পোড়া টিনের বাড়ি

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

সেই দূর ছোটবেলায় গভীর-নির্জন আর অতিশয় সুন্দর এক গ্রামে থাকতাম আমরা। এ গল্প সেই গ্রামেরই এক আধপাগলা ডাক্তারকে নিয়ে। পাগল তিনি ছিলেন না, তাঁর কর্মকাণ্ড দেখে লোকে ও রকম বলত, আমরাও তা-ই ভাবতাম। তো, সেই ডাক্তারের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমাদের প্রথম অনুভূতি যে আনন্দের ছিল, সে কথা স্পষ্ট মনে পড়ে। কারও মৃত্যুর খবরে খুশি হওয়া অন্যায় জেনেও আমরা খুশিই হয়েছিলাম, কারণ, তাঁর বাড়িতে লিচু চুরি করতে গিয়ে অনেকবার ধাওয়া খেয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। ওই অঞ্চলে একমাত্র ওই বাড়িতেই লিচুগাছ ছিল, প্রচুর লিচু ধরত, খাওয়ার মতো মানুষও ছিল না তাঁর, তবু আমরা, মানে এলাকার কিশোরেরা, লিচু চুরি করতে গেলেই তিনি কীভাবে যেন টের পেয়ে যেতেন, আর বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠতেন, ‘কে রে? বন্দুক নিয়ে আসছি, দাঁড়া!’ ও রকম ভয়-ধরানো কণ্ঠও ওই অঞ্চলে আর কারও ছিল না। হুমকি শুনে, সত্যিই তিনি বন্দুক নিয়ে আসছেন কি না, তা না দেখেই লাগাতাম ভোঁ–দৌড়। আর তা করবই–বা না কেন? তাঁর তো সত্যিই বন্দুক ছিল, বিরাট এক বন্দুক, অন্তত আমাদের কাছে তা বিরাটই লাগত, কারণে-অকারণে বন্দুক বের করার অভ্যাসও ছিল তাঁর, আমরা নিজের চোখেই তা দেখেছি। ও রকম বন্দুক আর কারও কাছে আমরা দেখিনি কখনো, এমনকি থানার পুলিশদের কাছেও নয়। ভয়ের ব্যাপার না, বলুন? বাজখাঁই কণ্ঠই হোক আর সত্যিকারের বন্দুকই হোক, ওসব থাকা যে তাঁর জন্য স্বাভাবিকই ছিল, তা–ও জানতাম। কারণ তিনি ছিলেন ব্রিটিশ আর্মির অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এবং শল্যচিকিৎসক। তখনকার দিনে অত বড় ডাক্তার ওই অঞ্চলে তো বটেই, জেলা শহরেও ছিল না। তবু তিনি রাজধানীর চাকচিক্যময় জীবন ছেড়ে কেন গ্রামে বসবাস করতেন, তা আমরা কোনো দিনই বুঝিনি। অবশ্য গ্রামেও তিনি অভিজাত জীবন যাপনই করতেন। প্রচুর জমিজমা ছিল, বেশ কজন রাখাল ও কাজের মানুষ ছিল, অনেকগুলো গরু ছিল, নিজের জমি তাঁর রাখালেরাই চাষ করত। তাঁর বাড়িটিও ছিল বিশাল। সেই বাড়িতে ছিল অনেক রকম ফলের গাছ, তবে আমাদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল ওই লিচুগাছ। আম-জাম-কাঁঠাল তো গ্রামের অন্য বাড়িতেও ছিল, কিন্তু লিচুগাছ যে একটিই। তাঁর বাড়িতে রাখাল-চাকর ছাড়া আর বেশি মানুষ ছিল না। তাঁর স্ত্রীকে আমরা কখনো দেখিনি, তিনি মারা গিয়েছিলেন আমাদের জন্মেরও আগে। একটিমাত্র কন্যা ছিল তাঁর, আমরা তাঁকে ডাকতাম শামীম আপা বলে, যদিও ডাক্তার সাহেবকে কোনো সম্বোধনে ডাকার সাহসই পেতাম না। তিনি যে ভয় দেখাতেন! শামীম আপা প্রায়ই আমাদের ডেকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যেতেন, আদর করে এটা-সেটা খেতে দিতেন, তাঁর অনুমতি নিয়েই হয়তো কোনো ফল গাছে উঠতাম পাড়ার জন্য, আর তখনই ওই হুংকার, ‘বন্দুক নিয়ে আসছি, দাঁড়া!’ চুরি করতে গেলেও ধাওয়া খেতে হয়, তার মেয়ের অনুমতি নিয়ে পাড়তে গেলেও হুংকার শুনতে হয়, এ কেমন লোক রে বাবা! হুংকার শুনেই আমরা পড়িমরি করে ছুট লাগাতাম, শামীম আপা হেসে কুটিপাটি হতেন, আর পেছন থেকে ডাকতে ডাকতে বলতেন, ‘এ্যাই গাধার দল, পালাচ্ছিস কেন, বাবা কিছু বলবে না, আয়, ফিরে আয়।’ কিন্তু তাঁর অভয়বাণীতে বিশেষ ভরসা পেতাম না। তো, ডাক্তার মারা যাওয়ার খবর যখন পেলাম, তখন বেশ খুশিই হয়েছিলাম এই ভেবে যে এখন অনায়াসে ও বাড়িতে যাওয়া যাবে, যত ইচ্ছে লিচু খাওয়া যাবে, অন্য ফলও পাড়া যাবে, শামীম আপা তো আর নিষেধ করবেন না, তিনি তো আমাদের বেশ আদরই করেন। 

