অলসবেলার চড়ুইভাতি

শিল্পীর তুলিতে সেন্ট্রাল পার্কে পিকনিক। ছবি: সংগৃহীত
শিল্পীর তুলিতে সেন্ট্রাল পার্কে পিকনিক। ছবি: সংগৃহীত

পাঠ্যবইয়ে কবি গোলাম মোস্তফার নুরু-পুষি-আয়েশা-শফি সবাই মিলে বোশেখ মাসের নির্ঘুম দুপুরে বাগানের গাছের ছায়ায় যা করত, তার নাম চড়ুইভাতি, তার নাম পিকনিক, তার আরেক নাম বনভোজন। এর নাম চড়ুইভাতি কেন, তা আমার জানা নেই। আশা করি, একটি অসামান্য চঞ্চল পাখির উঞ্ছ মৃত্যুর সঙ্গে এর কোনো বেদনাদায়ক সম্বন্ধ নেই। কয়েকজন মিলে সারা দিন প্রকৃতির কোলে কাটানোর জন্য কোথাও গিয়ে রাঁধাবাড়া করে খাওয়া অথবা সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া খাবার সবাই মিলে খাওয়া—এই হলো পিকনিক। পিকনিকে ‘পিক অ্যাট ইওর ফুড’ অর্থাৎ সময় ব্যয় করে অলসভাবে খুঁটে খাওয়াটা রীতি, ফরাসি মূল অর্থ ধরলে এ হচ্ছে সেই কিছুমিছু ঠোকরানো। কেউ কেউ বলে, পিকনিক শব্দটা এসেছে বর্ণবাদী ‘পিক আ নিগ্রো’ বাক্যটি থেকে।

আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশ, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রতাপে পড়ে আমাদের শীতকাল প্রায় উধাও। ওই তো একচিলতে শীতকাল আসে, তার রোদের রং সরষের তেলের মতো আর উত্তাপ বড় মিঠে, তার কুয়াশার রং মোহের মতো, সে সময়টা আমাদের জন্য পিকনিকের উৎকৃষ্ট সময়—বাড়ি থেকে, ডিপার্টমেন্ট থেকে কিংবা অফিস থেকে। শীতের দেশের চিত্র পুরো বিপরীত, সেখানে গ্রীষ্ম আসে অল্প সময়ের জন্য, ‘হিল্লোল তুলে কল্লোলে চলিয়া যায়’, প্রান্তর গহিন সবুজ আর ফুলেল হয়ে ওঠে। সেসব গ্রীষ্মদিনে তারা পিকনিক বাস্কেট/ঝুড়ি ভরে সুখাদ্য আর সুপেয় পানীয় নিয়ে পুরো পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবেরা মিলে চলে যায় পার্কের নিটোল সবুজতায়, পিকনিক ব্ল্যাঙ্কেট বিছিয়ে বসে ‘আলফ্রেস্কো ইটিং’–এর মজা নিতে।

