জীবন থেকে নেওয়া : 'মধ্যযুগের কবি' ভানুসিংহের কবিতা নিয়ে ডক্টরেট থিসিস

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ মে ১৮৬১—৭ আগস্ট ১৯৪১)। ছবি: সংগৃহীত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ মে ১৮৬১—৭ আগস্ট ১৯৪১)। ছবি: সংগৃহীত

কবি–লেখক–সাহিত্যিকদের জীবন নানা ঘটনায় ভরপুর। তার মধ্যে যেমন হাস্যরস ও আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা আছে, রয়েছে বিষাদমুখর ঘটনাও। আবার অপ্রত্যাশিত, চমকে দেওয়ার মতো ঘটনাও কম নেই তাঁদের জীবনে। এই নতুন বিভাগে আমরা প্রকাশ করব কবি–লেখকদের জীবন থেকে নেওয়া নানা ঘটনা।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন পনেরো। একদিন তাঁর এক বন্ধুকে খুব উত্তেজিতভাবে জানালেন, ব্রাহ্মসমাজ লাইব্রেরিতে খুঁজতে খুঁজতে তিনি বহু পুরোনো একটি জীর্ণ পোকায় কাটা পুঁথি পেয়েছেন। সেখান থেকে কতগুলো কবিতা কপিও করে এনেছেন। কবিতাগুলো শোনালেন বন্ধুকে। শুনে তো বন্ধুটি চরম উচ্ছ্বসিত। বিষম বিচলিত হয়ে উঠলেন পুঁথিটি পাওয়ার জন্য। তাঁর মতে, এ কবিতা বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাসের হাত দিয়েও বের হতে পারত না।

সেই আবিষ্কৃত হওয়া প্রাচীন কবির নাম ছিল ভানুসিংহ।

এই সত্য গল্পের পেছনে রয়েছে আরও অবাক করা এক গল্প। সেই কাহিনিটি এমন:

অক্ষয়চন্দ্র সরকারের কাছে ইংরেজ বালক-কবি টমাস চ্যাটার্টনের গল্প শুনেছিলেন বালক রবীন্দ্রনাথ। এই ইংরেজ কবি প্রাচীন কবিদের নকল করে কবিতা লিখেছিলেন। ১৭ বছর বয়সে তিনি আত্মহত্যা করেন (রবীন্দ্রনাথ ১৬ বছর উল্লেখ করেছিলেন)। চ্যাটার্টনের এই নকল করার ঘটনাটা রবীন্দ্রনাথকে খুব স্পর্শ করল। তিনি তখন মৈথিলী ভাষার প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ পড়ছেন বিশেষ আগ্রহ নিয়ে। প্রাচীন পদকর্তাদের লেখা পড়তে পড়তে হঠাৎ দু–একটি ‘কাব্যরত্ন’ চোখে পড়ে, সে আবিষ্কারে তিনি অন্ধকারে মাণিক্য তুলে আনার আনন্দ পান। চ্যাটার্টনের গল্প শুনে হঠাৎ বালক রবির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। এক বর্ষার দুপুরে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে ওই মৈথিলী কবিতার অনুকরণে লিখে ফেলেন কয়েক লাইন কবিতা। নিজের কৃতিত্বে তখন দারুণ খুশি তিনি।

কয়েক দিনের মধ্যেই লেখা হতে থাকল আরও কয়েকটি। এবার লেখকেরও তো একটা নাম দিতে হয়। তাই নিজেই নাম ঠিক করলেন—ভানুসিংহ।

ভারতী পত্রিকায় ছাপা হতে থাকল ভানুসিংহের পদাবলী। ঘটনা এখানে শেষ হলে তো হতো, কিন্তু ভানুসিংহকে মধ্যযুগের পদকর্তা উল্লেখ করে এবং তাঁর কবিতার সঙ্গে ইউরোপীয় সাহিত্যের তুলনা করে পিএইচডি ডিগ্রি পেলেন যে একজন! যিনি এ বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করলেন, তাঁর নাম নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তখন তিনি জার্মানিতে থাকেন। এই ভদ্রলোক ভানুসিংহের কবিতা পড়ে এতটাই মুগ্ধ হলেন যে ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করে ‘এ দেশের’ গীতিকাব্য সম্পর্কে একটি চটি বই–ই লিখে ফেললেন তিনি। তাতে প্রাচীন পদকর্তারূপে সেই ভানুসিংহকে এতটাই মর্যাদা দিয়েছিলেন যে তা কোনো আধুনিক কবিদের ভাগ্যেও জোটে না।

বলাবাহুল্য, এ লেখা লিখেই নিশিকান্তের ললাটে ‘ডক্টরেট’ উপাধি যোগ হয়েছিল।
সূত্র: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি, লীলা মজুমদারের জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি

গ্রন্থনা: রাসেল রায়হান