দুকথার চিঠি

প্রভিডেন্স শহরের জেফারসন সড়কটার দুদিকেই খোলা। নির্জন। অথচ এর অন্যদিকেই বাহারি দোকানের জটলা। তবে ইদানীং জেফারসন স্ট্রিটের বদলে লোকে একে নরউইচ স্ট্রিট বলে। আসলে সরকারিভাবেই এর নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। সড়কটি দক্ষিণ দিক দিয়ে বোস্টন পোস্ট রোডে গিয়ে মিলেছে। জেফারসন স্ট্রিটের খুব কাছেই সমুদ্রসৈকত, দুধারে ম্যাপলগাছ। সড়ক আর সৈকতের মাঝখানে বেশ কয়েকটা চত্বরও আছে। এগুলোর একটার নাম ওয়েল্যান্ড স্কয়ার। এখানেই পুরোনো জমিদারবাড়ির আদলে গড়া ওয়েল্যান্ড ম্যানর হোটেল। এই শহরে আসলে এখানেই থাকি আমি। এপ্রিলের শেষ দিকে হোটেলে ওঠার সময় রিসেপশনিস্ট আমাকে একটি চিঠি ধরিয়ে দেয়। প্রায়ই এখানে থাকি বলে হোটেল কর্তৃপক্ষ আমার নামে চিঠি এলে আগলে রাখে। যাহোক, লিফটে ওঠার আগেই খামটি খুললাম। চিঠিটা একবারেই দুকথায় লেখা: ‘আমি এখন নিউইয়র্কে। আমার খোঁজ করবে না। তা ছাড়া আমাকে খুঁজে বের করা তোমার শোভন দেখায় না।’

যত দূর মনে পড়ে, ভয় আর আতঙ্ক ছেলেবেলা থেকেই জাপটে ধরেছিল আমাকে। মনে হতো, আমেরিকার বোমারুরা এখানে আসার আগেই আমাকে কেউ ঘরে দিয়ে এসেছিল। মনে পড়ে, সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ে আমার হাত–পা কাঁপতে থাকত। দূর অরণ্যে সন্ধ্যা নামলে মনে হতো আমিও ডুবে যাচ্ছি অন্ধকারে। মাঝেমধ্যে থমকে দাঁড়াতাম এবং কাঁদতাম ভয়ে। এত ভয় যে রীতিমতো লজ্জা লাগত। ভাবতাম, কেউ অরণ্যে গেলে আর ফিরবে না কিংবা রাতে কেউ বাড়ির বাইরে গেলে অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে। আবার হঠাৎ যখন ঘুম থেকে জেগে উঠতাম, দেখতাম দেয়ালে সূর্যের আলো। এখনো সেই ভয়ের জুজু থেকে বের হতে পারিনি।

এসব মনে করে কিছুটা আনমনা হয়ে পড়ি। তাই লিফটে ওঠার সময় নিগ্রো লিফট অপারেটর যখন সাবধানে পা ফেলতে বলল, তখন খানিকটা হোঁচটও খেলাম। হোটেলের দুটো লিফটই সচল। একটি দিয়ে মানুষ ওঠে, অন্যটি দিয়ে ওঠানো হয় মালামাল। আমি চিঠিটা থেকে চোখ সরিয়ে লিফট অপারেটরের দিকে তাকাই। সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। তার গাঢ় নীল পোশাকের কারণে তাকে প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না। লিফটে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে হলো, ‘আমি একটি ঘরে অনেক মানুষের সঙ্গে আছি এবং আমাদের সবাই চুপ।’ আমি নিশ্চিত, এভাবে আর কিছুটা সময় গেলে নিগ্রো অপারেটর পাগল হয়ে যাবে। বোস্টন ছেড়ে আসার সময় কোটের পকেটে ভাঁজ করে একটা পত্রিকা নিয়েছিলাম। সেটা খুলে শিরোনামগুলো পড়তে লাগলাম, বলতে পারেন অপারেটরকে উদ্দেশ্য করেই: ‘ইউরোপের নানা দেশে বিভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা চালু থাকায় ডলারের দামও পড়ে যেতে পারে।’ এই শিরোনামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বললাম, আমেরিকা ভ্রমণে থাকতে থাকতেই সঙ্গে থাকা সব ডলার খরচ করতে হবে। নতুবা পরে ইউরোপে ফিরে গেলে ডলারের ভালো দাম পাওয়া যাবে না। এবারে মাথা নাড়ল অপারেটর এবং তার পাশে থাকা প্রভিডেন্স জার্নাল-এর শিরোনামটা আঙুল দিয়ে দেখাল আমাকে, যা আমার সঙ্গে থাকা বোস্টন গ্লোব পত্রিকার শিরোনামের খুব কাছাকাছি। 