গ্রামে যেমনটি হয়, কারও মৃত্যুসংবাদ পেলে সারা গ্রামের লোক ভেঙে পড়ে ওই বাড়িতে, আর এ তো ডাক্তারের মতো বিখ্যাত মানুষ, দশ গ্রামের লোক ভেঙে পড়ল সেখানে। আমরাও গেলাম দেখতে। গিয়ে যা দেখলাম, তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। যাঁকে আমরা এত ভয় পেতাম, তাঁকে যে গ্রামের মানুষ এত ভালোবাসে, আগে কখনো বুঝিনি। কত কথা যে শোনা গেল তাঁকে নিয়ে! নিজের বাড়িতেই একটা ঘরে ছিল তাঁর চেম্বার, রোগী দেখতেন, আমরা সেসব দেখেছিও, কিন্তু জানতাম না যে কারও কাছ থেকেই টাকাপয়সা নিতেন না তিনি। শুধু পরামর্শই নয়, সাধ্যমতো ওষুধও কিনে দিতেন। জানলাম, নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপসহীন। যা কিছুকে তিনি অন্যের জন্য অনৈতিক মনে করতেন, তা নিজের জন্যও অনৈতিকই মনে করতেন। যেমন, ফসলি মাঠে কোনো গরু-ছাগল ঢুকে ফসল খেয়ে ফেললে তিনি সেগুলো নিজের রাখাল দিয়ে ধরে এনে খোঁয়াড়ে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। শুধু অন্যেরগুলো নয়, নিজের গরু-ছাগল হলেও একই ব্যবস্থা। খোঁয়াড় থেকে টাকা দিয়ে গরু বা ছাগল ছাড়িয়ে আনতে হতো, নিজের গরু-ছাগল খোঁয়াড়ে পাঠিয়ে নিজেই টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতেন, আর তারপর রাখালের বেতন থেকে সেই টাকা কেটে রাখতেন! কারণ? কারণ, রাখাল তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি, নইলে গরু বা ছাগল অন্যের (বা নিজের) ফসল নষ্ট করল কীভাবে? কতজনকে কতভাবে সহায়তা করেছেন, গরিবের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছেন, অনাথ-অসহায় মেয়েদের বিয়ে দিয়ে সংসার তৈরি করে দিয়েছেন সেই সব গল্প শোনা গেল লোকজনের মুখে। সবচেয়ে অবাক হলাম আরেক ঘটনায়। ওই অঞ্চলের সব মুক্তিযোদ্ধা হাজির হয়েছিলেন সেদিন। জানাজা শেষে, দাফনের আগে, তাঁরা সামরিক কায়দায় গার্ড অব অনার দিলেন ডাক্তার সাহেবকে। তখন প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার দেওয়ার প্রথা ছিল না, নীরবেই সমাহিত হতেন তাঁরা, ফলে ঘটনাটি আমাদের কাছে ছিল একেবারেই নতুন। জানলাম, যুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়েছিলেন, শিষ্যরা সে কথা ভোলেননি, সে জন্যই তাঁদের গার্ড অব অনার নিয়ে সমাহিত হলেন সার্টিফিকেট না-নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন (অবসরপ্রাপ্ত) ডাক্তার আলিম চৌধুরী। 

