যুদ্ধের ময়দানে রচিত কবিতা

আজ অ্যালেন গিন্সবার্গের জন্মদিন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে যশোর রোডের শরণার্থীশিবিরগুলো ঘুরে দেখেছিলেন বিট প্রজন্মের খ্যাতিমান এই কবি। এরপর আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের সমর্থনে তিনি লিখলেন অনন্য এক কবিতা—‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। প্রকাশমাত্রই সারা বিশ্বে তোলপাড় তুলল কবিতাটি। বহুশ্রুত সেই কবিতা নিয়ে ২০১৯ সালে এই লেখাটি লিখেছিলেন কবি ও সাংবাদিক সাজ্জাদ শরিফ। অ্যালেন গিন্সবার্গের জন্মদিন উপলক্ষে সেই লেখাটি আবার প্রকাশ করা হলো।

যশোর রোডের বনগাঁ-বয়ড়া সীমান্তের একটি শরণার্থীশিবিরে কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
যশোর রোডের বনগাঁ-বয়ড়া সীমান্তের একটি শরণার্থীশিবিরে কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
ছবি: জন গিয়োর্নো

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আর কিছুদিন পরই তার চূড়ান্ত পর্বে ঢুকবে। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে বাঙালিদের ওপর সেই যে গণহত্যার সূচনা করেছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, তা আরও ব্যাপকতর স্তরে পৌঁছেছে। সারা দেশে নির্বিচারে মানুষ মারছে তারা। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই তাই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে যেখানে পারছে মানুষ পালাচ্ছে। নর-নারী, হিন্দু-মুসলমান, ধনী-গরিব—যে সুযোগ পাচ্ছে, সে-ই। সীমান্ত পেরিয়ে অসংখ্য মানুষ পিলপিল করে ঢুকছে ভারতে। ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি নাগাদ এ সংখ্যা ৯৯ লাখ ছুঁইছুঁই করবে। তবে এখন চলছে সেপ্টেম্বর।

বাংলাদেশের বেনাপোল প্রান্ত দিয়ে যে রাস্তাটা ভারতে ঢুকে গেছে, তার নাম যশোর রোড। কলকাতার দিকে ছুটে যাওয়া দীর্ঘ এই রাস্তায় মানুষের মাথা মানুষে খাচ্ছে। রাস্তার দুপাশ ঘরবাড়িতে তখনো ততটা ঘিঞ্জি নয়। মাঝেমধ্যে যেসব খেতি জমি আর ফাঁকা মাঠ, সব সয়লাব হয়ে আছে মানুষে। মাইলের পর মাইল তাঁবু খাটিয়ে থাকা মানুষ, খোলা মাঠে নিরাশ্রয় মানুষ, মুমূর্ষু স্বজনকে পিঠের ওপর বয়ে কুঁজো হয়ে হাঁটতে থাকা মানুষ। আর পুরো দৃশ্যপট ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বন্যা। বন্যার হাত ধরে এসেছে তার চিরন্তন আততায়ী সঙ্গী কলেরাও।

এই মৃত্যুময় দৃশ্যপটের মধ্যে বন্যার পানি ভেঙে ঢুকে পড়েছেন এক সাহেব। সাহেব আসলে তিনি নন। একই সঙ্গে ক্রুদ্ধ ও মমতাময় যুক্তরাষ্ট্রের এক কবি। তিনি এসেছেন বনগাঁ-বয়ড়া সীমান্তের শরণার্থীশিবিরে। তাঁবুতে তাঁবুতে ঘুরছেন। কথা বলছেন শরণার্থীদের সঙ্গে। দেখছেন, খাদ্যের অভাবে কীভাবে ধুঁকছে লাখ লাখ মানুষ, মরণাপন্ন মা–বাবার জন্য ওষুধ না পেয়ে কীভাবে মাথা কুটছে সন্তান, বমি করতে করতে কীভাবে মরছে শিশুরা। নিউইয়র্কে ফিরে গিয়ে নভেম্বরের ১৪ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত এ অভিজ্ঞতা একটি কবিতায় রূপ দেবেন এই কবি। ভিলেজ ভয়েস ও নিউইয়র্ক টাইমস-এ ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে বেরোবে সেই কবিতা। হুলুস্থুল পড়ে যাবে দুনিয়াজুড়ে।