কীভাবে এল পিকনিক?
পিকনিকের এই প্রথার শুরু ধরা হয় ১৬৯২ সালের দিকে, যেকালে এর অর্থ ছিল একদল লোকের সরাইখানায় এসে খানাপিনা করা, কেবল পানীয়টি নিজের আনতে হবে। ৫০ বছরের ভেতরে এ শব্দের সঙ্গে জুড়ে গেল আড্ডা—তাস পেটানো আর সুরা পানের অনুষঙ্গ। ফরাসি বিপ্লবের পর রাজকীয় উদ্যানগুলো প্রথমবারের মতো সাধারণ লোকের গম্য স্থান হিসেবে স্বীকৃত হয়, খুলে যায় চড়ুইভাতির দুয়ার—এর আগে কিনা সূর্যকে সাথি করে চাষারাই কেবল ফসল তোলার সময় জমির খেতে বসে খেত, চাষাদের এসব আলফ্রেস্কো ইটিংয়ের কত ছবি এঁকেছেন ইমপ্রেশনিস্ট আর পোস্ট ইমপ্রেশনিস্টরা, রিয়ালিস্টরাও। ফরাসি বিপ্লবের সময়কার রাজপুরুষেরা—সম্ভ্রান্ত বংশীয়রা—যাঁরা পিকনিক করতেন—তাঁরা প্রাণভয়ে পালিয়ে গেলেন ফ্রান্স ছেড়ে অস্ট্রিয়ায়, প্রুশিয়ায়, এমনকি আমেরিকায়, বেশির ভাগ পাড়ি জমালেন ইংল্যান্ডে। ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন ঘুরে অবশেষে ইংল্যান্ডে এল পিকনিকের এই চল। ১৭৬৩–এ লেডি মেরি কোক তাঁর বোনকে একটি চিঠি লিখে জানাচ্ছেন, একরকমের সমবায় পার্টিতে গেছেন তিনি, হ্যানোভারের লোকে যাকে ‘পিকনিক’ বলে ডাকে। যে পিকনিককে আমরা চিনি, তা আঠারো শতকে আজকের এই রূপের খানিকটা লাভ করে—প্রত্যেকে কিছু আহার্য বা পানীয় নিয়ে আসবে বা খাইখরচা দেবে আর সক্কলে মিলে ফুরফুরে নির্ভার সময় কাটাবে। উনিশ শতকের শুরুতে লন্ডনে এমনকি ফ্র্যাঙ্কোফিলদের মাধ্যমে পিকনিক সোসাইটিরও উদ্ভব হয়—টটেনহাম স্ট্রিটের ভাড়া করা কামরায় এই পিকনিক উদ্‌যাপিত হবে, প্রত্যেকে একটি ডিশ আর বোতল ছয়েক মদ নিয়ে আসবে, যে যার মতো ভাগাভাগি করে একত্রে বসে পানাহার করবে, খাওয়াদাওয়া ছাড়াও নাচ–গান হবে, বসবে জুয়ার আসর এবং অবশ্যই প্রধান আকর্ষণ হবে একটি নাটক। এই পিকনিকে এত আমোদের এবং এতে এতই বিলাসব্যসনের ছড়াছড়ি যে থিয়েটারের মালিকেরা এটা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন।

১৯০৩ সালে শিল্পীর তুলিতে আঁকা পিকনিকের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
১৯০৩ সালে শিল্পীর তুলিতে আঁকা পিকনিকের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

পিকনিকের রকমসকম
ভিক্টোরিয়ান ব্রিটেনে পিকনিক ছিল মূলত সামন্তপ্রভুদের নিজ নিজ এস্টেটে আউটডোরে খানা খাওয়ার অলস অবসর। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে কর্মজীবী মধ্যবিত্তের জীবনেও পিকনিকের অবকাশ এল। ফ্রান্সে পরে ইনডোর পিকনিকের বদলে আউটডোর পিকনিক জনপ্রিয় হতে শুরু করে, লোকে ইংল্যান্ডে বা আমেরিকায় পিকনিককে যতটা ভালো চোখে দেখত, ফরাসিরা প্রকৃতির এই রোম্যান্টিক আইডিয়ালাইজেশনকে ততটা নিষ্পাপ হিসেবে দেখত না, পিকনিক ছিল দুষ্টুলোকের বিলাস, বিপ্লব করে যাদের হটিয়ে দেওয়া হয়েছে সেসব মানুষের গার্ডেন পার্টির স্মারক। বিংশ শতাব্দীতে পিকনিক আউটডোরের বিষয় হয়ে গেল। ইংল্যান্ডে তত দিনে ট্রেন, বাইসাইকেল আর মোটরগাড়ির সুবাদে একদা জনবিরল কান্ট্রিসাইডে বেশ সহজেই পাড়ি জমানো যাচ্ছে, পার্কগুলোতে পাইন বা সেডার কাঠের স্থায়ী পিকনিক টেবিল পাতা হচ্ছে। পিকনিকের জন্য বিখ্যাত কিছু স্পট ছিল, যেমন—ব্রডসওয়ার্থ হল প্লেজার গার্ডেন (ইংলিশ হেরিটেজ ট্রাস্টের কল্যাণে আজও প্রায়-অপরিবর্তিত), উইটলি কোর্ট গার্ডেন, জ্যাকোবিয়ান ম্যানসন হাউস অডলি অ্যান্ড, বেলসি হল দুর্গ ইত্যাদি। রানি ভিক্টোরিয়ার প্রিয় ছিল অসবোর্ন হাউস, আইল-অব-ওয়াইটে অ্যালবার্ট আর ভিক্টোরিয়ার অবকাশ ভবন, একেবারে ওঁদের পছন্দসই জিনিসে সাজানো, ছিমছাম বাগান, বাচ্চাদের খেলার কটেজ, নিজস্ব সৈকত...রানি বলে কথা!