 ডাক্তার সাহেব নাই, ধমক দেওয়ারও মানুষ নাই, তবু আমাদের সেই দুরন্তপনা আর রইল না। গাছে গাছে ফল পেকে থাকে, পাখিরা এসে খেয়ে যায়, আমাদের তবু গাছে ওঠার ইচ্ছে হয় না। শামীম আপা বাপের মৃত্যুর পর থেকে একা হয়ে গেছেন, আমরা গিয়ে মাঝেমধ্যে তাঁর সঙ্গে গল্প করি, কিন্তু ফল পাড়তে বললেও আমরা আর রাজি হই না। শামীম আপা ঠাট্টা করে বলেন, ‘বাবা থাকতে তো খুব চুরি করতে আসতি, এখন আসিস না কেন?’ আমরা লজ্জা পাই, দুঃখবোধ করি, নিজেদের দুরন্তপনার জন্য অপরাধবোধে ভুগি, শামীম আপা সম্ভবত বুঝতে পেরেই বলেন, ‘তোরা খামোখাই ভয় পেতি। বাবা বাচ্চাদের কত পছন্দ করত, জানিস?’ 

 ‘তাহলে বন্দুকের ভয় দেখাতেন কেন?’ 

 ‘আরে ওটা তো মজা করার জন্য বলত। তোরা পালাতি বলে কখনো দেখিসনি, তোদের দৌড় দেখে বাবা হেসে কুটিপাটি হতো! কত দিন ফল পেড়ে তোদের জন্য অপেক্ষা করে থাকত, তোরা তো ধারেকাছেও চাপতি না।’ 

 ‘ও রকম ভয় দেখালে কি কাছে আসা যায়, শামীম আপা?’ 

 ‘মানুষকে বাইরে থেকে দেখতে নেইরে, বোকার দল। মন বুঝতে হয়।’

দুই.

আমরা বড় হতে থাকি, আর একটু একটু করে অনেক কিছু বুঝতে শিখি। ডাক্তার সাহেবের সামাজিক জীবন বলতে কিছু ছিল না। তিনি কখনো গ্রামের কারও বাড়িতে যেতেন না, এমনকি ঈদ বা পূজার নিমন্ত্রণেও নয়, কারও বিয়ের নিমন্ত্রণে তো নয়ই। বাজারেও যেতেন না। বাড়িতেই থাকতেন বেশির ভাগ সময়, ভোরে বা বিকেলে হাঁটতে বেরোতেন, কিন্তু কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন না। তাঁর মতো নিঃসঙ্গ মানুষ আমরা আর কখনো দেখিনি। কেন এমন একা থাকতেন তিনি? কেন শহর ছেড়ে গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন? কেন তাঁর কোনো আত্মীয়স্বজন ছিল না? 

স্কুল ছেড়ে শহরের কলেজে পড়তে আসি আমরা, কিন্তু ছুটিতে বাড়িতে গেলেই শামীম আপার কাছে যাই গল্প করতে। তত দিনে তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে, তারপরও এ বাড়িতেই আছেন, নইলে বাড়ি দেখাশোনা করবে কে? গল্প করতে করতে সব প্রশ্নই করা যায় শামীম আপাকে। আমাদের কৌতূহল মেটাতে গিয়ে তিনি হাসেন, ‘বাবা বেঁচে থাকতে তাঁকে এসব প্রশ্ন করিসনি কেন?’

‘তখন তো ছোট ছিলাম! আর যা ভয় পেতাম মামাকে!’ 

আমরা তত দিনে ডাক্তার সাহেবকে মামা বলে ডাকতে শুরু করেছি, যদিও কেন এই সম্বোধন, তা জানি না। 

