সাধুসঙ্গ ও তুষারমানব

নেপালের হ্রদ শহর পোখারার গ্রামের সেই দোতলা চায়ের দোকান। ছবি: লেখক
নেপালের হ্রদ শহর পোখারার গ্রামের সেই দোতলা চায়ের দোকান। ছবি: লেখক

বোম বাহাদুরের মেজাজ আজ তোফা আছে। তিনি আমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ‘রাম রছা রাম রছা বাবুজি’ বলে আনন্দ প্রকাশ করেন। নেপালের হ্রদ শহর পোখারাতে এই কয়েক দিন হলো ট্যুর গাইড হিসেবে আমার সঙ্গেই আছেন তিনি। আমাকে হ্রদ, পাহাড় ও মন্দির দেখাচ্ছেন। তাঁর খাই কম, অল্প কিছু পয়সা, সস্তা রেস্তোরাঁয় ডাল-ভাত-তরকারি ও আচার-পাঁপড়েই তিনি সন্তুষ্ট। তিনি অজ্ঞাত এক সাধুজির কাছ থেকে গ্রহ-নক্ষত্র বিচড়িয়ে গতকাল একটি তথ্য এনে দিয়েছেন, তাতে আমি বিপুলভাবে উপকৃত হয়েছি এবং শোকর গোজার হিসেবে তাঁকে খরিদ করে দিয়েছি রক্সি বলে পরিচিত এক বোতল কড়া ধাঁচের পানীয়।

কাঠমান্ডু উপত্যকার ২০০ কিলোমিটার পশ্চিমের হ্রদ-শহর পোখারা থেকে শুরুয়াত হয় ট্রেকার-প্রিয় অন্নপূর্ণা সার্কিটের। কোনো কোনো পর্যটক এখান থেকেই জিন্দেগিতে পয়লাবারের মতো দর্শন করেন হিমালয়ের তুষারশুভ্র বিস্তার। আবহাওয়া অপরিচ্ছন্ন থাকলে দেবালয় হিমাচল দর্শন দানে বিরত থাকেন। পোখারা থেকে আমার ট্র্যাকে হিট করার সময় হয়ে এসেছে, দু-এক দিনের মধ্যে এ হ্রদ সংলগ্ন শহরটি ছেড়ে অন্য দিকে মেলা দেব, কিন্তু এখনো হিমালয় চাক্ষুষ করতে পারিনি। বিষয়টি জানতে পেরে বোম বাহাদুর এক সাধুর সঙ্গে বাতচিত করে গেল রাতে আমাকে হিমালয় দর্শনের সঠিক লগ্ন সম্পর্কে অবহিত করেন। সে মোতাবেক আজ প্রভাতে সরোবরের পাড়ে গিয়ে দাঁড়াই। অজানা সাধুজি যেমন আমার শ্রদ্ধা অর্জন করেন, তেমনি হিমাচল তার প্রবল উপস্থিতিতে দিকচক্রবালে শুভ্রতা ছড়িয়ে আমাকে সম্মোহিত করে। তাতে প্রীত হয়ে আমি বোম বাহাদুরের মারফত সাধুজির আবগারি রসদের জন্য যৎসামান্য মঞ্জুরি দিতে সম্মত হয়েছি।

হাঁটতে হাঁটতে বোম বাহাদুর পথপার্শ্বের একটি টং দোকানের জানালায় দাঁড়ান খৈনি কিনতে। আমিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর দিনযাপন সম্পর্কে ভাবি। পর্যটকদের সহায়তা করে তাঁর খানিক রোজগার হয়েছে, আগামীকাল তিনি বাড়ি ফিরে যাবেন সপ্তাহ দু-একের জন্য। বাড়িতে তাঁর নাতি-নাতনির সংখ্যা সাত। একটু আগে বাজারের দোকান থেকে তাদের জন্য প্লাস্টিকের খেলনা কিনে দিয়েছি। বোম বাহাদুর কিছুক্ষণ পর পর বোঁচকা থেকে ঝুনঝুনি বের করে তা বাজিয়ে দেখছেন, দোকানি আবার জিনিসটা ভেজাল দেয়নি তো? ফার্মেসি থেকে তিনি তাঁর বাতে পঙ্গু বৃদ্ধা শ্রীমতী বা পত্নীর জন্য কিনেছেন পেইনকিলার ট্যাবলেট, আর মুদির দোকান থেকেও নিয়েছেন চিনি, সুজি ও লাক্স সাবান।

হ্রদপাড়ে হিমালয়ের তুষারশুভ্র বিস্তার। ছবি: লেখক
হ্রদপাড়ে হিমালয়ের তুষারশুভ্র বিস্তার। ছবি: লেখক