ব্রিটিশরাজের আমলে পিকনিকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে শিকারের ইতিহাস। ইংরেজরা ভূভারতে আসার আগে ভারতবর্ষের গেমবার্ডরা জলাভূমিতে আর বনাঞ্চলে বেশ নিরুপদ্রবই থাকত, ঝাঁকে ঝাঁকে বিচিত্র রকমের পাখি বার্মামুলুক থেকে সিন্ধ অবধি, জলায় স্নাইপ, খেতে ঘুঘু, কাঠপায়রা, জাঙ্গল ফাউল, কোয়েল, ডাহুক, জলপিপি—কী নেই! গরমের দুই মাস ছাড়া বাকিটা সময় শিকারির হাত খুলে শিকারের সময়। ভারতবর্ষের বন্য প্রাণীদের, বিশেষ করে বাঘদের আজকের এই সংখ্যা কমে আসার পেছনে ব্রিটিশদের এসব শিকার-পিকনিকের অবদান বিপুল। ভেবে দেখুন, ১৯০৬ সালে বিকানীরের মহারাজার আমন্ত্রণে লর্ড মিন্টো এমন শিকার-পিকনিকে এসে ভাট-তিতিরই মেরেছিলেন ৪ হাজার ৯১৯টি, যে পাখির মাংস তাঁদের কাছে প্রায় অখাদ্য। ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষে চাকরিরত ব্রিটিশদের সমাজে পিকনিক ও ড্রামা সোসাইটিগুলো ছিল স্ক্যান্ডালের আখড়া, কিংবা কেবলই বিবাহযোগ্য মেয়ে খোঁজার বাহানা। পিকনিকের অলস-মধুর অবসরে কত কী ঘটে যেত! কত মনের ভাঙন-বিভ্রম অথবা যুগলবন্দী!

পিকনিক যখন শিল্পসাহিত্যে
সৃষ্টিলগ্ন থেকেই পিকনিকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দীপনা ও আলোচনা। এ প্রসঙ্গে এদুয়ার মানের ‘দ্য লাঞ্চন অন দ্য গ্রাস’ছবিটির কথা উঠবেই—দুজন পরিপাটি পোশাক পরা পুরুষের সঙ্গে একজন পূর্ণ নগ্ন এবং আরেকজন অর্ধনগ্ন স্নানরতার পিকনিকের দৃশ্য মনে করে দেখুন। জেন অস্টেনের নভেলে (এমা, সে্স অ্যান্ড সেনসিবিলিটি) পিকনিকের দৃশ্যগুলোতে কতই–না হৃদয়ের রেষারেষি। এমিল জোলার লেখায় আছে অর্থাভাবে বিবাহের ভোজসভার বদলে ইনডোর পিকনিক করার কথা, যেখানে সবাই মিলে পাঁচ ফ্রাঁ চাঁদার বিনিময়ে ব্রি চিজ, হ্যাম, স্যুপ, খরগোশের মাংস, কফি, ব্র্যান্ডি ইত্যাদি খেতে পেল। চোখের বালি উপন্যাসে আশালতা আর বিনোদিনীর সেই শান্ত–সুন্দর পিকনিকের বেলা; সত্যজিৎ রায়ের অরণ্যের দিনরাত্রির পিকনিকে খেলতে বসা মেমরি গেম—এমনই কতই না আছে। যত দূর মনে পড়ে, মার্গারিট মিচেলের গন উইথ দ্য উইন্ড শুরু হয়েছে একটি পিকনিক বল–এ যাওয়ার প্রস্তুতি দিয়ে (পিকনিক প্রলম্বিত হতো বল বা পার্টিতে, নাচ-গান হতো)। পিকনিক শব্দটির সঙ্গে বিজড়িত আমার সবচেয়ে ভয়ানক পঠনস্মৃতি হলো: গত শতকের ষাটের দশকের কুখ্যাত খুনি যুগল মুর মার্ডারাররা পিকনিক করতে যেত তাদের খুন করা শিশুদের কবরের ওপর।

