেখানে ব্যবহার করেছি, সেখানে অনেক ফারসি শব্দ দিয়েছি। আলবুজের্র বাজ–এতুকি, ফারসি আর আরবি শব্দ বেশি ব্যবহার করেছি।

বদরুন: আপনার কি ভাষাগুলো আগে থেকে রপ্ত ছিল? এই ধরেন, তুর্কি ভাষা?

রিজিয়া: না। তুর্কি ভাষা আমি জানি না। কিন্তু এসব খুঁজলেই অর্থ পাওয়া যায়। বাংলা ভাষার মধ্যেও অনেক শব্দ মিশে আছে। তাই সমস্যা হয়নি।