আলোকে আঁধার হোক চূর্ণ

কানাডায় ১৩তম টরন্টো বাংলা বইমেলায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী (বাঁ থেকে চতুর্থ), কবি আসাদ চৌধুরীসহ অন্য অতিথিরা। ছবি: সংগৃহীত
কানাডায় ১৩তম টরন্টো বাংলা বইমেলায় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী (বাঁ থেকে চতুর্থ), কবি আসাদ চৌধুরীসহ অন্য অতিথিরা। ছবি: সংগৃহীত

সাত বছর আগে গ্রীষ্মের এক অপরাহ্ণে প্রথম স্পর্শ করি কানাডীয় ভূমি। সেদিন টরন্টোর পিয়ার্সন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মেয়ে অর্চি ও নাতনি সাবাবা এসেছিল অন্টারিও প্রদেশের লন্ডন শহরে ওদের বাসস্থলে নিয়ে যেতে। হাইওয়ের উভয় পাশের বৃক্ষরাজি, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, ছোট-বড় নানান স্থাপনার চাকচিক্য পড়ন্ত বেলার মধ্যে একাকার হয়ে দিয়েছিল অনন্য এক অনুভূতি। দুই ঘণ্টার সামান্য কিছু বেশি সময় নতুন জনপথের দুরন্ত গতির যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছা গেল। চেরিহিলের প্লাটস লেনে স্বামী-কন্যাসহ মেয়ে থাকতে শুরু করেছে সেই ২০০৮ সাল থেকে। কানাডার অভিবাসী হয়ে প্রকৌশলে উচ্চতর শিক্ষার জন্য অর্চি—আমবারীন আতিশা ভর্তি হয় ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওতে, যা এখন ওয়েস্টার্ন নামে খ্যাত। পরিবেশ বিষয়ে মাস্টার্স শেষ করে এখন চলছে পিএইচডি পর্ব। জীবনের সঙ্গে জীবন মিলিয়ে শীত-বসন্ত এক করা বড় দুরূহ বিষয়। তার মধ্য দিয়েও সে যাত্রায় অর্চি পেয়েছিল তার মায়ের উষ্ণ সান্নিধ্য। মাধুর্যের অংশটুকু আরও অধিক মনোহর ছিল মিলন-আনন্দের পাশাপাশি ভ্রমণ-দর্শনে ও ভোজনবিলাসে।

যাপনের সেই স্মৃতির সঙ্গে কানাডায় আমাদের ফি বছরের যাওয়া-আসা যুক্ত করেছে নিত্যনতুন দৃশ্যাবলি। সময়ের সুতো ধরে সাবাবা—অগ্নিবর্ণা হাসান এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দুরারোগ্য ব্যাধিতে ইতিমধ্যে ও হারিয়েছে বাবাকে। এক শিশুর কিশোরী হয়ে ওঠার মধ্যে স্বপ্ন ও বাস্তবতার অভিঘাত কি খুব সহজেই স্পর্শ করা যায়? অর্চি তার পিএইচডি সমাপনান্তে উপার্জনের অস্থায়ী পথ পেলেও সংগ্রামের অংশটুকু দূর করতে পারেনি। ভাগ্য কি মানুষকে আসলেই নিয়ন্ত্রণ করে? ভারী হয়ে আসে রথ, তবু তো পথ ক্ষমা দেবে না!

এ বছর সাতসকালেই ১৩তম টরন্টো বাংলা বইমেলার উদ্বোধনের আমন্ত্রণ এল অন্য মেলার কর্ণধার সাদী আহমদের কাছ থেকে। জুলাই মাসের ৬ ও ৭ তারিখ, শনিবার সকালে উদ্বোধন এবং রোববার রাতে সমাপ্তি। জানা গেল এবং পরবর্তী সময়ে বোঝাও গেল, এ আয়োজনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থা কথাপ্রকাশের জসিম উদ্দিন জড়িত। নানা মাত্রার অনুমতি-নিবেদন সম্পন্ন শেষে গমনের বিষয়টি স্বচ্ছ করতে দিন ফুরাল প্রায়। এবার চলো মন মায়া-বন্ধনের কাছে পৌঁছাই। কিন্তু মন মুহূর্তে পৌঁছাতে পারলেও দেহের জন্য তো চাই বাহন। উড়াল কোম্পানিতে ধরনা দেওয়ার কাজটি আয়োজকদের পক্ষে জসিম উদ্দিনই করে দিলেন। এক বিরতিতে ২২ ঘণ্টা উড়ে টরন্টো।