পিকনিকের খানাদানা
স্কচ এগ, মাংসের পাই, ডান্ডি কেক, ভাপা পুডিং—এসব ছিল আদিতে পিকনিকে খাওয়ার পদ। ইংরেজদের উনিশ শতকীয় সিদ্দীকা কবীর মিসেস বীটন লিখে গেছেন, পিকনিকে মূলত কেক, জ্যাম-পাফ, পটেড মিট, ফল আর মাখনমাখা টোস্ট—এসব চাই। তাঁর ১৮৬১ সালের বই বুক অব হাউসহোল্ড ম্যানেজমেন্ট–এ তিনি লিখলেন, ৪০ জনের পিকনিকে চাই চারটে মাংসের পাই, চারটে রোস্টেড চিকেন, দুটো হাঁসের রোস্ট, চার ডজন চিজকেক আর একখানা বড়সড় কোল্ড প্লাম পুডিং। লর্ড স্যান্ডউইচের বদৌলতে পাওয়া স্যান্ডউইচ এসে একসময় ঠাঁই নিল ভিক্টোরিয়ান পিকনিকের মেনুতে, প্রায় কাগজের মতো ফিনফিনে পাউরুটিতে শসার পুর বা ডিমের পুর দেওয়া স্যান্ডউইচ। ব্রিটিশরাজের আমলের পিকনিকে ইংরেজরা নিতেন বোতলের জল, মৌসুমের মিষ্টি ফল আর অবশ্যই কোল্ড মিট।

পিয়েরে আউগুস্ত রেনোয়ার ছবি ‘লাঞ্চ অব দ্য বোটিং পার্টি’
পিয়েরে আউগুস্ত রেনোয়ার ছবি ‘লাঞ্চ অব দ্য বোটিং পার্টি’

সমারসেট মম দুপুরবেলার পিকনিকের খাবারের তারিফ করে লিখেছিলেন, ‘আর কোনো খাওয়াই এমন আনন্দের হয় না।’ স্কটিশ ঔপন্যাসিক কেনেথ গ্রাহামের দ্য উইন্ড ইন দ্য উইলোজ–এ বিবরণ আছে বেতের ঝুড়িতে (পিকনিক বাস্কেট) ঠাসা ঠান্ডা চিকেন, হ্যাম, বিফ (সিদ্দীকা কবীরের রেসিপির সেই ‘ঠান্ডা জিহ্বা’ও আছে), ফ্রেঞ্চ রোল, শসার আচার, জিঞ্জার বিয়ার, লেমনেড, সোডা। ষাটের দশকে ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর বের করা কুক-বুকে আছে ‘ফ্যামিলি পিকনিক স্যান্ডউইচ’ বানানোর তরিকা। আস্ত পাউরুটির ভেতরটা কুঁদে নিয়ে তাতে সেদ্ধ মাংস, মেয়োনেস আর লিকুইড জেলেটিন দিয়ে মিশিয়ে রুটি বানানোর মোল্ডে পুরে ফ্রিজে ভরে রাখতে হবে, পরে পিকনিকে গিয়ে কেটে খেলেই চলবে।

আমাদের লীলা মজুমদার তাঁর রান্নার বইয়ে লিখেছিলেন পিকনিকের ফর্দ, ‘দুপুরের জন্য দুটো মুরগি আগের দিন রোস্ট করে রাখলে, তার সঙ্গে আলু রোস্ট করলে, মটর সেদ্ধ করলে... প্রত্যেকের জন্য আলাদা একটি করে প্লাস্টিকের কি কার্ডবোর্ডের বাক্স! তাতে মুরগির ভাগটি দিলে, আলু মটর দিলে। একটা করে ডিম শক্ত করে সেদ্ধ করে, নুন মাখিয়ে লাল করে ভেজে দিলে। মধ্যিখানে শশা টমেটো লেটুসের স্যালাড ভরে একটি কি দুটি রোল দিলে, একটি মিষ্টি প্যাটি দিলে, একটি অন্য মিষ্টি দিলে। সঙ্গে কাগজের কি প্লাস্টিকের গেলাস নিও, যথেষ্ট মিষ্টি পানীয়ের বোতল আর প্রত্যেকে নিজের বাড়ি থেকে খাবার জলের বোতল...সময়কার ফল নিও; বিকেলের জন্য একটা প্লেন বড় ফলের কেক নিও, যার চিনি গলে যাবার ভয় নেই।’ এ তো গেল ব্রিটিশরাজের ঘোরগ্রস্ত পিকনিক, কোল্ড মিট, স্যান্ডউইচ, ফিংগার ফুড আর পেস্ট্রিনির্ভর পিকনিকের মেনু, নইলে দিশি কেতার মেনুও বাতলে দিয়েছেন তিনি: লুচি/পরাটা, শুকনো আলুর দম/আলু–কপির চচ্চড়ি, মাছের চপ, মাংসের বড়া/শামি কাবাব। তবে লীলা মজুমদার নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন, সবচেয়ে মজা হয় সেখানে গিয়ে খিচুড়ি, বেগুনভাজা, আলুর দম, টমেটোর চাটনি, মাছভাজা রাঁধা যায় যদি।