স্বস্তি পেলাম। শেষমেশ কথা বলল ও। রুমে এনে স্যুটকেস, ব্যাগপত্র রাখল। পকেটে হাত দিয়ে একটা ব্যাংক নোট বের করে ওকে দিতে গেলাম। দেখি, দশ ডলারের নোট বের করেছি। পরে আবার কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পাঁচ ডলারের একটি নোট বের করে ওর হাতে দিতে গিয়ে দেখি, তার হাত বন্ধ, নিতে চায় না। বেশি দিলে হয়তো নিত। ও চলে গেলে চিৎকার করে বললাম, ‘আমি এখানে বেশি দিন থাকিনি, সবে উঠেছি।’ মাথা কাজ করছিল না। ওভারকোট পরেই বাথরুমে ঢুকি। আয়নায় দেখি কয়েকটা চুল কোটের ওপর পড়ে আছে। নিশ্চয় বাসে বসে থাকার সময় এগুলো পড়েছে। বাথটাবের এক কোনায় বসে নিজে নিজে কথা বলতে থাকি, শিশুকালে যেমনটা করতাম। কেন এ রকম করছি আমি? জানি না। কিছু সময় একা একা হাসলাম। বাথটাবে গড়াগড়ি দিলাম। বাথটাবের তলাটা নানা হাবিজাবি জিনিসে ভরা—পানি বন্ধ করার ট্যাপ, ফিতা ইত্যাদি। তবে যে যা–ই বলুক, নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলার একটা অর্থ আছে।

এখন আর হাসি নয়। অনেক হয়েছে। রুমে গিয়ে জানালার পাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতেই চোখ গেল ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ভুজগাছগুলোর দিকে। পাতার ফাঁক গলিয়ে আলো এসে চোখে পড়ছে। আবার দেখতে শুরু করলাম চিঠিটা। হালকা নীলচে খাম। খামটা নিশ্চয় কোনো হোটেলের হবে। পেছনে লেখা ডেলমোনিকো’স, পার্ক অ্যাভিনিউ, নাইন স্ট্রিট, নিউইয়র্ক। কিন্তু পোস্টমার্কে লেখা ফিলাডেলফিয়া। চিঠিটা পোস্ট করেছে চার-পাঁচ দিন আগে। প্রশ্ন হলো, ঘুরে বেড়ানোর জন্য এত টাকা কোথায় পেল সে? আমার স্ত্রীর কথা বলছি, যদিও এখন আর তাকে স্ত্রী বলা উচিত নয়। আমি জানি, তার অনেক টাকা। ৩০ ডলারের নিচে ডেলমোনিকোতে রুম পাওয়া যায় না। আসলে টাকাপয়সা সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। ছিল না কোনোকালে। সে তা–ই করতে ভালোবাসে, যা সে মুহূর্তেই করতে পারে কিংবা যা হরহামেশাই অদলবদল করা যায় বা বিনিময়যোগ্য।

জানালা দিয়ে যত দূর চোখ যায় দেখার চেষ্টা করি। দূরে টেক্সটাইল মিলের জন্য গির্জটা ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। আমার মাথায় যে মানচিত্রটা ঘুরছে তা যদি ঠিক থাকে, তবে এটা ব্যাপটিস্ট চার্চ। মনে পড়ছে, একবার সন্ধ্যার দিকে পাহাড়ে উঠেছিলাম মাকে দেখতে। অবশ্যই ভয় নিয়ে। তার দুঃখের অন্ত ছিল না। মা বোধ হয় পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল। আমি পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দূর গ্রামের সন্ধ্যা নামা দেখছিলাম। আধো আলোতে দেখছিলাম একদল নারী বাজার করছিল গ্রামের বাজারে। মুহূর্তেই নিভে গিয়েছিল সব আলো। কানে ভেসে এল জোনাকির ডাক। গ্রামের শেষ মাথার গ্যাস স্টেশানের ল্যাম্পের আলো ছিল শেষ ভরসা। পথে থাকা লোকজন দ্রুত হাঁটছিল। হঠাৎই এদের মধ্যে খুব ধীরে হাঁটতে থাকা একজন চিনেছিল আমার মাকে এবং অদ্ভুত ব্যাপারÑওই মহিলা রাস্তা পার হচ্ছিল কোনাকুনি, সোজাসুজি নয়। অনেক বছর পর এলোমেলো অনেক কিছু মনে পড়ছে।

