ক্ষমতা ও নোবেল

মহাত্মা গান্ধীকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি, এর পেছনে কি কোনো রাজনীতি ছিল?
মহাত্মা গান্ধীকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি, এর পেছনে কি কোনো রাজনীতি ছিল?
>নোবেল পুরস্কারের নেপথ্যে থাকে নানা রকম বিবেচনা, অনেক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিসহ বিভিন্ন ধরনের রাজনীতি ও ক্ষমতাবলয় নাকি কাজ করে পুরস্কারটির পেছনে—প্রশ্নগুলো আসলে কি সংগত?

ছাত্রজীবনে নোবেল পুরস্কার শুনলে অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অনুভূতি হতো। সে সময় খবরটার জন্য আগের রাত থেকে জেগে জেগে অপেক্ষা করতাম, তোড়জোড় করে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা জোগাড় করতাম, তারপর সারা দিন ধরে খবরগুলো পড়া হতো, লেখকের কথা ভাবা হতো, তাঁর সঙ্গে কোনো দিন দেখা হলে কী কী বলব আর কীভাবে এবং কী কারণে তাঁর আমাকে অন্য সবার চেয়ে বিশেষ মনে হবে—এই সবকিছুর বিস্তারিত জল্পনা–কল্পনা চলত মাথার ভেতরে, আর যদি লেখক এমন কেউ হতেন, যাঁকে আগেই পড়েছি, তাহলে নিজেই নোবেল পেয়ে যাওয়ার মতন খুশি লাগত। লেখকদের মনে হতো অন্য দুনিয়ার মানুষ; একটা রহস্যের চাদর ঘিরে থাকত তাঁদের।

এখন সে রকম হয় না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে অভ্যস্থতা আসে, এ ক্ষেত্রে সেটা হয়তো একটা কারণ, তাই উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতার মতো করে বলি, ‘মুঝসে প্যাহলি সি মুহাব্বাত মেরে ম্যাহবুব না মাং’ (আমার কাছে আগের মতো প্রেম চেয়ো না প্রিয়)। আরেকটা কারণ অবশ্যই অন্তর্জাল, যার সাহায্যে সবকিছুই খুব হাতের কাছের, সহজলভ্য বলে মনে হয়। কম্পিউটার কি-বোর্ডে দু–একটা অক্ষর লিখে ছুমন্তর করলেই সব চোখের সামনে হাজির হয়ে যায়। এর ভালো-খারাপ দুটো দিকই আছে, তবে এখানে আপাতত সে আলাপের পরিসর নেই।

সবচেয়ে বড় কারণ বোধ হয় যেকোনো সাহিত্য পুরস্কার সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বিভিন্ন রকম মাপকাঠি ও নিয়ম সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত লেখালেখি বিষয়টা আমার মনে হয় পানির মতন, যে পাত্রে রাখা হয়, তার আকার ধারণ করে। কোন লেখাটা কাকে কীভাবে ছুঁয়ে যাবে, তা পাঠক আর পাঠের মুহূর্ত ছাড়া কেউই জানে না। তাই যেকোনো একটা বিচারকের প্যানেল প্রতিবছরে প্রকাশিত বই থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বইটা বা এক বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখককে বেছে দিতে পারবেন, এ রকম আমার মনে হয় না। তবে পৃথিবীতে যে পরিমাণ বই প্রকাশিত হয়, সে পরিমাণ আয়ু পাওয়া অসম্ভব বলে এসব পুরস্কারের কারণে বহু লেখকই নজরে আসেন, সাধারণভাবে যাঁদের সঙ্গে পরিচয় হতো না।