শনিবার, ৬ জুলাই ২০১৯। পরিপক্ব সকালের রোদ টরন্টোর জানালা-দরজা যেন খুলে দিয়েছে নতুন অভিলাষে। ছুটির দিন থাকায় বিলম্বিত প্রাতরাশের প্রহর এসে মিলেছে অনুষ্ঠানস্থল ড্যানফোর্থ এলাকায়। ‘আলোকে আঁধার হউক চূর্ণ’—এবারের মেলার মূলমন্ত্র। বইমেলা নিয়ে নানা আবেগ, মিশ্র উত্তেজনা, সর্বোপরি বিভেদ-বিচ্ছেদ লগ্নি করে যে প্রান্তটি মিলল, তা নিশ্চিতভাবে আশার ও সম্ভাবনার। দুয়ারের রঙিন ফিতে কেটে ‘দ্য কানাডিয়ান লেজিয়ন হল’-এ প্রবেশ করতেই একখণ্ড বাংলাদেশ যেন হেসে ওঠে। টেবিলে টেবিলে রাশি রাশি বই ছাপিয়ে, আগত দর্শনার্থী-ক্রেতা বাঙালিদের সাজপোশাকের ভাঁজ ডিঙিয়ে, অনুষ্ঠান-মঞ্চের কবিতা-সংগীত-নৃত্যের রূপ আগলিয়ে বুঝি ধ্বনিত হচ্ছে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’...

উদ্বোধনের সময় ছিলেন কবি আসাদ চৌধুরী, মঞ্চে কথা বলেছেন ড. মোজাম্মেল খান, ড. হাসান মাহমুদ, তাসরীনা শিখা, কবি মাসুদ খান, সালমা বাণী, জসিম মল্লিক প্রমুখ। কবিতা পড়েছেন হাসান আল আবদুল্লাহ, মেহরাব রহমানসহ প্রবাসের তরুণ ও প্রবীণ কবিরা। সংগীত পরিবেশনায় ফারহানা শান্তার পাশাপাশি ছিলেন স্থানীয় প্রতিভাবানেরা। অরুণা হায়দারের সফল নেতৃত্বে উপভোগ করা গেছে মনমাতানো নৃত্যছন্দ। আলোচনা ছিল প্রকাশনা নিয়ে, প্রবাসে বাংলা ভাষা চর্চা নিয়ে, শিশু-কিশোরদের মাতৃভাষা শিক্ষা নিয়ে। এমনকি বাংলা একাডেমির ভূমিকা ও পরিকল্পনা নিয়েও। প্রাণবন্ত আলাপ হয়েছে, আমরা স্বপ্ন ও সাফল্যের কথা শুনেছি।

বাংলাদেশ থেকে প্রকাশকেরা এসেছিলেন। অনন্যার মনিরুল হক, অন্বয়ের হুমায়ুন কবির ঢালী, সন্দেশের লুৎফর রহমান চৌধুরী প্রমুখ। ছিল স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত বইয়ের সমাহার। আর রোববার সায়াহ্নে সমাপ্তির রেশটুকু লেগেছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিসচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রাণময় বক্তব্যে।

দুই দিনের ১৩তম টরন্টো বাংলা বইমেলা শেষে বাংলাদেশে ফিরে পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব করছি এবং ওরা প্রবাসে বসে অঙ্ক মেলাচ্ছে উপার্জন ও বিস্তারের। সেভাবে দেখলে হয়তো কথা আর এক থাকে না। দেশ থেকে যেসব প্রকাশক বিবিধ হুজ্জতের ভেতর দিয়ে মেলায় গেলেন, তাঁদের হিসাব যদি কেবল অর্থনৈতিক বিবেচনায় দেখা হয়, তবে সেখানে ক্ষতির পাল্লাই ভারী! আর যদি মেলবন্ধন-সংযোগ-ভ্রমণ ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিত খোঁজা হয়, তবে নিশ্চয়ই ধনাত্মক কিছু মিলবে। উদ্যোক্তাদের কথা কিংবা প্রবাসীদের বিষয়টি নানা সমীকরণে ফেলা যেতে পারে। তবে সেখানেও দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যকরণ নির্ধারণে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে আবেগ। বাঙালি চরিত্রে এই আবেগ স্থান-কাল-পাত্র কিছুই মানে না।

টরন্টো বইমেলায় আগেও একবার উদ্বোধক হিসেবে যেতে হয়েছিল। আর এ শহরের বাঙালিদের নানান অনুষ্ঠানে, কী ব্যক্তিগত আমন্ত্রণেও গিয়েছি কয়েকবার। এবারও আশা করেছিলাম বইমেলা ঘিরে আমাদের ঘন আড্ডা হবে। হ্যাঁ, আড্ডা হয়েছে। তবে অনেক প্রিয় মুখের সেখানে ছিল অনুপস্থিতি এবং তা বড় বেশি বেজেছে!

অভিমান ও পরশ্রীকাতরতা কি বাঙালির অভিধান থেকে তুলে দেওয়া যায় না?