শামীম আপার কাছেই জানতে পারি, আর্মিতে থাকার সময় অবিভক্ত ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে তাঁর পোস্টিং হতো। একসময় ক্লান্ত হয়ে তিনি অকালীন অবসরের জন্য আবেদন করেন, আবেদন মঞ্জুরও হয়। তারপর তিনি কলকাতায় এসে প্র্যাকটিস শুরু করেন। পসারও জমে ভালোই। কিন্তু সেখানেও নাকি তাঁর মন বসত না। প্রায়ই বাড়ি ফেরার কথা বলতেন। বাড়ি তো পূর্ববঙ্গে, তা–ও এক গণ্ডগ্রামে। তবু তিনি বাড়িই ফিরতে চাইতেন। দেশভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন, কিন্তু বেশি দিন থাকেননি সেখানে, পাকাপাকিভাবে বাড়ি চলে আসেন স্ত্রী আর শিশুকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে। সামরিক জীবন, নানা জায়গায় পোস্টিং, কলকাতায় বসবাস—এসব কারণেই আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কমে গিয়েছিল। গ্রামে আসার পর তা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। কে আর এই দূরগ্রামে তাঁকে দেখতে আসবে? আবার গ্রামের মানুষের সঙ্গেও ঠিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তাঁর। সামাজিক জীবন থাকবে কী করে? তাঁর ধরন-ধারণ কেউ বুঝতই না।

তিন. 

এত বড় বাড়ি, কিন্তু পুরোটাই পোড়া টিনের তৈরি। এ রকম বাড়ি আমরা আর কখনো দেখিনি। যারা দেখেনি, তারা বুঝবেও না, পোড়া টিন দেখতে কেমন হয়। রং হয় ইটের মতো লালচে, কিছুটা ভঙ্গুরও হয়ে পড়ে। ডাক্তার সাহেব তো সচ্ছল মানুষ ছিলেন, অনায়াসে দালান তুলতে পারতেন, নিদেনপক্ষে ভালো মানের টিনও দিতে পারতেন, পোড়া টিন দিয়ে কেউ বাড়ি বানায়? শামীম আপার কাছে আমরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, পোড়া টিন দিয়ে বাড়ি বানাননি বাবা, বানিয়েছিলেন শক্তপোক্ত ভালো মানের টিন দিয়েই, রুপালি রঙের সেই টিনে রোদ এসে পড়লে অনেক দূর থেকে চোখে ঝিলিক পড়ত। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা পুরো বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। সেই পোড়া টিন ফেলেননি বাবা, ওগুলো দিয়েই ফের বাড়ি বানিয়েছিলেন।’ বলতে বলতে শামীম আপার গলা ধরে আসে। আর আমরা হতবাক হয়ে যাই। পোড়া টিনের তাহলে এই কাহিনি? কই, কখনো তো কেউ বলেনি এই গল্প! সত্যি বলতে কি, বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের মনে এই প্রশ্ন জাগেইনি। ছোটবেলায় তো ভাবতাম, টিনের ওপর আলগা রং করে নিয়েছেন পাগলা ডাক্তার, যেন তাঁর বাড়ি অন্য সবার চেয়ে আলাদা দেখায়। যখন জানতে পারি ওগুলো রং করা টিন নয়, পোড়া টিন, তখন থেকেই এই প্রশ্ন মনে জেগে ছিল, টিন পুড়িয়ে কেউ বাড়ি বানায় নাকি, এ কোন ধরনের পাগলামি? 

বাড়ি পোড়ানোর গল্প আমরা বারবার শুনতে চাই শামীম আপার কাছে, কিন্তু তিনি এ বিষয়ে মুখই খুলতে চান না। ও প্রসঙ্গ তুললেই কথা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে গল্প শুরু করেন।

চার.

গল্পটা শোনার জন্য আমাদের আরও বড় হতে হয়। কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম আমরা। তখন সামরিক শাসনের যুগ চলছে দেশে। ছাত্রদের আন্দোলন দমন করার কৌশল হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় যখন-তখন বন্ধ করে দেয় সরকার, অনির্দিষ্টকালের জন্য, আর আমরা নিরুপায় হয়ে গ্রামে ফিরে যাই। এত নির্জন, এত কোলাহলহীন, এত উত্তেজনাহীন, প্রায় স্থবির গ্রামীণ জীবন ভালো লাগে না আমাদের। কিছু করারও নেই। ছোটবেলার মতো দুরন্তপনা তো আর করা যায় না, বড় হয়ে গেছি, এখন উল্টো ছোটদের শাসন করি। মাঝেমধ্যে শামীম আপার কাছে যাই গল্প শুনতে। যতই বড় হই না কেন, তাঁর কাছে আমাদের আদর কমেনি। 