অন্য এক ভুবনে
পিকনিক করতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া, পানিতে ডুবে যাওয়া, বাসের ওপর দাঁড়িয়ে উন্মাদ নৃত্য করতে করতে পিকনিকে যেতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হওয়া অনেক ছেলেমেয়ের গল্প খুব চালু ছিল বাতাসে, এই আমাদের শৈশবে। স্কুলের পিকনিক বা ইয়েলো-বার্ডস/গার্ল গাইডসদের পিকনিকই ছিল ভরসা, স্কুলের কাঁঠালগাছতলায় বড় বড় ডেকোরেটরের পাতিলে ঘুঁটে রাঁধা খিচুড়ি আর লাবড়া। বড়দের পিকনিকগুলো হতো অফিসের পিকনিক, লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজনের বিচিত্র শিক্ষার দুপুর। দুপুরের খাবারটা আগের দিন রাত জেগে মেয়েরা-বউয়েরা তৈরি করে আনত—শীতের সুখাদ্য মটরশুঁটির পোলাও, চিকেন রোস্ট। খাসির ঝাল মাংসের বাকিটা রান্না হতো কাঠকুটো জ্বালিয়ে পিকনিক স্পটে। স্যালাডও কাটাকুটি হতো সেখানেই। সকালের বাসে করে পিকনিক স্পটে আসার সময় নাশতায় থাকত ডিম সেদ্ধ, ফ্রুটকেক, কলা—এ রকম। মায়েরা, মেয়েরা, বউয়েরা কাকভোরে হলুদবাটায় গোসল করে হিমানি মেখে তেল-কাজলে সেজেগুজে আসত, তখনো অনেকে লিপস্টিকের টিপ দিত কপালে, বাজারে উঠেছে কালো পুঁতিতে গাঁথা গিল্টি করা সোনার মাদুলি, পাফহাতা কামিজ আর ধুতির মতো অজস্র কুঁচি দেওয়া সালোয়ার। কারও চুলে মাধুরী দীক্ষিতের মতো স্টেপ-কাট, কারও তখনো বাগান-খোঁপা। রাত জেগে কাজ করেছে বলে চোখ ফোলা ফোলা। কারও হাতে ভ্যালিকা উলের পুঁটুলি, অবসরে বুনবে বলে। পিকনিকে এসেও লিঙ্গভেদে আলাদা হয়ে যেত বড়রা। বাচ্চাকাচ্চা পড়ে গিয়ে পায়ের নুনছাল তুলে ফেলল কি না, কমলা খেল কি না, হিসি করল কি না, ফুলটোক্কা খেলার সময় ধাক্কা লেগে কাঁদল কি না—এসব দায়িত্ব পুরোটাই মায়ের। বাবারা একধারে মায়েদের বিছিয়ে দেওয়া বিছানার চাদর আর পাশবালিশে কাত হয়ে, আধবেলা আইঢাই করে মায়েদের তৈরি খাদ্য খেয়েদেয়ে সারা বেলা তাস খেলত। মেয়েরা রান্নার উনুনে কাঠ গুঁজত, বাচ্চার হারিয়ে যাওয়া জুতোর পাটি খুঁজত, খাদ্য পরিবেশনের পর পিকনিকের চাদরে এলিয়ে দিয়ে চলত জোর গল্পগুজব, কথা চালাচালি, ফিকে হয়ে আসা প্রসাধনের পুনরুদ্ধার। উভয় দলেরই ছিল ভোটাধিকার, কিন্তু শ্রমের সুষম বণ্টনের কথাটাও সেখানে শ্রাব্য নয়। দিনের শেষে মায়েদের চুলে ঘ্রাণ থাকত পোড়া কাঠের, বাপদের গায়ে সিগারেটের, ছেলেমেয়েদের পকেটে কুড়িয়ে পাওয়া কার্তুজ। এই পিকনিকে শিশুদের আমোদিত হওয়ার তেমন কিছু ছিল না, প্রান্তর ছাড়া, ফুলটোক্কা বা রুমালচোর খেলা ছাড়া। শালবন, তাতে শালফুলের মিষ্টি গন্ধ, বিকেলের আলো ফুরাতেই শালবন থেকে উঠে আসা রৌদ্রদগ্ধ পাতার সুবাস, সেনাবাহিনীর তৎপরতায় গজিয়ে ওঠা গোলাপবাগান, ঠিকঠাক ছাঁটা ঝাউবীথি আর পামগাছের সারি ছাড়া।