পোখারা থেকে নানা পাহাড়ের উপত্যকা ও গিরিপথ দিয়ে তাঁকে হাঁটতে হবে চার কিংবা পাঁচ দিন। গাঁয়ে তাঁর কুটিরটি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এক নুনির কাছাকাছি। ঘরে খাটিয়াসহ এক্সট্রা একটি কামরাও আছে। তিনি বারবার আমাকে বলছেন, ‘বাঙ্গাল কা বাবু, পয়দলমে চলো...চলো না হামারা সাথ বাবুজি। পথে জানাশোনা গোর্খা-গোরংদের বাড়িতে রাত কাটাব। তোমার অসুবিধা কিছু হবে না। আমাদের ঘরে দুই-তিন দিন জিড়াতেও পারবে। শ্রীমতী ভঁইষের দুধ দিয়ে উমদা-ছে-উমদা দধি তাইয়ার করেন। রাত-বিরাতে নুনিতে চাটতে আসা জংলি জন্তুও দেখতে পাবে। তারপর তুমি চাইলে আমার ছেলেকে নিয়ে যাবে হিমালয়ের তুষারঢাকা অঞ্চলে। ওখান থেকে দেখতে পাবে সাগরমাথা বা এভারেস্ট। আর তোমার অদৃষ্ট ভালো হলে, চাই কি বাবুজি ইয়েতি বা তুষারমানবের পদছাপের তসবির ভিও খিঁচতে পারবে।’

বোম বাহাদুর ঝুনঝুনি বাজিয়ে জোর দিয়ে তুষারমানবের অস্তিত্বের কথা বলেন। তারা হেঁটে বেড়ায় গহিন বরফের বনানীতে। পোখারাতে আমার বিস্তর মাটির মানুষজনদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তাদের সঙ্গে আমি একত্রে ডাল-ভাত-তরকারি খেয়েছি, খোশগল্পও হয়েছে যথেষ্ট। এতেই আমি সন্তুষ্ট। তুষারমানবদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার বাসনা আমার একেবারেই নেই। তাদের পদছাপ চাক্ষুষ করে পদধূলি নেওয়ার কোনো জরুরতও দেখি না।

বোম বাহাদুর সহজে বিষয়টি ছাড়ান দেন না। তিনি বলেন, ‘বাবুজি, এখনই তোমাকে সাধু মহারাজের কাছে নিয়ে যাচ্ছি, তাঁর বস্তনিতে মজুদ আছে প্রয়াত এক ইয়েতির পাঁচ আঙুলের পাঞ্জা। অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত এ হস্ত দর্শনে পুণ্যলাভ অশেষ। বিষয়টি শাস্ত্র-পুরাণে আছে।’ শাস্ত্র তর্পণের কোনো আগ্রহ আমার না থাকলেও সাধুসঙ্গে আমি অনিচ্ছা প্রকাশ করি না।

যোগ বিভূতিমাখা সাধুজি
যোগ বিভূতিমাখা সাধুজি

বোম বাহাদুর অতঃপর আমাকে বেবিট্যাক্সিতে চড়িয়ে, পাহাড়ি পথের পায়ে চলা ট্রেইলে বেশ খানিকটা হাঁটিয়ে নিয়ে আসেন এক জলপ্রপাতের কাছে। জায়গাটিতে ঝুটঝামেলা কিছু নেই। সুনসান নীরবতা কেটে বয়ে যাচ্ছে স্রোতস্বিনীর ধারা জল। আমরা তার পাশ দিয়ে হাঁটি। সর্পিল একটি বাঁক অতিক্রম করে, লালচে-হলুদাভ মাটির সংকীর্ণ চরে জুতার ছাপ ফেলে, কয়েকটি বড় বড় পাথর পাড়ি দিতেই চোখের সামনে চলে আসে উছলানো জলের প্রপাত। বোম বাহাদুর চারদিকে তাকিয়ে কিসের যেন তালাশ করেন। প্রপাতের ওপর সূর্যালোক মেখে উড়ছে একঝাঁক ফড়িং। ডোবা পাথরে বহতা জলের চলিষ্ণু শব্দে ভেসে আসে স্বপ্নলোকের গুঞ্জরণ।

একটি বড়সড় পাথরের আড়াল থেকে বোম বাহাদুরের হাঁক শোনা যায়। তিনি বলেন, ‘রাম রছা বাবুজি, আজ আপ কা অদৃষ্ট বহুত আচ্ছা হ্যায়। সাধু মহারাজ কা দর্শন মিল গায়া।’ আমি খানিক কাদাজল অতিক্রম করে তাঁর কাছে আসতেই দেখি, অন্য একটি প্রকাণ্ড পাথরের ওপর পদ্মাসনে বসে ধ্যানস্থ রয়েছেন সাধুজি। বয়স তাঁর খুব বেশি নয়, তবে শ্মশ্রুর বিপুল জটাজুটে শ্রীমুখখানা রহস্যময়। তাঁর অননে যোগ বিভূতির ওপর আঁকা বাসন্তী নকশা এবং কপালে লেপা লোহিত সিঁদুরের প্রলেপ। আমাদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে আরও কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ থাকেন তিনি। তারপর চোখ খুলে বলেন, ‘বাঙ্গাল কা বেটা, তোমকো আভি সবকুছ অবগত করায় গা, আও, চল হামারা সাথ।’