অ্যালেন গিন্সবার্গ (১৯২৬—৯৭) নামের সেই কবিটি তত দিনে একাধারে দারুণ নন্দিত ও নিন্দিত। তাঁর জীবনযাপন প্রথাবিরোধী ও অকপট। সে সময়ে তিনি খোলামেলাভাবে ঘুরছেন পিটার অর্লভ্​স্কি নামে তরুণ এক কবিকে নিয়ে। সবার সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন নিজের স্ত্রী হিসেবে। সেই অকপট জীবনের নানা অভিজ্ঞতা উপচে পড়েছে তাঁর খোলামেলা কবিতার মধ্যেও। যুক্তরাষ্ট্রের সব রাজ্যে সমকামী আইনও তখন অসম্ভব কড়া। কিন্তু ওসবের থোড়াই তোয়াক্কা করেন তিনি। ‘হাউল’-এ নিজের এ অভিজ্ঞতার কথা খোলাখুলি লেখায় পুলিশ সে কবিতা বাজেয়াপ্ত করেছে। উইলিয়াম ব্লেকের কবিতা পড়ে চর্মচক্ষে ‘ঈশ্বর-দর্শন’ তো হয়ে গেছে তারও বহু বছর আগে। এ সময়ে তাঁকে তুমুল তর্কের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে বিট সাহিত্য আন্দোলন, যুদ্ধবাজ মার্কিন প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা, কিউবার পক্ষ সমর্থন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা। সেই বিতর্কের ঘূর্ণিবাত্যার মধ্যেই তিনি এসেছেন কলকাতায়। অ্যালেন গিন্সবার্গ এস্টেটের ওয়েবসাইট বলছে, ‘অনামা এক লোকের অনুদানের টিকিটে অ্যালেন ভারত, পশ্চিমবঙ্গ এবং পরে বন্যা ও দুর্ভিক্ষে প্রায় ৭০ লাখ লোকের উন্মূল দশা দেখতে যশোর রোডের শরণার্থীশিবিরে ঘুরতে যান।’

বাঁচার আশায় যশোর রোডের শরণার্থীশিবিরের দিকে মানুষের ঢল, ১৯৭১।
বাঁচার আশায় যশোর রোডের শরণার্থীশিবিরের দিকে মানুষের ঢল, ১৯৭১।
ছবি: সংগৃহীত

না, একেবারেই অনামা নন। অ্যালেন গিন্সবার্গকে কলকাতা যাওয়ার টাকা দিয়েছিলেন ব্রিটেনের জনপ্রিয় রক ব্যান্ড রোলিং স্টোনসের কিথ রিচার্ডস। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও প্রশাসন বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। কিন্তু সেখানকার সাধারণ মানুষের মধ্যে সমর্থনের জোয়ার জেগেছিল বাঙালিদের প্রতি। আর সেটি সম্ভবপর করে তুলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের কবি-শিল্পী-অধিকারকর্মীরা। কিথ রিচার্ডসের প্রত্যাশা ছিল, কলকাতায় গিয়ে অ্যালেন গিন্সবার্গ ‘গৃহযুদ্ধের ছোবল থেকে পালানো বাংলাদেশের কোটি মানুষের মর্মান্তিক দুর্দশার ছবি তুলে ধরবেন।’