বিজয়ী নির্বাচনে নোবেল কমিটির সততা বহুদিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। বিশেষ করে শান্তিতে নোবেলের ক্ষেত্রে পৃথিবীর ক্ষমতাশালী দেশগুলোর পছন্দই যে শেষ পর্যন্ত টিকে যাচ্ছে, তা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট। মহাত্মা গান্ধী শান্তিতে নোবেলের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন পাঁচবার—১৯৩৭, ১৯৩৮, ১৯৩৯, ১৯৪৭ এবং তাঁকে হত্যা করার মাত্র কয়েক দিন আগে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে। কেন শেষ পর্যন্ত তিনি নোবেল পেলেন না? এ প্রশ্ন বহুবার করা হয়েছে, নরওয়ের নোবেল কমিটির দিগন্ত কি খুব সংকীর্ণ? সেখানে ইউরোপীয় ছাড়া আর কারও সংগ্রাম ধরা পড়ে না? নাকি কমিটির সদস্যরা তখন এমন কাউকে পুরস্কৃত করতে ভয় পাচ্ছিলেন, যে কারণে ‘গ্রেট বৃটেন’–এর সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক খারাপ হবে? ১৯৪৮ সালে শেষ পর্যন্ত কাউকেই শান্তিতে নোবেল দেওয়া হয়নি, যেহেতু মনোনয়নের ডেডলাইন শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগেই গান্ধীকে হত্যা করা হয় এবং এই পুরস্কার শুধু জীবিত কোনো ব্যক্তিই পেতে পারেন।

এ রকম বহু উদাহরণ আছে, যেখানে ক্ষমতাশীলদের হাতিয়ার হিসেবে শান্তি পুরস্কার ব্যবহৃত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ান বিজনেস ইনসাইডার পত্রিকা শান্তিতে নোবেল বিষয়ে মজার একটা উক্তি করেছে, ‘সব পুরস্কারই অর্থহীন, কিছু পুরস্কার আরও বেশি অর্থহীন।’ ইয়াসির আরাফাত শান্তিতে নোবেল পেলেন ১৯৯৪ সালে ওসলো চুক্তির জন্য, সে সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েলের কাজে এসেছিলেন, একই মানুষ জীবনের শেষ সময়টা কাটালেন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে বন্দী অবস্থায়, এখন ক্ষমতাধরদের কাছে তাঁর পরিচয় একজন ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে।

হেনরি কিসিঞ্জার শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে, অথচ গ্যারি বাসের লেখা দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম বইয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যায় তাঁর ভূমিকার কথা বিস্তারিতভাবে লেখা আছে। সে সময় গণহত্যার খবর পেয়েও নিক্সন কিংবা কিসিঞ্জার হস্তক্ষেপ করেননি, যেহেতু চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে পাকিস্তানের সমর্থন তাঁদের প্রয়োজন ছিল। সম্প্রতি মালালা ইউসুফজাইয়ের নোবেল জয়ও প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।

সাহিত্যে নোবেল বিষয়ে এ রকম ব্যাপকভাবে না হলেও কিছু গুঞ্জন বহুদিন ধরেই শোনা গেছে। কয়েক দিন আগে ইউটিউবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা সাক্ষাৎকার দেখলাম। সম্ভবত ২০০৬ সালে ওরহান পামুক সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার পর ধারণ করা হয়েছিল। সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি:

সুনীল: যেমন ধরো প্রতিবছর যে নোবেল প্রাইজ পায়, কবিতা বা উপন্যাস, সেগুলো তো পড়ি আমরা। পড়ে আমরা নিজেরা নির্মোহভাবে বিচার করতে পারি...

প্রশ্নকর্তা: তা আপনার বিচারটা কী বলুন একটু...

সুনীল: বাংলা, বাংলা নিয়ে গর্ব না করে এমনি স্ট্যান্ডার্ডের বিচার করতে পারি, আমার মনে হয় এখন যেসব বই নোবেল পুরস্কার পাচ্ছে, আমাদের বাংলায় বেশ ভালো ভালো লেখা বেরিয়েছে—যেমন আমি একটা বইয়ের নাম করতে পারি, সতীনাথ ভাদুরীর ঢোড়াই চরিত মানস, এ রকম একটা বই যেকোনো ভাষায় দুর্লভ একটা বিষয়...

প্রশ্নকর্তা: আচ্ছা আপনি যখন প্রসঙ্গে এলেন, ওরহান পামুক সম্বন্ধে আপনার কী মতামত? সদ্য নোবেল লরিয়েট হয়েছেন...

সুনীল: ওই ইয়ে, টার্কিশ লেখক...হ্যাঁ পড়েছি ওর কতগুলো লেখা...স্নো...কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে কি জানো তো? পামুক খারাপ লেখে না, ভালো লেখে, আমি তাকে কোনো দোষ দিচ্ছি না। কিন্তু জানো নোবেল প্রাইজ তো এখন দেশ ধরে ধরে দেওয়া হচ্ছে...ও টার্কি পায়নি, তাহলে এবার ওকে দাও, ও ইজিপ্ট পায়নি, এবার ইজিপ্টকে দাও!