আমরা কথায় কথায় বাড়ি পোড়ানোর গল্পটা শুনতে চাই। এড়িয়ে যেতে চান তিনি, কিন্তু আমরা তাঁকে সুযোগ দিই না। কেন বারবার এড়িয়ে যাবেন? কেন এ বিষয়ে কথা বলেন না তিনি? হয়তো আমাদের পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়েই তিনি মুখ খোলেন, ‘তখন বর্ষাকাল। খবর পেলাম, গ্রামে আর্মি ঢুকেছে। নৌকায় করে তারা আসছে এদিকেই। বাবা তো মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিতেন, তিনি বুঝে গেলেন—আর্মিরা এ বাড়িতে আসবে। রাখালদের বললেন পালাতে। নিজেও আমাকে নিয়ে একটা নৌকায় চড়ে বসলেন। মাঝিকে বললেন, ‘যতদূর পারো, যাও। আশেপাশে থেকো না।’ মাঝি প্রাণপণে নৌকা চালাতে লাগল। কত দূর গিয়েছিলাম মনে নাই, একটানা নৌকা চালিয়ে এসেছে মাঝি, ঘণ্টাদুয়েক তো হবেই। অনেক দূর থেকেই দেখলাম, এ গ্রামে আগুনের শিখা যেন আকাশ ছুঁয়েছে। কোন বাড়িতে আগুন দিয়েছে ওরা, বোঝা গেল না। সারা দিন-সারা রাত কাটল নৌকাতেই। পরদিন ফিরে এসে দেখি, আমাদের বাড়ি পুরোটাই পুড়ে ছাই। টিন তো আর পুরোপুরি পোড়ে না, তাই শুধু কাঠামোটাই কোনোরকমে টিকে আছে, আর কিছু নাই। বাবা বাড়িতে নেমেই প্রথমে খোঁজ করলেন গরু-ছাগলগুলোর। অনেকগুলো গরু ছিল আমাদের। বাবা বড্ড আদর করতেন ওগুলোকে। সেগুলো নিয়ে তো আর পালাতে পারিনি। রাখালেরাও ছিল না বাড়িতে। পোড়ানোর সময় ওগুলোর কী হয়েছে? একটাকেও তো দেখা যাচ্ছে না। খুঁজতে খুঁজতে বাবা গোয়ালঘরে গিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলেন। সবগুলো গরু মরে পড়ে আছে।’ 

শামীম আপা কেঁদে ফেললেন। আমরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ‘ওগুলোকে গোয়ালঘরে বেঁধে রেখেছিলেন বুঝি?’

‘না। ওগুলো বাইরেই ছিল। পাকিস্তানিরা ওদের একটা ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। গ্রামের মানুষের কাছে শুনেছি, ভয়ংকর আর্তনাদ করতে করতে মারা গেছে গরুগুলো। লোকজনের কাছে বর্ণনা শুনে বাবাও আর্তনাদ করতে লাগলেন, আমি বুঝতে পারি নাই, বুঝতে পারি নাই, ওরা এমন করবে। আমিও তো আর্মিতে ছিলাম। যুদ্ধের একটা মিনিমাম এথিকস থাকে। নিরস্ত্র মানুষকে আঘাত না করার এথিকস। আর এ তো অবলা পশু। কোনো মানুষ যে নিরীহ পশুর গায়েও আগুন দিতে পারে, আমি তা ভাবতে পারি নাই। ওরা মানুষ না, ওরা জানোয়ারও না, দানব ওরা, দানব।’ এই শোক সামলে উঠতে বাবার অনেক সময় লেগেছিল। আমারও সময় লেগেছিল। পোষা প্রাণী তো কেবল প্রাণীই নয়, ওদের সঙ্গে তো একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক তৈরি হয়। আমরা যেন স্বজন হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে উঠেছিলাম। বাবা পোড়া টিন দিয়েই ফের বাড়ি তুললেন। অনেকে বলেছিল, নতুন টিন কিনে লাগাতে। বাবা শোনেননি। বলেছিলেন, ‘এ দেশের মানুষ সব ভুলে যায়। এই যুদ্ধের কথাও ভুলে যাবে। এই সব নির্মমতার স্মৃতিও কেউ মনে রাখবে না। সে জন্যই আমি এই টিনগুলো রেখে দেব। যেন এ গ্রামের মানুষ কোনো দিন না ভোলে, যেন মনে রাখে জনমানবহীন শূন্য বাড়িও ওরা পুড়িয়ে দিয়েছিল, পুড়িয়ে দিয়েছিল নিরীহ-অবলা প্রাণীদের। এই গ্রামের মানুষদের আমি এ কথা ভুলতে দেব না, কিছুতেই ভুলতে দেব না।’