আমরা যারা দিন আনি দিন খাই করে হাজার হাজার দিন খেয়ে ফেলেছি, তারা এই সব দিনের পাশাপাশি খেয়ে নিয়েছি গজারিগাছ, বাদামপাতা, শালফুল ফোটা বনানী, হ্রদের মেদুর নীল। আমাদের শহরে বা শহর ছেড়ে দূরে আর পিকনিক করার মনোরম স্থান বেশি বাকি নেই। প্রেমের শুরু, সম্প্রসারণ এবং শেষ—এই পুরো সময়টাতেই প্রেমিক–প্রেমিকার জন্য কোনো দিগন্ত নেই যে শহরে, আমরা সেই দুর্ভাগা শহরে বাস করি। যত স্নিগ্ধ শ্যামলিমা আমরা স্পর্শ করেছি, ততই তাদের দিকে ধাবিত হয়েছে মরু। যাদের রেস্ত আছে, তারা অনেকে খামারবাড়ি গড়ে, বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে সেখানে পিকনিক করে, রানি হতে পেলেই সাধের গোয়ালিনী হওয়ার সাধ যায়, তা ফ্রেঞ্চ রানি মেরি আঁতোয়ানেতই দেখিয়ে গেছেন। আর কয়েক বছর পর যখন সব বনজঙ্গল শস্যখামার বা হাউজিং হয়ে উঠবে, সব দিঘি হয়ে উঠবে প্লাজা ও পণ্যবিতান, বিহার অবশেষে হবে সিনেমার নাচের শুটিংস্পট, তখন পিকনিক করতে মানুষ কোথায় যাবে? কোথায় গিয়ে শুঁকবে গলদঘর্ম মায়ের কোলে ফেলা ফ্লানেলের জামার উত্তাপ, পোড়াকাঠের সুবাস, প্রদোষের অন্ধকারে নিবিড় শালফুলের গন্ধ? ‘যে বন্ধুরা কৈশোরে নারকেল বনের পাশে বসে আত্মহত্যার মতো বিষণ্ন উপায়ে উষ্ণ মেয়েদের গল্প করত, শীতকালে চাঁদের মতো গোল বোতামের কোট পরে ঘুরত পাড়ায়, যে বন্ধুরা থিয়েটারে পার্ট করত, কেউ সাজত মীরজাফর, কেউ বা সিরাজ (আবুল হাসান)... তারা আগামী দশ-কুড়ি বছর পর কোথায় শীর্ণ শীতের বাতাসে পিকনিকের মন্থর বেলায় দাঁতের তলায় মরসুমী চনমনে সবুজ কাটতে কাটতে আচমকা কাউকে ভেবে নিয়ে সুখী হয়ে উঠবে তো?’ প্রান্তর যখন থাকবে না, সবুজকে ঘিরে থাকবে না উপাসক পাখি আর প্রাণী, তখন কি আমরা ইতিহাসের দেঁতো হাসির মতো কোনো ‘অ্যাটাভিজম’বশত ফিরে যাব বদ্ধঘরের সেসব পিকনিকে, যেখানে মত্ততা ছাড়া আর কোনো গন্তব্য নেই?