সেই যাত্রায় গিন্সবার্গের সফরসঙ্গী ছিলেন তিনজন। একজনের নাম কবিতাটির মধ্যেই আছে—‘সুনীল পোয়েট’, মানে পশ্চিমবঙ্গের কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাকি দুজন কারা? সুনীল লিখেছেন, ‘একজন বিদেশি পর্যটক ও কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের একটি সুদর্শন বুদ্ধিমান যুবক—এঁদের দুজনেরই নাম মনে করতে পারছি না।’ (‘একটি অসাধারণ কবিতা’, কবিতা কার জন্য?) গিন্সবার্গের কবিতাসমগ্রে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার পাদটীকা থেকে জানা যাচ্ছে, সেই বিদেশি পর্যটক একজন মার্কিন বৌদ্ধ ছাত্র, কবি জন গিয়োর্নো। শরণার্থীশিবিরে গিয়োর্নো গিন্সবার্গের ছবিও তুলেছিলেন। তেমন একটি ছবি গিন্সবার্গের ওয়েবসাইটে যত্ন করে রাখা আছে। বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তাটির অবশ্য কোনো পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়নি।

শরণার্থীশিবিরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কোনোক্রমেই মধুর ছিল না। সুনীল লিখেছেন, ‘আমরা যখন যাই, তখনো সীমান্তে বিদেশিদের গমনাগমন নিষিদ্ধ হয়নি বটে, কিন্তু তখন ওখানে বন্যার দাপট চলছে। বনগাঁ শহরের মধ্যেই বড় রাস্তায় একহাঁটু জল, বয়ড়ার রাস্তায় নৌকা চলছে—শরণার্থীশিবিরের মধ্যেও জলস্রোত। তাতে অবশ্য ওই বেপরোয়া কবি নিরস্ত হননি। ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে আমরা জলের মধ্যেই হাঁটতে শুরু করি—প্রথমে পাৎলুন গুটিয়ে, তারপর মায়া ত্যাগ করে সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরেছিলাম, কখনো কখনো নৌকায় কিছু পথ ঘুরেছি—ডাব ও সিগারেট ছাড়া আর কোনো খাদ্যপানীয় ছিল না।’ বাংলাদেশি শরণার্থীদের যে দুর্ভোগ গিন্সবার্গ দেখতে পান, তার বিশদ বিবরণ কবিতাটিতে উঠে আসে।

ওই সময়টাতে গিন্সবার্গ কবিতাও লিখছেন এক অদ্ভুত উপায়ে। যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতি সম্পর্কে সোচ্চার প্রথাবিরোধী এই কবি তখন চষে বেড়াচ্ছেন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। আর যা কিছু দেখছেন, টেপরেকর্ডারে ধরে রাখছেন সব। বিট সাহিত্য গবেষক টনি ট্রিজিলিও জানিয়েছেন, ‘কবির তাৎক্ষণিক ভাবনা বলা হয়ে যাচ্ছিল টেপরেকর্ডারে। একই সঙ্গে রেকর্ড হয়ে যাচ্ছিল চারপাশের আওয়াজ আর গাড়ির রেডিওতে চলতে থাকা খবর।’ (এনসাইক্লোপিডিয়া অব বিট লিটারেচার, সম্পাদনা: কুর্ট হেমার) সুনীলও লিখেছেন একই কথা, ‘অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে একটা টেপরেকর্ডার ছিল, সর্বক্ষণ খোলা, যেকোনো ব্যাপারে তাঁর প্রতিক্রিয়া টেপরেকর্ডারকে শোনাচ্ছিলেন, কখনো আমরা সবাই মিলে যা আলোচনা করেছি, তা-ও টেপ-নিবদ্ধ হয়।’