একই সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল বিজয় নিয়েও বলেছিলেন, সে সময় প্রাচ্যের প্রতি পাশ্চাত্যের আগ্রহও তাঁর নোবেল পাওয়ার পেছনে বড় কারণ।

প্রতি বছরেই সাহিত্যে নোবেল নিয়ে কিছু অসন্তোষ, কিছু বিতর্ক হয়। সব শেষে হয়েছে বব ডিলানকে নিয়ে। এই প্রথম একজন গীতিকার সাহিত্যে নোবেল পেলেন। ডিলান খুব দুর্দান্ত গায়ক ও গীতিকবি—সন্দেহ নেই, কিন্তু বিতর্ক উঠেছিল গান কি সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত? তা যদি হয়, তাহলে আরও তো যোগ্য গায়ক গীতিকার ছিলেন, যেমন লেনার্ড কোহেন—তিনি নন কেন? নিশ্চয়ই এই বিজয়ের পেছনে শুধু মেধা আর সাহিত্যগুণ ছাড়াও আরও কিছু রয়েছে, খুব গভীর আর বিশদভাবে দেখলে তা বোঝা যাবে।

২০১৮ সালে নোবেল কমিটির ভেতরে দুর্নীতি এবং একজন আজীবন সদস্য কবি ক্যাটারিনা ফ্রসটেন্সনের স্বামী আলোকচিত্রী জ্যঁ-ক্লদ আর্নল্টের বিরুদ্ধে ১৮ জন নারী যৌন হয়রানির অভিযোগ আনলে তা নিয়ে জোরালো বিক্ষোভ আর প্রতিবাদ হয়। ফলে একাডেমির প্রধানসহ ছয়জন পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। যে কারণে গত বছর সাহিত্যে নোবেল মুলতবি ছিল।

এ বছরে তাই ২০১৮ সালের জন্য পুরস্কৃত হলেন পোল্যান্ডের ওলগা তোকারচুক আর ২০১৯–এর জন্য অস্ট্রিয়ার পিটার হান্ডকে। তাঁদের কাউকে নিয়েই তেমন কিছু জানতাম না। কয়েক দিন অন্তর্জাল ঘেঁটে যা বুঝলাম, তা একদম প্যান্ডোরার বাক্স খোলার মতো ব্যাপার। ওলগাকে নিয়ে কোনো অসন্তোষ না থাকলেও পিটার হান্ডকের বিজয় নিয়ে তুমুল বিক্ষোভ আর প্রতিবাদ উঠেছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে। গার্ডিয়ান পত্রিকা জানিয়েছে, সাহিত্যে নোবেল জেতার ২০ বছর আগে পিটার হান্ডকে আরেকটা টাইটেল জিতেছিলেন। সালমান রুশদী ১৯৯৯ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকার জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল মোরন অব দ্য ইয়ার’ (বছরের সেরা আন্তর্জাতিক নির্বোধ) নামে একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন, তাতে হান্ডকে রানারআপ হয়েছিলেন স্লোবোদান মিলেসেভিচের গণহত্যাকারী সরকারের প্রতি বারংবার আনুগত্যের কারণে। প্রচণ্ড জাতীয়তাবাদী এই লেখক বালকানের যুদ্ধের সময় জনসমক্ষে এমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে সারাজেভোর মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের হত্যা করে দোষ দিয়েছে সার্বিয়ানদের। তিনি স্রেবেনিকার গণহত্যা সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন আর সালমান রুশদীর জ্বলন্ত নিন্দার সাত বছর পরে মিলেসেভিচের ফিউনেরালেও তিনি হাজির ছিলেন।

সুইডিশ একাডেমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ভবিষ্যতে তারা পুরুষ ও পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক থাকবে না, তারা দুটি প্রতিশ্রুতি রক্ষাতেই বিফল হয়েছে। গত বছরের এত বড় একটা টানাপোড়েন থেকে উঠে এসে এ বছরেই পিটার হান্ডকের মতো বিতর্কিত এক লেখককে পুরস্কৃত করার পেছনে নিশ্চয়ই ক্ষমতাধরদের ইশারা রয়েছে।