চেয়ারটা টেনে বিছানার পাশে টেবিলের সামনে নিলাম। ফোন দিলাম নিউইয়র্কের ডেলমোনিকো’স হোটেলে। জুডিথ পাঁচ দিন আগেই হোটেল ছেড়ে দিয়েছে। পরে কোথায় গিয়েছে, তা হোটেলের কেউ জানে না। শুধু এটুকু একজন বললেন, জুডিথ তার রুমে একটি ক্যামেরা ফেলে গেছে। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাদের কি উচিত হবে এটা ইউরোপে জুডিথের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া?’ আমি জানালাম, ‘আমি জুডিথের স্বামী, কাল নিউইয়র্কে আসছি, আমি ক্যামেরাটি নিয়ে যাব।’

চেয়ায়ে বসে থেকেই কোট খুললাম। অস্ট্রিয়া থেকে আসার সময় যে তিন হাজার ডলার নিয়ে এসেছি, তা কীভাবে খরচ করব ভাবছি। অস্ট্রিয়ায় এক ব্যাংক কর্মকর্তা তো বলেছেনই, ডলার বেঁচে গেলে যে দরে কিনেছিলাম ঠিক সে দরেই বেচে দিতে পারব। ওই প্রতিশ্রুতিই ভরসা। তবে আরেকটু আরাম–আয়েশে থেকে আরও কিছু পয়সা খরচ করার কথা ভেবেছি। পরদিন ডেলমোনিকো’স-এ একটা রুম বুকিং দিতে ফোন দিলাম। খালি পেলাম না। মাথায় এল ওয়ালডরফ এস্তোরিয়ার হোটেলের কথা। কিন্তু না, হঠাৎ মনে এল আলগনকুইন হোটেলের কথা। ফোরটি ফোরথ স্ট্রিটের এই হোটেলে প্রায়ই থাকতেন আমার প্রিয় লেখক এফ স্কট ফিত্জারেল্ড। এখানে একটা রুম খালি পাওয়া গেল।

মনে হয়, জুডিথ আমার অ্যাকাউন্ট থেকে অবশিষ্ট টাকাও তুলে নিয়ে গেছে। মনে মনে বললাম, ‘এ ক্ষমতা তাকে দেওয়া উচিত হয়নি আমার।’ অত শত ভাবিনি। কেবল দেখতে চেয়েছিলাম কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়। শেষ যেদিন দেখা হলো, ওকে মনে হয়েছিল দূরের কোনো মানুষ, যাকে চিনি না। জুডিথ চলে যাওয়ার পর থেকে ফিত্জারেল্ডের দ্য গ্রেট গেটসবি উপন্যাসের কথা খুব মনে পড়ছিল। এটা এমন এক মানুষের ভালোবাসার গল্প, যে কিনা এক উপসাগরের পাশে একটি বাড়ি কিনেছে কেবল প্রতিদিন তার উল্টো দিকের বাড়ির লাইটের আলো দেখার জন্য, কেননা ওই বাড়িতেই তার ভালোবাসার মানুষ অন্য এক পুরুষের সঙ্গে রাত্রি যাপন করে। গেটসবির লজ্জা, মার্জিত ভাব তার মোহনীয় ভালোবাসার মতোই ছিল মহান। অন্যদিকে, তার প্রেমিকার উন্মত্ত ও লজ্জাহীন ভালোবাসা জন্ম দিয়েছিল হীনতার।

একইভাবে আমার ভালোবাসায়ও ছিল লজ্জা, ছিল মার্জিত ভাব। বলতে দ্বিধা নেই, আমি খানিকটা কাপুরুষও ছিলাম, কারণ জুডিথকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমি খোলস থেকে বের হতে পারিনি। মানি, আমার লজ্জা কাপুরুষতার নামান্তর। কিন্তু কী করব, আমি যে গেটসবির মতো নরম ও নম্র। 

অসহ্য লাগছিল এসব ভাবতে। পানির পাইপের ছিপি খুলে শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম বাথটাবে। পানিতে যেন বিলীন হয়ে যাচ্ছিলাম। বাইরের গাছগুলোর ছায়া দোল খাচ্ছিল বাথরুমের দরজায়। আমি জানি, বীর্যবান পুরুষ আমি নই, তবু এ তো আমার বীর্য আমারই হাতে। মনে হচ্ছিল, পা থেকে হাঁটু দুটো যেন আলাদা হয়ে গেছে। খানিক বাদে নিজেকে ধুয়ে-মুছে নিলাম।

অনুবাদ: তুষার তালুকদার