যশোর রোডে শরণার্থীরা, ১৯৭১।
যশোর রোডে শরণার্থীরা, ১৯৭১।
ছবি: সংগৃহীত

কবিতাটির বক্তব্য ছিল সরাসরি। টনি লিখেছেন, ‘গিন্সবার্গ শরণার্থীদের খাদ্যাভাবের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে এই প্রশ্নও তুলেছেন, ভিয়েতনামে বিরামহীন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য মার্কিন তহবিলের টাকা ওই লাখ লাখ নিরাশ্রয় শিশুকে সাহায্যের জন্য কেন ব্যয় করা হবে না।’ কবিতাটিতে জায়গা করে নিয়েছিল শরণার্থীদের আরও নানা দুর্দশার ছবি, অজানার পথে লাখো নিরাশ্রয় লোকের দেশত্যাগের মর্মন্তুদ বর্ণনা, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামে মার্কিন যুদ্ধনীতির কঠোর সমালোচনা।

‘আ রিভাইভ্যাল অব পোয়েট্রি অ্যাজ সং: অ্যালেন গিন্সবার্গ, রক অ্যান্ড রোল, অ্যান্ড দ্য রিটার্ন টু দ্য বার্ডিক ট্র্যাডিশন’ শিরোনামের এক লেখায় গিন্সবার্গের আরেক গবেষক কেটি এম স্টিফেনসন বলছেন, ‘কলকাতায় যে মানুষদের গিন্সবার্গ দেখতে পেয়েছিলেন, “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড” কবিতায় তিনি তাদের কণ্ঠস্বর দিতে চাইলেন। কবিতাটির মধ্য দিয়ে পৌঁছুতে চাইলেন বৃহত্তর পরিসরে ছড়ানো যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপ্ত জনতার কাছে। তাদের কাছে নগ্ন করে দিতে চাইলেন এই রাষ্ট্রের কপটতা: ন্যূনতম প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত রেখে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষকে যে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে, অথচ ভিয়েতনামে খরচ করছে যুদ্ধের পেছনে।’

কলকাতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে কী করলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ? কেটি স্টিফেনসন দিচ্ছেন এক মজার তথ্য: ‘১৯৭১ সালে কলকাতা থেকে ফিরে এসে গিন্সবার্গ যাঁর সঙ্গে দেখা করতে উন্মুখ হয়ে উঠলেন, তিনি এজরা পাউন্ড নন, জন লেনন। তিনি তড়িঘড়ি করে সাইরাক্যুসে ছুটলেন। ওখানে ছিল জন লেনন আর ইয়োকো ওনোর অ্যাপার্টমেন্ট। জন লেননকে “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড” পড়ে শোনালেন। “সংগীতশিল্পীটির দুচোখ বেয়ে যখন অশ্রু গড়াতে শুরু করল”, তিনি অনুভব করলেন কবিতাটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে।’

একটি কবিতা লিখেই অ্যালেন গিন্সবার্গ বসে রইলেন না। মার্কিন চেতনার গভীরে বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশার কথা কী করে পৌঁছানো যায়, এ দুর্দশা দূর করতে কীভাবে মার্কিন জনতাকে সক্রিয় করে তোলা যায়, সে ভাবনায় তিনি অস্থির হয়ে রইলেন। একটি কবিতা পাঠের আয়োজন করলেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন প্রতিপক্ষ ও প্রবলভাবে বিবদমান। নিউইয়র্কের সেই কবিতার আসরে যুক্তরাষ্টের কবি গিন্সবার্গ আর রুশ কবি আন্দ্রেই ভজনেসেন্​স্কি হয়ে উঠলেন মধ্যমণি। ইয়েভগেনি ইয়েতুশেঙ্কো আর আন্দ্রেই ভজনেসেন্​স্কি তত দিনে সোভিয়েত ইউনিয়নে এক জোড়া কিংবদন্তিতুল্য নাম হয়ে উঠেছেন। কবিতার নতুন ভাষায়, যৌবনের দাপটে, ব্যঙ্গ আর পরিহাসে তরুণসমাজকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁরা। একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে গিন্সবার্গ আর ভজনেসেন্​স্কি বিশ্বকে বার্তা দিলেন, রাষ্ট্র যা-ই ভাবুক বা করুক, কবিরা আছেন বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে। সব সীমান্তের বাধা পেরিয়ে কবিরা আছেন পৃথিবীর সব নিপীড়িত মানুষের হাত ধরে।