সাধুরাজের সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে তাঁর ছাগলের লোমে তৈরি বস্তনিটির দিকে আড়চোখে তাকাই আমি। ওখানেই তো ইয়েতি বা তুষারমানবের হাত থাকার কথা। বেশি দূর হাঁটতে হয় না আমাদের। তিনি আমাদের নিয়ে আসেন এক কনস্ট্রাকশন সাইটের কাছে। ওখানে রাজমিস্ত্রি ও জোগালিরা ইট-কংক্রিট নিয়ে কাজ করছেন। তাঁরা সবাই প্রণাম জানায় সাধুরাজকে। সাধুজি আমাদের নিয়ে নেমে যান ফাউন্ডেশনের জন্য খোঁড়া হয়েছে এমন একটি বৃহৎ গর্তে। গর্ত খুঁড়তে গিয়ে শ্রমিকেরা সন্ধান পেয়েছেন এক সুড়ঙ্গের। একজন জোগালি আমাদের দেন পেনসিল-টর্চলাইট। সুড়ঙ্গের এবড়োখেবড়ো পাথরখণ্ডে পা দিয়ে আমরা নেমে আসি আরও কয়েক ধাপ নিচে। টর্চের আলোয় সাধুজি আমাদের দেখান একটি মন্দিরের দেয়াল। শত বছর আগের এই মন্দির হয়তো ভূমিকম্পে সেঁধিয়ে গিয়েছিল মাটির নিচে! কাদামাটি পরিষ্কার করে মজুরেরা এখানে আবার প্রতিষ্ঠা করেছেন চাপ চাপ মাটির নিচে প্রাপ্ত শিবলিঙ্গের। তাতে পূজারিরা আজকাল দুধ ঢালছেন, মাখাচ্ছেন প্রচুর পরিমাণে সিঁদুর।

উছলানো জলের প্রপাত
উছলানো জলের প্রপাত

সুড়ঙ্গের মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে সাধুজি আমাদের হাঁটিয়ে নিয়ে আসেন কাছাকাছি একটি গ্রামে। ছন-বাঁশ-বেতে তৈরি দোতলা বাড়ির ওপরতলায় চায়ের দোকান। ওখানে সোলার প্যানেল দিয়ে একটি রেফ্রিজারেটর চালানো হচ্ছে দেখে তাজ্জব হই আমি। এক কোণে গিয়ে মেঝেতে লোম ঝরা বাঘছালের আসন পেতে বসেন সাধুজি। দোকানি আলমারি খুলে আমাদের দেখান সুড়ঙ্গে প্রাপ্ত কষ্টিপাথরের হরপার্বতীর যুগল মূর্তি। সাধুরাজ এবার মৃদু হেসে বলেন, ‘বাঙ্গাল কা বেটা, আভি সাধুজি কা সেবা কর না তো চাহিয়ে।’ এবার তাঁর জন্য ছাতামারি নামে এক ধরনের রুটির সঙ্গে ফ্রিজের ঠান্ডা পেপসির অর্ডার দিই আমি। আহার সেরে ছিলিমে চরস জ্বালিয়ে কষে দম দিয়ে তিনি বলেন, ‘বেটা, তুম দুশ্চিন্তা মত করিয়ে, ইয়েতি কা দর্শন তোমহারা জরুর মিল যায় গা।’ আমি আবার আড় চোখে তাঁর বস্তনির দিকে তাকাই। আমার চোরা চাহনি ধরতে পেরে গুয়ামুরি হাসি হেসে সাধুজি বলেন, ‘অভি লগন তো হুয়া নেহি বেটা।’ তাঁর ভাবখানা এই যে সঠিক লগ্নে ইয়েতি বা তুষারমানবের হাতখানা বোঁচকা থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে এসে স্পর্শ করবে তোমাকে, চাইলে তুমি শেইকহ্যান্ডও করতে পারবে।

বোম বাহাদুরও পিরিচে ছাতামারি রুটির টুকরা ঘাঁটতে ঘাঁটতে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসেন এ সময়। আর মাশরুমের চূর্ণ মেশানো চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে হিমাচলচারী হিম-মানবের প্রতীক্ষায় জেরবার হই আমি।

 সাধুজি স্ট্র দিয়ে সুড়ুত সুড়ুত করে পেপসির তলানিটুকু শুষে নিয়ে খোশমেজাজে ফের কলকেতে আগুন দেন। এবার ছিলিমটি প্রসাদ হিসেবে হাতে হাতে ঘোরে। চা-খানার খোলা দরজা দিয়ে আমি বেরিয়ে আসি এক চিলতে ব্যালকনিতে। দেখি, পাথরের ওপর দিয়ে ব্যাকপ্যাক পিঠে বেঁধে হেঁটে যাচ্ছেন সানগ্লাস পরা এক পর্যটক। নিচতলা থেকে ঘরকন্নার আওয়াজ ভেসে আসে। বেলা গড়ায়। পাহাড় থেকে উড়ে আসে হালকা কুয়াশা, আর সমগ্র পরিসরে ফুটে ওঠে আবছা আলোয় আশ্চর্য এক অপরাহ্ণ!