কবিতার সেই আসরে গিন্সবার্গ তাঁর সদ্য রচিত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর ইন যশোর রোড’ পড়ে শোনালেন। সেখানে যোগ দিয়েছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গের বিট দলের কবি-বন্ধুরাও—গ্রেগরি করসো, অ্যান ওয়াল্ডম্যান, পিটার অর্লভ্​স্কি, কেনেথ কচ, এড স্যান্ডার্স, মাইকেল ব্রাউনস্টাইন, ডিক গ্যালাপ আর রন প্যাজেট। ২০ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় সেন্ট জর্জ’স এপিস্কোপাল চার্চে বসল এ আসর। ‘অ্যামেরিকানস ফর বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন এর আয়োজন করল। তারা জানাল, এ আয়োজনের উদ্দেশ্য ‘বাংলাদেশ সম্পর্কে সবাইকে জানানো এবং বাংলাদেশের জন্য একটি ত্রাণ তহবিল গড়ে তোলা।’

একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হলো ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। প্রকাশের পরপরই ব্যাপক সাড়া। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কবিদের মধ্যেও সে ঢেউ এসে লাগল। কবি বেলাল চৌধুরী এই তথ্য দিয়েছেন যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই ভারতে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি ব্যবহার করে একটি পোস্টার বের করা হয়। পোস্টারটির দামের জায়গায় ইংরেজিতে লেখা ছিল, ‘বাংলাদেশের শরণার্থীদের পুনর্বাসনে অংশ নিতে স্বেচ্ছায় যতটা সম্ভব সহযোগিতা করুন।’ এর বিক্রি থেকে পাওয়া টাকা শরণার্থীদের তহবিলে জমা পড়ে। (‘গীনসবার্গের সঙ্গে’, নির্মলেন্দু গুণ)

গিন্সবার্গ নিজেও কবিতাটির প্রেমে পড়েছিলেন। এই কবিতার প্রতি তাঁর দুর্বলতা কখনোই শেষ হয়ে যায়নি। নানা কবিতার আসরে এটি তিনি পড়ে শুনিয়েছেন। এ কবিতায় পরে সুর দেওয়া হয়। কবিতাপাঠের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্রসহযোগে প্রায়ই এটি তিনি পরিবেশন করেছেন। এমনকি কোনো কোনো আসরে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ গেয়ে শোনানোর পর্বে গিন্সবার্গের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন গান লিখে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী গায়ক বব ডিলান। এটি বাংলায় অনুবাদ করেও গানে বেঁধেছিলেন মৌসুমী ভৌমিক, তারেক মাসুদ পরিচালিত ছবি মুক্তির গান-এর জন্য। তবে সে অনুবাদ পূর্ণাঙ্গ ছিল না; ছিল ছবির জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই। বাংলায় কবিতাটির প্রথম ও তৃপ্তিকর অনুবাদটি করেছিলেন অবশ্য অকালপ্রয়াত কবি-লেখক খান মোহাম্মদ ফারাবী। কেন জানি না, তিনিও তাঁর অনুবাদে মূল কবিতার কয়েকটি চরণ ছেঁটে দিয়েছিলেন।

কবিতাটিতে চিরকালের জন্য স্থির হয়ে আছে একাত্তরের হাহাকারভরা ছবি: ‘হাঁটছে পাঁকে লক্ষ পিতার কন্যারা/অবোধ শিশু ভাসিয়ে নিল বন্যারা/লক্ষ মেয়ে করছে বমন আর্তনাদ/লক্ষ পরিবারের আশা চূর্ণসাধ।’ (অনুবাদ: খান মোহাম্মদ ফারাবী)